উমরায় আগ্রহ বাড়ছে, তবে পিছু ছাড়েনি বিড়ম্বনা
‘আল্লাহর ঘরে যাওয়ার ডাক এসেছে, আপনি কি সাড়া দেবেন? আমাদের উমরা কাফেলার সবচেয়ে বিশেষ বিষয় হলো, সঙ্গে থাকবেন প্রখ্যাত এক ইসলামিক স্কলার। তিনি শুধু শরিয়া গাইডলাইন দিয়েই ক্ষান্ত হবেন না, বরং কিভাবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে উমরা সম্পন্ন করতে হয়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন। উমরা শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি এমন একটি সুযোগ। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করতে পারবেন এবং নিজের আখেরাতকে সফল করতে পারবেন।’
‘উমরাপালনকারীদের সর্বোত্তম সেবাই আমাদের প্রতিশ্রুতি। অভিজ্ঞতার আলোকে মানসম্পন্ন সেবা দেই। এর অন্যতম হলো, দক্ষ সার্ভিস টিমের মাধ্যমে সময়মত খাবার পরিবেশন। আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। মক্কা-মদিনায় মানসম্পন্ন আবাসনের ব্যবস্থা। নারীদের জন্য নারী গাইড।’
এভাবেই হজ ও উমরার এজেন্সিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। আবার কোনো এজেন্সি উমরা পালনের আগে-পরে ভিন্ন কোনো দেশ ঘুরে আসার প্যাকেজ ঘোষণা করে। ফলে মানুষ ব্যাপকভাবে উমরার দিকে ঝুঁকছে।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর এক নেতা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘হজের বিপরীতে উমরার খরচ অনেক কম। সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার মধ্যে একজন উমরা করতে পারেন। ফলে খরচ বাঁচাতে অনেকেই উমরার দিকে ঝুঁকছেন।’
তার মতে, ‘ছোট ছোট উমরা গ্রুপ পরিচালকদের আকর্ষণীয় উমরা প্যাকেজ অফার ও নানা তৎপরতা উমরা যাত্রী বাড়ার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে সৌদি আরবের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণের সুবিধার সঙ্গে আরও দেশ ভ্রমণের সুযোগ তরুণদের উমরা পালনে বেশি আগ্রহী করে তুলছে।’
বাংলাদেশে হজ এজেন্সি রয়েছে প্রায় দেড় হাজার। এর বাইরে ট্র্যাভেল এজেন্টরাও হজ ও উমরা নিয়ে কাজ করেন।
অ্যাসোসিয়েন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আব্দুস সালাম জানান, ‘হজের খরচ বেড়েছে। এটা সব দেশেই। এর সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ায় আরো খরচ বেড়েছে। একজনের হজের খরচ দিয়ে চার জন উমরা করতে পারেন। ফলে উমরার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এখন বছরে পাঁচ লাখের বেশি মুসলমান উমরা করতে যান।’
রয়েছে বিস্তর অভিযোগ
উমরাকারীদের বড় একটি অংশ খুব আরামে মক্কা-মদিনার সফর শেষ করে দেশে ফেরেন এমনটা নয়। উমরার এজেন্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও অব্যবস্থাপনার কথা প্রায়ই শোনা যায়।
বিশেষ করে বৃদ্ধ ও অসুস্থ অনেকেই উমরা পালন করতে গিয়ে হারিয়ে যান। এমনও হয়েছে মসজিদে হারামে নামাজ পড়তে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে দলছুট হয়ে দুই-তিন পর্যন্ত একা থাকেন। এভাবে হারিয়ে যাওয়া রোধ করতে অনেকটাই উদাসীন থাকে এজেন্সিগুলো। এমনকি সঠিকভাবে উমরা পালনের বিষয়েও তারা সাহায্য করে না।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক গ্রুপ লিডার বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক যাত্রীকে হোটেলের কার্ড, মোবাইল ও পরিচয়পত্র রাখতে বলি। তারা কথা না শুনলে আমাদের কি করার আছে?’
