বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতিশাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের কিংবদন্তী শিক্ষক ও কল্যাণবাদী অর্থনীতিবিদদের পথিকৃত অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমানের জীবনাবসানের ঘটনায়, যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন মাত্রই দিনকয়েক আগে। আমরা যারা অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অর্থনীতি ও সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি, তাদের কাছে অর্থনীতিবিদদের অবদান-কর্ম নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম হয় অর্থনীতি শাস্ত্রে দর্শনের দারিদ্র্যের কারণে। তবে অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমানের এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রকে অর্থ নয়, নীতির আলোকে দেখতেন। আত্মপ্রচার ও স্বার্থ সিদ্ধির পরিম-লে বিচরণ করেও নীতিনৈতিকতাপূর্ণ মহিমা দিয়ে তিনি নিজের মতো পথ তৈরি করে নিয়ে অবিরত সামনে এগিয়ে গেছেন এবং সেই পথে নিজের চিন্তা, চেতনা ও কর্মকে ছড়িয়ে দিয়ে আলাদা এক জগৎ তৈরি নিয়েছেন। এই জগতে কে এলো-কে এলো না-কে চলে গেল, সেসব নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের কারণে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্রুদ্ধ হলো কি না, কিংবা কারও স্বার্থে আঘাত লাগল কি না; তা নিয়েও তাঁর কোনো বিকার ছিল না।
যখনই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সমাজ-দর্শনের মৌলিক চিন্তায় ছেদ পড়তে দেখেছেন, ছেদ পড়ার লক্ষণ দেখেছেন; তখনই তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এবং কিছুতেই কিছু না হলে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে দূরে সরে গেছেন আর নির্ভৃতে জগতে ফিরে রবীন্দ্রনাথের গানের কলিতে গেয়ে উঠেছেন, “তেমনি করে আপন হাতে ছুঁলে আমার বেদনাতে, নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি জীবন-’পরে।” তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা, তাঁকে বুঝতে পারা, তাঁকে নিয়ে চর্চা করা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান শাস্ত্র এবং সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনার বিকাশের জন্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে অল্পকথায় মোঃ আনিসুর রহমানের মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব, গুরুত্ব ও জীবনকর্ম তুলে ধরা অসম্ভব। শিক্ষাগুরু হিসেবে ছিলেন পুরোপুরি প্রথার বাইরে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হওয়ার জন্য অনুরোধ-উপরোধ, আহ্বান-চাপ-তাপ তিনি অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মক্ষেত্র ও দর্শন পুরোপুরি অনুপোযুক্ত, শিক্ষকরা সবাই চলে গেলে ছাত্রদের পড়াবে কে?
শ্রেণিকক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম ও ব্যতিক্রমী এই শিক্ষক সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে তাঁর অধ্যাপনাকালীন ছাত্র অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ লিখেছেন, “অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমানকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পাই। প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের কোনো টেক্সট বই নেই। তোমরা মাইক্রো ইকোনমিক্স শিখবে কৃষকদের কাছ থেকে।’ আর যদি টেক্সট বইয়ের দরকার হয়, এই বলে আমাদের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন এবং ইটওয়েলের লেখা একটি বইয়ের নাম জানিয়ে দেন... স্যার একদিন বলেন, ‘ধরা যাক, একটা লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সাঁতার জানেন না। তাকে উদ্ধার করতে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে। তারপর তার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ঠেলে তাকে তীরে তুললে। লোকটা বেঁচে গেল। এটাকে কি উন্নয়ন বলা যাবে? এক অর্থে উন্নয়ন, কারণ তিনি মারা যাননি। কিন্তু ওই লোকটাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আপনি কি এভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? তিনি হয়তো বলবেন, ঠিক এভাবে নয়। অন্য একটা পথও তো ছিল। এটাকে এভাবে বলতে পারি, ধরা যাক, তুমি উদ্ধারের জন্য তার কাছে সাঁতরে গেলে। তাকে বললে, আমার এই হাতটা ধরেন এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে তীরে চলেন। আমরা একসঙ্গে যাব। এটাই কিন্তু বেশি গ্রহণযোগ্য।”
