এখন চলছে আরবি রজব মাস। আল্লাহতায়ালা বারো মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ -সূরা তাওবা : ৩৪
এই চারটি সম্মানিত মাসের একটি হলো রজব। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক- জিলকদ, জিলহজ, মহররম আর চতুর্থটি হলো- রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ -সহিহ বোখারি : ৬৭২
আলেমরা বলেন, আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফিক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। -মাআরিফুল কুরআন : ৪/৩৭২
তাই আশহুরে হুরুমের অন্তর্গত রজব মাসের মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে, এই মাসটি অফুরন্ত বরকত নিয়ে আসে এবং আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের জন্য এটি একটি চমৎকার সময়। তাই রজব মাসের পাঁচটি বিশেষ দিক তুলে ধরা হলো।
আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু মাস
রজব অন্যান্য পবিত্র মাস (জিলকদ, জিলহজ ও মহররম) থেকে আলাদা। এটি অন্যদের থেকে পাঁচ মাস পর আসে, তাই এটি একটি অনন্য স্মারক হিসেবে কাজ করে। রজব আমাদের প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে, যেন পবিত্র রমজানের মতো ব্যস্ত মাস হঠাৎ আমাদের ওপর চেপে না বসে। এটি আমাদের রমজানে ধীরে ধীরে প্রবেশের সুযোগ দেয়। তাইতো ইমাম আবু বকর আল ওয়াররাক বলেছেন, ‘রজবে বীজ বপন করুন, শাবানে পানি দিন, আর রমজানে ফসল কাটুন।’
এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ
ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী, রজবে মুসলিমদের জন্য যুদ্ধ বা আক্রমণ শুরু করা নিষিদ্ধ, যেন উমরা পালন সহজ হয়। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কীভাবে এটি প্রয়োগ করতে পারি?
রজব মাসটি হতে পারে রাগ ও অহংকার দমন করার, অন্যের সঙ্গে বিতর্কে না জড়ানোর এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার অনুশীলনের সময়। এটি আমাদের নফস (আত্মা) নিয়ন্ত্রণের দারুণ উপায়, বিশেষ করে যখন রমজান আসন্ন।
পাপের গুরুতরতা উপলব্ধির মাস
যুদ্ধ নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি রজবে পাপ করা অন্যান্য সময়ের তুলনায় আরও গুরুতর বলে বিবেচিত হয়। তবে এটা ভয়ের চেয়েও একটি সুযোগ হিসাবে দেখা উচিত। এটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ, নিজেকে সংশোধন করার এবং রমজানে গিয়ে পাপ কমানোর চেয়ে বরকত অর্জনে মনোযোগ দেওয়ার।
ক্ষমা চাওয়া এবং করার সময়
রজবকে বলা হয় ‘ক্ষমা প্রার্থনার মাস।’ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রজব হলো ক্ষমা চাওয়ার মাস। তাই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
অনেকেই এই মাসে বিভিন্ন দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। তবে নিজেকে ক্ষমা করাও গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো দয়ালু মনোভাব নিয়ে মেনে নেওয়া হলে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া সহজ হয়।
মেরাজের ঘটনা রজবে ঘটে
ইসলামের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা ইসরা ও মেরাজ। রজব মাসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহর মহিমার এক অনন্য ঝলক দেখানো হয়। এই ঘটনার বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে বোরাক নামের বাহনে করে মক্কার মসজিদে হারাম থেকে জেরুজালেমের মসজিদে আকসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি নবীদের এক সম্মিলিত জামাতে ইমামতি করেন। এরপর হজরত জিজিবরাইল (আ.) তাকে আকাশে নিয়ে যান, যেখানে তিনি হজরত আদম (আ.), হজরত ইয়াহহিয়া (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত ইদরিস (আ.), হজরত হারুন (আ.) ও হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সপ্তম আকাশে তিনি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গেও মিলিত হন। সবশেষে নবী কারিম (সা.) কে আল্লাহর সরাসরি উপস্থিতিতে নেওয়া হয়। এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা সূরা নজমের শুরুতে রয়েছে।
রজবের পর শাবান। এরপরই রমজান। মাহে রমজানের পূর্ণ রহমত ও বরকত লাভ করতে এখন থেকেই সচেতন হওয়া কর্তব্য। গুনাহ ছেড়ে নেক আমলের দিকে ধাবিত হওয়ার অত্যন্ত মূল্যবান উপলক্ষ আমাদের সামনে উপস্থিত। এর যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হতে পারি।
রজব মাস আমাদের জন্য পাপমুক্তি, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ সুযোগ। এ মাসটি উদযাপন করুন, এর শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং রমজানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।