তিনি বলেন, তার পরও হারিয়ে গেলে আমরা যথাসাধ্য খুঁজে দেখি। কিন্তু এত বড় প্রাঙ্গণে কারো খোঁজ করা অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো।
বাংলাদেশ থেকে উমরা পালন করতে গিয়ে এভাবে হারিয়ে যাওয়া, অসুস্থতা ও প্রতারিত হওয়াসহ নানা বিড়ম্বনার মুখে পড়েন যাত্রীরা। যদিও হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে যাত্রীদের সচেতনতার কথা বলেন মক্কার ইবরাহিম খলিল রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ হজ অফিস কিংবা মদিনার কিং ফাহাদ ২১ নম্বর গেইটের কাছে বাংলাদেশ হজ অফিসের দায়িত্বশীলরা।
কয়েকজন উমরা পালনকারী ও ভুক্তভোগী বলেন, হারিয়ে গেলে কোথায় অপেক্ষা করতে হবে এমন একটি জায়গা আগে থেকেই ঠিক করে রাখলে দুশ্চিন্তা এড়ানো যায়।
গ্রুপ লিডারদের প্রতারণা
বছরজুড়ে উমরার ব্যবস্থাপনা করে বেসরকারি এজেন্সিগুলো। এখানে সরাসরি লাইসেন্সধারী এজেন্সির বাইরে বিভিন্ন গ্রুপ লিডাররা এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা-টিকেট করিয়ে হোটেল ভাড়াসহ সব ব্যবস্থা করে। উমরার ক্ষেত্রে এমন গ্রুপের সংখ্যাই বেশি। আর তাদের মাধ্যমে উমরা পালন করতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। এখানে বড় অভিযোগের জায়গা হলো, বিভিন্ন গ্রুপ লিডাররা তাদেরকে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যান। পরে গিয়ে দেখেন উল্টা চিত্র।
উমরা করতে গিয়ে এমন বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানান আবুল কালাম।
তিনি বলেন, ‘সবাই চান মক্কায় থাকার সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কাবা শরিফে পড়তে আর মদিনায় থাকলে মসজিদে নববিতে পড়তে। তাই তারা চান হোটেল যেন হাঁটার দূরত্বে হয়। এ জন্য গ্রুপ লিডাররা বেশি টাকা চার্জ করে। কিন্তু গিয়ে দেখা যায় যে, হোটেল থেকে মসজিদ এতই দূরে যে হেঁটে যাওয়ার উপায় নাই। তার মধ্যে নোংরা পরিবেশ, পানি না থাকা, নোংরা টয়লেটের সমস্যা তো থাকেই।’
এ বিষয়ে সরকারের সু-নজর থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এক্ষেত্রে কোনো গ্রুপ লিডারের মাধ্যমে তৃতীয় মাধ্যম হিসেবে উমরা না যেয়ে এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি উমরায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে হজ মিশন।
তাদের স্পষ্ট কথা, কোনোভাবেই গ্রুপ লিডার নামধারী তৃতীয় পক্ষ বা বেনামী মোয়াল্লেমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না হওয়া।
এজেন্সিগুলো বিভিন্ন দামে নানা ধরনের প্যাকেজ সুবিধা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্যাকেজের টাকা দেখে নয় বরং সার্ভিস দেখে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এজেন্সির মাধ্যমে উমরা পালন করা ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, প্যাকেজে থাকা-খাওয়া, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও ফ্লাইট ভাড়াসহ সব সুবিধা আছে কি-না তা যাচাই করে প্যাকেজ নির্বাচন করতে হবে। কম টাকার প্যাকেজে অনেক জরুরি সার্ভিস বাদ পড়তে পারে, আবার প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
থাকা-খাওয়া
মক্কা-মদিনায় যেখানে থাকবেন, ওই হোটেল, বাসা কী ধরনের, মসজিদ থেকে কত দূরে, লিফট আছে কি-না, একেক রুমে কতজন থাকবেন, একটি টয়লেট কতজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে- এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে যেতে হবে। এমন পরামর্শ দিয়েছেন অভিজ্ঞরা।
সৌদি আরবে পৌঁছে তিন বেলা খাবার দেওয়া হবে কি-না, খাবার না দিলে কোথায় কী ধরনের খাবার পাওয়া যাবে, কত খরচ পড়বে তার ধারণা রাখার পরামর্শ দেন তারা।
অসুস্থতা
উমরার সফর সাধারণত ১৫ দিনের হয়। কিন্তু সফরে বিরূপ আবহাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ পথ হাঁটা এবং প্রচুর মানুষের ভিড় থাকায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা থাকা জরুরি।
কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের জন্য মক্কা ও মদিনায় মিশন অফিসে স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা আছে বলে জানান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অধি-শাখার উপ-সচিব ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হক।
রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর মনে হলে চিকিৎসকরা বড় হাসপাতালে রেফার্ড করে থাকেন।
এর বাইরে মক্কা-মদিনার ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হজ ও উমরাকারীদের জন্য স্বাস্থ্য ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
তবে কারো যদি নিয়মিত কোনো ওষুধ খেতে হয়, তাহলে যতদিন সফরে থাকবেন ওই হিসেব করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে রাখা। কেননা সৌদি আরবে কেউ ফার্মেসি থেকে চাইলেই ওষুধ কিনতে পারে না। তার জন্য চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখাতে হয়।