এই কথার মাধ্যমে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দৈন্যের অলঙ্ঘনীয় পূর্বাভাস অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান যে ৫০ বছর আগেই দিয়েছিলেন, তা নিশ্চয়ই এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হবে। এ কারণেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, অর্থনীতি শাস্ত্রের একাডেমিক অঙ্গনে কাজ করা থামিয়ে না দিলে তাঁর অনেক আগেই অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান নোবেল পুরস্কার পেতেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মানবিকতা, সহমর্মিতা আর মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করতে চাওয়ার ভাবনা এবং সবসময় কল্যাণবাদী অর্থনীতির চিন্তার বহিঃপ্রকাশ তিনি শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল ও সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ সর্বত্র বয়ে বেরিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসন প্রশ্নে তিনি প্রচলিত-মূলধারার অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তকের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্নমতের ছিলেন।
‘অপহৃত বাংলাদেশ’ গ্রন্থে তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের সৃষ্টিশীল সত্তাকে অস্বীকার করে, এ সত্তাকে আত্মচরিতার্থের জন্য মুক্তি না দিয়ে, অসাধ্য সাধন করতে আহ্বান না করে আমরা তাদের দারিদ্র্যকেই তাদের প্রধান পরিচয় ও জাতীয় সমস্যা বলে চিহ্নিত করে এই দারিদ্র্য বিমোচনের আশ্বাস দিয়ে দিয়ে তাদের অপমানিত করছি। এই অপমান যে নিজেদেরই করছি তাও আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ মানুষের পরিচয়কে খাটো করলে মানুষকুলের সদস্য হিসেবে নিজেরাও খাটো হয়ে যাই।”
তাঁর দার্শনিক এই যুক্তিতে বাংলাদেশের কল্যাণবাদী উন্নয়নের আদি-অন্ত-ভূত-ভবিষ্যৎ ভাবনার অনেক উপাদানই রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত উন্নয়ন ভাবনায় মানুষের যেহেতু কোনোভাবেই মুক্তি মিলছে না, মানুষ যেহেতু ক্রমশই ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং কোনোভাবেই সমর্থ হচ্ছে না; সেহেতু আনিসুর রহমানের মতো মূলধারার বাইরে গিয়ে অর্থনীতি চিন্তার চর্চা করে তা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা বাংলাদেশের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান কেমন ব্যক্তিত্ব-আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী ছিলেন, তার নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘পথে যা পেয়েছি’ গ্রন্থে, “আমেরিকায় উইলিয়ামস কলেজে শিক্ষকতায় থাকাকালেই আমাকে না জিজ্ঞেস করেই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয়। দেশে ফিরে জানতে পারি বাহাত্তরের ১৮ই জানুয়ারি এই মর্মে সরকারের গেজেট নোটিফিকেশনও হয়ে গিয়েছে এবং সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়াতেও এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ্দের নিয়ে এই পরিকল্পনা কমিশনের অনেক আশা। আমি তবু ঢাকায় ফিরে সোজা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে রিপোর্ট করি এবং ক্লাস নিতে শুরু করি। আমরা যে তেমন কিছু করতে পারব না, রাজনীতিবিদরাই আসল ক্ষমতা ব্যবহার করবেন এবং তাদের ইচ্ছেমতোই দেশ পরিচালনা করবেন, এ সম্বন্ধে আমরা তো দিল্লীতেই আলোচনা করেছিলাম ও একমত হয়েছিলাম। ... চুপ্ করে বিশ^বিদ্যালয়ে, যেন আত্মগোপন করে, কাটাতে থাকলাম। প্রথমে ফোন করলেন পরিকল্পনা কমিশনের “মেম্বার ওয়ান”। “কী আনিস তুমি জয়েন করছো না? তোমাকে ভীষণ দরকার, অনেক কাজ!”। আমি বল্লাম, আমার সঙ্গে তো দিল্লীতেই কথা হয়েছিল আমরা জয়েন করব না। আপনারা জয়েন করে ভুল করেছেন। আমি করতে চাই না। ... তখন স্বয়ং ডেপুটি চেয়ারম্যান ফোন করলেন। তাঁকেও একই কথা বললাম। তিনি বল্লেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আমি বেয়াদবের মতোই বললাম, “দেখা করতে হয় আপনি আসুন।” ... “মেম্বার ওয়ান” আবার আমাকে ফোন করেন এবং বলেন ডেপুটি চেয়ারম্যান কী করে আমার কাছে আসবেন। আমি বলি যে আমি তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না তিনিই আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন, কাজেই তাঁরই আমার কাছে আসা উচিত এবং আমি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদমর্যাদা কারো চাইতে কম নয় বলেই মনে করি। ... ফেব্রুয়ারীর ৪-তারিখে ডেপুটি চেয়ারম্যান, মেম্বার ওয়ান এবং “মেম্বার টু” তিনজনই উপাচার্জ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের অফিসে আসেন ...।” অনুরোধ-চাপাচাপিতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে নানা শর্ত দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দিলেও ছয় মাস পরই সবার আগে পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আপন ভুবনে ফিরে যান নিজের মতো করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসে।
