বিতর্ক আর ব্যর্থতার এক মঞ্চে যেন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) এবারের আসর। মাঠে ক্রিকেটের উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতার কিছুটা ছন্দ থাকলেও, মাঠের বাইরের অগোছালো আয়োজন, টিকিট কেলেঙ্কারি, খেলোয়াড়দের অর্থ না দেওয়া এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের অপেশাদার আচরণ পুরো টুর্নামেন্টকে করেছে কলঙ্কিত।
শুরুর হট্টগোল-
চলতি বিপিএল শুরুর দিন থেকেই একের পর এক বিতর্ক সামনে এসেছে। ঢাকার মিরপুরে প্রথম পর্বে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট আর চমৎকার কিছু ম্যাচ দর্শকদের মন কাড়লেও আয়োজনের ত্রুটি, বিশেষ করে টিকিট বিতরণে সমস্যা আর দর্শকদের হতাশা, শুরুতেই জন্ম দেয় নেতিবাচক আলোচনার। আয়োজকদের অপারগতা, দর্শকদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের ঘাটতি হয়ে ওঠে স্পষ্ট।
দর্শকদের এই ভোগান্তির ব্যাপারটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এমন কী ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গেও বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের সঙ্গে তর্কের ব্যাপারটি এসেছে সামনে। ‘আপনি কীভাবে বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তা আমাদের জানা আছে।’ -ফারুক আহমেদকে এমন কথাও বলেছেন মাহফুজুল আলম! ইতিহাসের সেরা বিপিএল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরুতেই হোঁচট খায় বিসিবি!
সিলেটে বিতর্ক-
ঢাকা পর্ব শেষে সিলেটেও ছিল একই দৃশ্যপট। সেখানেও শুরু হয় নতুন বিতর্ক। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল ও ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে বিসিবি সভাপতি ও পরিচালকের কথার লড়াই, টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে ফেলে। মাঠের খেলায় মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে এসব বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয় বেশি। এবার সামনে আসে ফারুক আহমেদ এবং বোর্ড পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মধ্যে তর্কের খবর। যদিও এটি ঢাকাতেই হয়েছিল। এনিয়ে বেশ জলঘোলা হয়!
চট্টগ্রামে সংকট
চট্টগ্রাম পর্বে সামনে আসে বিপিএলের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। হঠাৎ করে জানা যায়- দুর্বার রাজশাহী দলের খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাননি। কিছু বিদেশি খেলোয়াড় আংশিক অর্থ পেলেও স্থানীয় খেলোয়াড়দের দিক থেকে ছিল চরম উদাসীনতা। বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর ক্রিকেটাররা অনুশীলন বর্জন করেন। এরপর ম্যাচ না খেলারও হুমকি দেন তারা।
যদিও সেই সংকটের মীমাংসার জন্য হস্তক্ষেপ করতে হয় বিসিবি সভাপতিকে। যদিও দ্রুত সমাধান আসেনি। ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বারবার ভঙ্গ হয়েছে এবং চেক বাউন্সের ঘটনাও দেখা গেছে। খেলোয়াড়দের প্রাপ্য অর্থ না পাওয়ার অভিযোগ শুধু স্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, লঙ্কান এক ক্রিকেটারও অভিযোগ তুলেন!
ফিক্সিংয়ের কালো-ছায়া
অবশ্য বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ আগেও শোনা গিয়েছে। তবে এবারের আসরে এই অভিযোগগুলো আরও জোরালো। বোলারদের অস্বাভাবিক ডেলিভারি, ইচ্ছাকৃত নো বল, এবং ওয়াইড বোলিংয়ের মতো ঘটনাগুলো ফিক্সিংয়ের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছে। সঙ্গে ছিল-তামিম ইকবাল ও সাব্বির রহমানের অপেশাদার আচরণ। তারা মাঠেই তর্কে জড়িয়েছেন। এমন কী তা সরাসরি সম্প্রচারিতও হয়েছে!
মালিকদের দেউলিয়াপনা ও খেলোয়াড়দের অপমান-
চলতি বিপিএলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের আচরণ। তারা বিদেশি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও মেন্টরদের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রাপ্য অর্থ দিতে কেমন যেন পিছপা থাকছে। পারভেজ হোসেন ইমনের মতো তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের অর্থ আটকে রাখা এবং মালিকদের আত্মতৃপ্তির অজুহাত দেখানো নিশ্চিত করেই পেশাদার ক্রিকেটের জন্য লজ্জাজনক।
এখানে শুধু স্থানীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গেই অন্যায় হয়েছে তা নয়, অভিযোগ আছে-শহীদ আফ্রিদির মতো আন্তর্জাতিক তারকাও চিটাগং কিংসের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ পাননি।
ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন-
চলতি বিপিএলে মাঠের ক্রিকেট যতই উত্তেজনা ছড়াক না কেন, মাঠের বাইরের এ ধরনের অপেশাদার আচরণ বিপিএলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুলেছে বড় প্রশ্ন। পেশাদারিত্বহীনতা, দুর্নীতি আর ব্যবস্থাপনার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কেন অন্য ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের চেয়ে পিছিয়ে বিপিএল। দেশীয় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরা এবং দেশের ক্রিকেটের প্রসার-দুটো মিশনেই ব্যর্থ বিসিবি।
মাঠের বাইরের অগোছালোতা, ফিক্সিংয়ের অভিযোগ, এবং খেলোয়াড়দের প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের উদাসীন আচরণের পর অনেকেই বলছেন বিপিএল মানে হলো-বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ!
অথচ এবারের বিপিএল শুরুর আগে আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটি হবে সর্বকালের সেরা বিপিএল। রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুন উদ্যমে টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বলা হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা, উন্নত আয়োজন, এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বিপিএলকে এবার সত্যিকার অর্থেই অন্য উচ্চতায় নেওয়া হবে। যেখানে প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ক্রীড়া উপদেষ্টা সবারই মেধার ছাপ থাকবে।
কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। মাঠে কয়েকটা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা ও ব্যাটিং উইকেটের প্রশংসা থাকলেও, পুরো আয়োজন জুড়ে অপেশাদারিত্ব, আর্থিক জটিলতা, এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দেউলিয়াপনা সেই প্রতিশ্রুতিকে ম্লান করে দিয়েছে। মাঠের বাইরের বিতর্ক, খেলোয়াড়দের অর্থ না দেওয়া এবং ফিক্সিংয়ের অভিযোগ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিপিএলকে সেরা করার প্রতিশ্রুতি শুধুই ছিল মুখের কথা।
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কিংবা নতুন ব্যবস্থাপনা-কোনো কিছুই বিপিএলের গুণগত মান উন্নত করতে পারেনি। বরং বিপিএল আরও বিতর্কিত হয়ে উঠেছে এবার।
প্রশ্ন হলো- বিসিবি কি এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে? ভবিষ্যতে কি এমন ত্রুটিপূর্ণ আয়োজন এড়িয়ে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেবে? প্রশ্নের উত্তর জানেন শুধুই বিসিবি কর্তারা। তবে আপাতত আশার আলো নেই!