বাংলাদেশের সত্যিকার বিনির্মাণে তাঁর যে দর্শন তা আগেও অপরিহার্য ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তিনি তাঁর দর্শন দিয়ে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক সংবিধান রচনা করে গেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘অপহৃত বাংলাদেশ’-এ বলেন, “উন্নয়নের অর্থ মানুষের সৃষ্টিশক্তির মুক্তি এবং এই মুক্তির পরিকল্পনাই হলো উন্নয়ন পরিকল্পনা। কতগুলো রেলওয়ে ওয়াগন আমদানি করতে হবে, কত মাইল রাস্তা তৈরি করতে হবে এবং কতখানি জমি দেশি ধানের চাষ থেকে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষে আনতে হবে, এগুলো সব উন্নয়ন অ্যাকাউন্টিংয়ের কাজ, যে কাজ দক্ষ অ্যাকাউন্ট্্যান্টরা করবেন। পরিকল্পনাবিদের কাজ মানুষের আত্মা যে দরজায় আঘাত করছে, তা কী করে খোলা যায় তার পরিকল্পনা করা। গ্রামে যেতে হবে নিজেদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে এবং সত্যিকার উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য যে পরিসংখ্যান প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে-মানুষের এবং তার মন ও মানসের পরিসংখ্যান। আট থেকে দশজনের গ্রুপে ভাগ হয়ে যান, র্যানডমভাবে তিনটি গ্রাম বেছে নিন এবং প্রতিটি গ্রামে এক মাস করে থাকুন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মেঝেতে একটি মাদুর পেতে নিন, মশা সহ্য করতে না পারলে একটি মশার কয়েল রাখুন-এর বেশি নয়। গ্রামে গ্রামবাসীদের মতো থাকুন, তাঁদের সঙ্গে দিনে কয়েক ঘণ্টা করে মাঠে কাজ করুন, কাজ করতে করতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন, অন্য সময় কথা বলুন তাঁদের একেক জনের সঙ্গে এবং তাঁদের একেকটি গ্রুপের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর যতক্ষণ সম্ভব বাইরে থাকুন। রাত্রি যখন গভীর হতে থাকবে, তখন দিনের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গ্রামের সামাজিক মানস আপনার কাছে প্রতিভাত হতে থাকবে। তখন, কেবল তখনই, বাংলার চাষির সম্ভাবনা আপনার কাছে ধরা পড়বে। এভাবে তিনটি গ্রামে থাকুন এবং আর একটি মাস একটি শিল্পাঞ্চলে থাকুন, শ্রমিকদের সঙ্গে। এই শ্রমিকেরাই-কোনো ফ্যাক্টরি বা মেশিন নয়-আরও যথাযথভাবে বলতে হলে এই শ্রমিকদের মন ও মানসই আমাদের শিল্পের ইতিহাস সৃষ্টি করবে। এই মন ও মানসকে, এর ভেতরে যে শক্তি আর কল্পনা লুকানো আছে, তাকে স্টাডি করুন-সে যখন সকালে ফ্যাক্টরিতে যায়, তখন তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এবং তার অপ্রস্তুত কথাবার্তা শুনতে শুনতে, ফ্যাক্টরিতে সে যখন কাজ করে তখন তার কাজে একটি হাত এগিয়ে দিয়ে আবার তার কথা শুনতে শুনতে এবং তারা ইতিহাস সৃষ্টি করতে কোথায় বাধা পাচ্ছে তার খোঁজ করুন। চার মাস পর ফিরে এসে খসড়া পরিকল্পনাটি আর একবার দেখুন। আপনারা তখন এটিকে বদলাতে চাইবেন, আর যতখানি বদলাতে চাইবেন, তা আপনাদের আজকের অক্ষমতার পরিমাপ দেবে।”
৯২ বছর বয়সে মহান এই ব্যক্তিত্ব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদদের জন্য তাঁর মতো একজন অভিভাবকের শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। ১৯৯৩-৯৫ সময়কালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি উদীয়মান অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নীতিনৈতিকতা বোধ জাগরণ ও দার্শনিক চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটানোর প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রয়াস কতটা স্বার্থক হয়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন করা বা পরিমাপ করা অবান্তর-অমূলক। কারণ, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দর্শনের দারিদ্র্য এখন আরও জেঁকে বসেছে। সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে কে কোথায় জড়িত হয়ে পড়ছে, কোন প্রতিষ্ঠানে কী উপায়ে চেয়ারে বসে পড়ছে; সেসব চিন্তা করা এখন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
মোঃ আনিসুর রহমান শুধু শিক্ষক, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না, ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে রেনেসাঁ বয়ে আনার স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক। তিনি ছয়দফা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, পাকিস্তানি শাসকদের এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য ও শোষণের মুখোশ উম্মোচনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম, জনল্যাণ ভাবনা, সমাজচিন্তা আর স্নেহময় স্মৃতি ও গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদসহ সব মানুষের কাছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে অমর হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ প্রয়াত অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান-এর প্রয়াণ বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এতদিন এই ইউনিভার্সিটিতে ভাইস চ্যান্সেলরি করছি, এ রকম কথা তো আমাকে কেউ বলে নাই। আনিস সাহেব আপনাকে আমি বিশেষ অনুরোধ করছি একদিন এসে আমার ঘরে সারা দিন বসে থাকেন দেখবেন কত রকমের দাবি আর তদবিরের জন্য শিক্ষকরা আসতে থাকেন, কই ছুটির দিনে লাইব্রেরি খোলা চান এ রকম দাবি তো কেউ করতে আসেন না...
৯২ বছর বয়সে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক এবং সংগীতশিল্পী আনিসুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন। ১২ বছর আগে আমি সবশুদ্ধ তিনবার তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, তিনবারই আমাকে নিয়ে তার বাসায় গিয়েছেন তারই স্নেহভাজন ডেইলি স্টারের ‘ক্রসটক’ কলামখ্যাত, এখন প্রয়াত মোহাম্মদ বদরুল আহসান। আমার যাওয়াটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- যতটা তার কাছ থেকে হরণ করা যায়। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে আগেই তার লেখালেখির সঙ্গে যতটা সম্ভব পরিচিতি অর্জন করে প্রথম দিন কেবল রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই কথা বলেছি; ঠিক বলেছি এমন নয়, শুনেছি। আরও শোনার জন্য যতটা উসকে দেওয়া যায় ততটাই বলেছি। তিনি নিজ থেকে যখন আবার আসতে বললেন, আমি বললাম, এরপর যেদিন আসব আপনার পরিকল্পনা কমিশনের অভিজ্ঞতা শুনব। দ্বিতীয় দিন তিনি যা বললেন, তা মোটেও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চিফ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের আমলাবিরোধী বিষোদগার নয়, তিনি বলেছেন, দ্যাট ওয়াজ নট মাই কাপ অব টি। সরকারই আমাকে ধারণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
তিনি আবারও আসতে বললেন। তৃতীয় সাক্ষাতের দিন তিনি বললেন, গায়ে একটু জ্বরজ্বর ভাব রয়েছে, তবু অসুবিধে নেই, কথা বলা যাবে। আমি বদরুল আহসানকে আগেই বলেছি, তৃতীয় দিন আমি মুক্তিযুদ্ধকালের বাংলাদেশের প্রধান নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গটা তুলব। বদরুল বললেন, লাভ নেই, সম্ভবত বেশি কিছু বলবেন না। আমি জিজ্ঞেস করেছি, মুখ খোলেননি। কিন্তু আমার প্রশ্নের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও স্মরণ রাখার মতো একটি জবাব দিলেন।
তিনি যা বললেন তা অনেকটা এ রকম: তাজউদ্দীনকন্যা রিমি আমাকে বলল, তাদের আয়োজিত ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা দিবসের আলোচনায় তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেছেন, যে অনুষ্ঠানে হত্যাকারীদেরই স্বজন ও চেলাচামুন্ডারা থাকবে, তিনি তাদের সঙ্গে এক সারিতে বসতে চান না। তার পরও রিমির উপর্যুপরি অনুরোধে এই শর্তে অংশ নিতে রাজি হলেন যে, তিনি সবার আগে বলবেন এবং বলেই অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করবেন। সেদিন তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছিলেন: কোনো সন্দেহ নেই ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ তাজউদ্দীন আহমদের শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, বাস্তবে তাকে হত্যা করা হয় আরও আগে ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪, যেদিন তাকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অত্যন্ত ইঙ্গিতধর্মী একটি হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে তিনি মঞ্চ ছেড়ে বাসায় ফিরে আসেন। আনিসুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অনার্স হতে চেয়েছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষকদের দৃষ্টি বেশি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। কিন্তু রুজি-রোজগারে সুবিধে হবে মনে করে বাবা চাইলেন ছেলেও তার মতো অর্থনীতি পড়ুক। অনিচ্ছুক ছাত্র থার্ড ইয়ারে একবার ড্রপ দিয়েও শেষ পর্যন্ত অনার্স ও মাস্টার দুটো প্রথম শ্রেণির প্রথম স্থান নিয়ে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে লেকচারার পদে যোগ দিলেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি করতে চলে গেলেন হার্ভার্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হার্ভার্ড যাওয়া যেন গ্রাম থেকে শহরে আসা।
পিএইচডি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন বটে, কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে ঢাকাও ছাড়লেন। উসমান গণি যুগের পর ভিসি পরিবর্তনের হলে সত্তরে পুনরায় যোগ দিলেন। রমজানের ছুটি, লাইব্রেরি বন্ধ। কিন্তু উপাচার্যের অফিস খোলা। উপাচার্য জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী কাজ করছেন। আনিসুর রহমান বিনা অনুমতিতে ঝড়ের বেগে তার অফিসে ঢুকে পড়লেন।
‘স্যার, এই যে আপনি বসে কাজ করছেন আর আমি কাজ করতে পারছি না।’
উপাচার্য অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বললেন?’
আমি তখন বুঝিয়ে বললাম, স্যার লাইব্রেরি বন্ধ, আমি আমার কাজ করতে পারছি না আর আপনি তো আপনার কাজ করে যাচ্ছেন।
উপাচার্য এবার যেন ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দয়া করে একটু বসবেন।
আমি বসলে তিনি বললেন, ‘আপনি একটু আগে যে কথাটা বললেন, সেই কথাটা আবার বলবেন কি?’
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। একটু থতমত খেয়ে কথাটা আবার বললাম। উপাচার্য তখন আমাকে বললেন, ‘আমি এতদিন এই ইউনিভার্সিটিতে ভাইস চ্যান্সেলরি করছি, এ রকম কথা তো আমাকে কেউ বলে নাই। আনিস সাহেব আপনাকে আমি বিশেষ অনুরোধ করছি একদিন এসে আমার ঘরে সারা দিন বসে থাকেন দেখবেন কত রকমের দাবি আর তদবিরের জন্য শিক্ষকরা আসতে থাকেন, কই ছুটির দিনে লাইব্রেরি খোলা চান এ রকম দাবি তো কেউ করতে আসেন না।’
উপাচার্য স্কেলিটন স্টাফ রেখে ছুটিতে লাইব্রেরি খোলা রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া বাবার ছেলে অনার্স ফাইনালের থার্ড পেপার পরীক্ষা দিতে গিয়ে টের পেলেন ফার্স্ট ক্লাস মানের উত্তর লিখতে পারছেন না, সুতরাং পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখেই এক সময় বেরিয়ে এলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন অর্থনীতি আর নয়, সাংবাদিকতা করবেন। নিজের সৃষ্টি করা বিব্রতদশা এড়াতে বাড়ি ছেড়ে তার সুহৃদ শিল্পী কামরুল হাসানের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। চাচা এসে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন, আব্বা বললেন, টেক ইট ইজি। আর তিনি নিজে দৈনিক সংবাদ-এ মাসিক ৭৫ টাকা বেতনের অ্যাপ্রেন্টিসের চাকরি নিলেন। তিন মাস বাংলা সংবাদপত্রে কাজ করার পর শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার প্রয়োজনে বিনে মাইনেতে পাকিস্তান অবজার্ভার-এ অ্যাপ্রেন্টিসশিপ শুরু করলেন।
সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়তেও একটা যেনতেন গ্র্যাজুয়েশন দরকার। জগন্নাথ কলেজ টার্গেট করলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্র সেখানে ‘ওভার কোয়ালিফায়েড’ বলে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাদ পড়লেন। মাঝখানে কিছুদিন রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন এবং নতুন থার্ড ইয়ার অনার্স ব্যাচের শেখ মাকসুদ আলী (পরে সিএসপি ও সচিব) জাহানারা হক ও আমিনা বেগমের সঙ্গে গ্রুপ করে পরীক্ষার পড়া ঝালাই করলেন, হারমোনিয়ামে গান তুললেন এবং এম এ পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন। এর মধ্যে ১৯৫৪ সালের ফজলুল হক হল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভিপি পদে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে তার প্যানেলের সদস্যদের নিয়ে পাস করলেন। ১৯৫৭-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির লেকচার পদে যোগ দিলেন আর ১৯৫৯ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে হার্ভার্ড বিশ্বদ্যিালয়ে পিএইচডি করতে চলে গেলেন।
ফিরে এসে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা নিয়ে থাকলেও ষাটের দশকের ক্ষমতাধর ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান না হয়ে পদত্যাগ করে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুর ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারে আমন্ত্রিত ভিজিটিং স্কলার হয়ে। বিভাগীয় প্রধান ড. এম এন হুদার বাইরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে পদটি খালি হলে জ্যেষ্ঠতার প্রশ্নে অধ্যাপক আবু মাহমুদেরই সে পদ অধিকার করার কথা, কিন্তু সুপরিচিত মার্কসবাদী হওয়ার কারণে ভিসি তাকে চাচ্ছেন না, তাকে ডিঙিয়ে আনিসুর রহমানকেই প্রধান হতে হবে। আনিসুর রহমানও তার শিক্ষককে ডিঙাতে চাচ্ছেন না, বরং এই বিরোধে দূরে চলে যাওয়াটা উত্তম মনে করলেন। আনিসুর রহমান তার দেশ ছাড়ার দিনক্ষণ কাউকে বলেননি। তবুও তেজগাঁও এয়ারপোর্টে সবিস্ময়ে দেখলেন আবু মাহমুদ তার বিপ্লবী ছাত্র মাহবুবউল্লাহকে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে বিদায় জানাতেই এসেছেন।
মা ওস্তাদ রেখে বাসায় গান শিখতেন। বড় বোনও শিখতেন, সেতারও শিখেছেন। মায়ের খালাতো বোন ফিরোজা বেগম বিখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী। গান পড়াশোনা থেকে মন সরিয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তার গানের ঝোঁকটাকে বাবা-মা উসকে দেননি। কিন্তু বাসায় যে গানই হতো সেগুলো ‘গিলতেন’ এবং একা একা সুর ভাঁজতেন। তার টান ছিল রবীন্দ্রসংগীতের দিকেই। বাবা-মায়ের অজান্তে ফিরু খালা- ফিরোজা বেগমের বাসা নবাবপুরের ভেতরবাড়ি লেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আসা-যাওয়া শুরু করেন। ‘তিন তলার ঘরে ওস্তাদের কাছে বা একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শিখতেন বা রেওয়াজ করতেন, আমি কাঙালের মতো সামনে বসে হাঁ করে সব গিলতাম।
জানালা দিয়ে বর্ষা এসে তাকে ভিজিয়ে দিত, কিছুটা আমাকেও তিনি শিখিয়ে যেতেন। একদিন অনেকক্ষণ গান করে হঠাৎ থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘একটা গান শিখবে?’ আমাকে আর পায় কে? বললাম, ‘হ্যা’। তখন শেখালেন রবীন্দ্রনাথের ‘আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা।’ আমার ওটাই প্রথম একটা গান সম্পূর্ণ করে শেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় হলের সংগীত প্রতিযোগিতার নাম দিয়ে বিপদে পড়ে যান। যারা তাকে হলের ভিপি বানাতে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছেন, তারা মনে করেন গানবাজনা ভিপির মর্যাদার সঙ্গে মানানসই নয়। ‘ভিপি সাহেব আপনি না গাইলেই ভালো।’ তবুও তিনি গাইলেন, দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক/ তবে তাই হোক।
দেবব্রত বিশ্বাস মানে সবার জর্জ দা ঢাকায় এসে কলিম শরাফীর বাসায় উঠলেন। দুজন একসঙ্গে গান করেন কলিম শরাফী তার কাছ থেকে গান তুলে নেন। ‘আমি সেখানে গিয়ে সতৃষ্ণ নয়নে বসে থাকতাম এবং মাঝে মাঝে জর্জ দা যখন কলিম ভাইকে শেখাচ্ছেন আমি অনুমতি না নিয়েই গলা মিলিয়ে দিতাম। একদিন গানের মাঝখানে জর্জ দা হঠাৎ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার পঞ্চমটা বেসুরো আসে, সাইধ্যা ঠিক কইরা নেন। তার পর একটু থেমে বললেন গলাটা ভালো। আমাকে আর পায় কে। দেবব্রত বিশ্বাস বলেছেন, আমার গলাটা ভালো, বেসুরো পঞ্চম হলে কী হবে, ওটা তো ঘষামজার ব্যাপার। আমার উৎসাহ আকাশে উড়ে চলল।
তিনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে থাকলেন, সুফিয়া কামাল শুনতে চান ‘তোমার পূজার ছলে তোমার ভুলেই থাকি’ কিংবা ‘মধুর তোমার শেষ যেন পাই’। ১৯৬৫ সালে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসান, পাছে সরকারের দালালদের কেউ না আবার শুনে ফেলে এবং রিপোর্ট করে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তো নিজেই ছেড়েছেন। ১৯৬৭-তে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি অধ্যাপক পদে যোগ দেন। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এমএ ক্লাসে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদেরই জয়জয়কার। প্রথম বছরের সেরা ছাত্র ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরের বছরের সেরা সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী।
সে সময় করাচির পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সে কর্মরত তিন বাঙালি অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম, এ আর খান এবং স্বদেশ বোসের সঙ্গে আনিসুর রহমানেরও যুক্ত হওয়ার সুযোগ হলো, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের দাবিতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ষড়যন্ত্র বেশ প্রাণ পেল।
লেখক: নন ফিকশন ও কলাম লেখক
(আগামীকাল সমাপ্য)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারত ও চীনের সাংস্কৃতিক প্রভাবের পাশাপাশি ধর্মীয় এবং সামাজিক বৈচিত্র্যের কারণে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। যেমন, ইন্দোনেশিয়া মুসলিম সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে অন্যান্য দেশগুলো হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এই অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাতীয়তাবোধের উত্থান, তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ, এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই দেশগুলো নতুন রাষ্ট্র গঠনে অগ্রসর হয়। তবে স্বাধীনতার পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো উন্নয়নের গতিধারায় নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যে বাধাগুলো পরিলক্ষিত হয় তা রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিকভাবে জটিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের অভাব এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে উপজাতীয়, বংশগত, এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের কারণে একাত্মতা তৈরি করা কঠিন। এটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
গণতন্ত্রের চর্চা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের সক্রিয় ভূমিকার অভাব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সংহতির সংকট সৃষ্টি করে। স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠী এবং দুর্নীতি এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সরকারি সম্পদ ও সেবার সঠিক বণ্টনের অভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। সৎ ও দক্ষ প্রশাসনের অভাব এই সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
ধর্ম ও ভাষার পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক অস্থিরতা এবংসাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই অঞ্চলগুলোতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। যার মধ্যে অন্যতম সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্যে গণতন্ত্র চর্চা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সুশাসন অপরিহার্য। শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন।
উন্নয়ন কর্মসূচিতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য শিক্ষার প্রসার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এছাড়াও ধর্ম ও ভাষার বৈচিত্র্যকে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। কেননা, এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি বাড়ানো সম্ভব। সার্বিক উন্নয়নের জন্যে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে। সর্বোপরি, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তবে সুশাসন, জাতীয় ঐক্য, এবং জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে এইঅঞ্চলে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এইউবি)।
ইমেইল: [email protected]
হঠাৎ করেই খবর পেলাম আমাদের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমান পরিণত বয়সেই শেষ বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। গত দশ-পনেরো বছর ধরে পণ করেছিলেন যে তিনি অজ্ঞাতবাসেই থাকবেন। পাবলিক স্পেসে আর আসবেন না। এই কথাটি আমি আজ থেকে দশ বছর আগে তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম।
স্যারের যে আত্মপ্রত্যয় তাতে আমি সত্যি বিশ্বাস করেছিলাম তাঁকে আর আমরা প্রকাশ্যে পাবো না। বাস্তবেও তাই হলো। আকাশ আর ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম তাঁর সেগুনবাগিচার ফ্ল্যাটে। আমি গিয়েছিলাম স্যারকে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার গ্রহণে রাজি করানোর জন্যে। ইতোমধ্যে আমরা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান ও মোশাররফ হোসেন স্যারকে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার দিতে পেরেছিলাম।
প্রথিতযশা চার অধ্যাপকের মধ্যে তখনও আনিস স্যারকে এই পুরস্কার দিতে পারি নি। আকাশকে বললাম চলো একসঙ্গে চেষ্টা করি রাজী করাতে পারি কিনা। খলিক ভাইকেও অনুরোধ করলাম ঐ সন্ধ্যায় স্যারের বাসায় আসতে। আমি মতিঝিল থেকে অফিস শেষ করে সন্ধ্যেবেলা পৌঁছুলাম স্যারের বাসায়। একেবারে সাদামাটা বাড়ি। এমন কি একজন কাজের মানুষও নেই।
আমি ভয়ে ভয়ে স্যারকে পুরস্কারটি গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলাম। স্যার বললেন “ তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি তা তুমি জানো। কিন্তু আমি এই পুরস্কার নিতে পারবো না। আমি আর জনসম্মুখে যেতে চাই না।” এর পর দুটো বই দেখিয়ে বললেন আমি এই নিয়েই ব্যস্ত। বই দুটো ছিল কি করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার সেই বিষয়ে। এরপর আমরা তিনজনেই আর কোনো কথা না বলে স্যারকে তাঁর মতো করে জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিয়ে বের হয়ে এলাম।
এরপর আর আমার সাহস হয়নি স্যারের সাথে ফের দেখা করার। স্যারকে পুরস্কারটি না দিতে পেরে নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছিলাম। চার তারকা অর্থনীতিবিদের একজনকে তালিকায় যুক্ত না করতে পারার দুঃখ আজও রয়ে গেছে। তবে সে বছর অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ( মরনোত্তর) এবং ড. স্বদেশ বোসকে যৌথভাবে পুরস্কারটি তুলে দিতে পেরেছিলাম বলে দুঃখ খানিকটা হলেও কমেছিল। এরপর তো চলেই এলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে। এমনি ছিলেন আমাদের আনিস স্যার। তিনি তাত্বিক জ্ঞানে যেমন ছিলেন অতুলনীয় তেমনি ছিলেন জীবনঘন শিক্ষা দানে অগ্রগামী।
সত্তরে স্যারকে মাইক্রো অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। প্রায় মাস খানিক ধরে তিনি আমাদের লিমিট ও ডিরাইভেটিভ রপ্ত করিয়েছিলেন। বলতেন এই কনসেপ্টদুটো বুঝলে আধুনিক অর্থনীতি বুঝতে তোমাদের অসুবিধা হবে না। এর আগে তিনি ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ স্থাপন করে অনেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের সূচনালগ্নের গুরুর দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। হার্ভার্ড থেকে তিন বছরের মধ্যেই সংক্ষিপ্ততম পিএইচডি থিসিস ( সম্ভবত ৬৫ পৃষ্ঠার) লিখে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ের আইয়ুব-মোনায়েম ঘেষা উপাচার্যের সাথে বনিবনা না হবার কারণে চাকুরি ছেড়ে দিয়েই চলে যান হনোলুলুর ইষ্ট-ওয়েষ্ট সেনটারে। ইসলামাবাদ হয়ে ফের ফিরে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।এর আগে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তান দারুন বৈষম্যের শিকার। তাই অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, মাযহারুল হক, ড. সাদেক, হাবিবুর রহমানসহ সহকর্মীদের নিয়ে দুই অর্থনীতির ভিত্তি বিশ্লেষণে দারুন তৎপর তিনি। তার পিএইচডি থিসিসও ছিল বৈষম্যের অর্থনীতি নিয়েই।
পাকিস্তানে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলের প্রস্তুতের জন্য গঠিত প্যানেলভুক্ত অর্থনীতিবিদ হিসেবে তারা এমন শোরগোল তুলেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত আলাদা করেই তাদের প্রতিবেদন দিতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদদের সাথে কিছুতেই মতের মিল হচ্ছিল না। তাঁদের এই ভাবনায় পুরো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ছাত্রসমাজ এবং বুদ্ধিজীবী মহল এতোটায় উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত প্রায় সকলেই শেখ মুজিবের ছয়দফার আবেদনে সাড়া দেয়।
বাঙালির মন আলাদা করে স্বদেশ ভাবনায় মগ্ন হতে শুরু করে। তাই যখন পঁচিশে মার্চে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলো তখন আনিস স্যারেরা আক্রান্ত। ক্রল করে করে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েছিলেন মৃত্যুর উপত্যকা পেরিয়ে। মঈদুল হাসান ও মোখলেসুর রহমান সিধু ভাইয়ের সহযোগিতায় তিনি এবং রেহমান সোবহান কোনোমতে সীমান্ত পারি দিয়ে আগরতলা পৌঁছেছিলেন।
পথে অবাঙালি বলে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হস্তক্ষেপে তারা জীবন নিয়েই ওপারে যেতে পেরেছিলেন। আগরতলা থেকে দিল্লি, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের বাড়িতে। তাঁর মাধ্যমেই আরেক অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্রের সাথে পরিচয়। তিনি তখন সরকারে। তাঁর মাধ্যমেই কথা হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপল সেক্রেটারি পিএন হাকসারের সাথে। বাংলাদেশের এই দুই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের সাথে আলাপের পরেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দিন ও এম আমীরুল ইসলামের সাথে মিটিং হয়। আর এভাবেই সূচনা হয় মুজিবনগর সরকারের।
একাত্তরের সতেরই এপ্রিল ঘোষিত হয় আমাদের স্বাধীনতার ঘোষনার মর্মবানী বা প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স। এরপর আমাদের আনিস স্যার ও রেহমান স্যার মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। সেখানে তারা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ মিলে কংগ্রেস ও সিনেটে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। তারই অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তানকে দেয় বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্য বন্ধ করতে সক্ষম হন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। সেখানেও আনিস স্যার সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ী কর্মসূচি, ভূমি সংস্কার এবং স্বেচ্ছাশ্রমে দেশ গড়ার নানা কাজের পক্ষে কথা বলেন। এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই সময়টায় যে কাজ তিনি সরকারে থাকতে পেরে উঠতে পারেন নি তা তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ফের বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন।
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার জিরাবো গ্রামে ছাত্রদের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে ধান চাষের কাজে লেগে পড়েন। দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করার জন্য ছাত্রদের নিয়ে ব্রাম্মনবাড়িয়ার গ্রামে আদর্শ নিয়মে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেন। রংপুরের কুঁজিপুকুর গ্রামে সমবায় কর্মসূচির মাধ্যমে নুর মোহাম্মদ মন্ডল যে অভানীয় শিক্ষা ও উন্নয়ন ঘিরে মানবিক উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
মানুষের পাশে থেকে মানুষের অংশগ্রহনে কী করে সাধারণ মানুষের উন্নতি করা সম্ভব সেই সংগ্রাম তিনি আজীবন করে গেছেন। আইএলও’র অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা কর্মসূচির অধীনে তিনি এশিয়া-আফ্রিকার নানা দেশে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভারতে ‘ভূমিসেনা’ কর্মসূচির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ভূমিসংস্কারের নীরিক্ষা করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ বা রিব গঠনেও ভূমিকা রাখেন। আমাদের সমুন্নয়েও তিনি বসতেন।
আমরা যে অংশগ্রহণমূলক গবেষণার মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিকল্প মানবিক সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করছিলাম তা তিনি আন্তরিক ভাবেই সমর্থন করেছিলেন। আমাদের কাজের ওপর তিনি হলিডেতে একটি লেখাও লিখেছিলেন। ঐ সময়টায় তিনি আমাকে হৃদয় দিয়ে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে বলেছিলেন। ফ্রিটজফ ক্যাপ্রার দু’একটি বই দিয়েছিলেন নতুন চোখে পরিবেশকে দেখতে (ফ্রিটজফ ক্যাপ্রা অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক, পদার্থবিদ , সিস্টেম তত্ত্ববিদ এবং গভীর পরিবেশবিদ। তাঁর অন্যতম গ্রন্থ ‘দ্য ওয়েব অফ লাইফ: এ নিউ সায়েন্টিফিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ লিভিং সিস্টেমস’, ‘হিডেন কানেকশনস’, ‘গ্রিন পলিটিক্স’)। আমরা চেষ্টা করেছি প্রকৃতি ও পরিবেশকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি দেবার জন্য স্যারের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ।
এক সময় তিনি মূলধারার অর্থনীতি চর্চা করতেন। পুঁজিতত্ব, বৈষম্য, প্রযুক্তির পছন্দ— এমন বিষয় নিয়ে বিশ্বসেরা অর্থনীতির জর্নালে লিখতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি সনাতনী অর্থনীতি চর্চা ছেড়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান এবং গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা তাকে বেশি আকৃষ্ট করতে শুর করলো। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তিনি তাঁর মতো করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করতেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি কুষ্টিয়ায় শিয়ালদহে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সম্মেলনে। স্যারও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়েছিলাম। স্যার খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। স্যার শুনতেই বেশি পছন্দ করতেন। বলতে চাইতেন না। পরে অবশ্য আমাকে রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন দর্শন নিয়ে কাজ করে যেতে বলেছেন।
আমি চেষ্টা করেছি স্যার...আপনি এই পৃথিবির আলো বাতাস ছেড়ে চলে গেলেন। আর কে উৎসাহ দেবেন আমাদের এসব সৃজনশীল কাজে?
তবে তিনি তাঁর সৃজনশীল ভাবনার অনেক বীজ বুনে গেছেন বিভিন্ন লেখায়। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা। যাঁকে বলা যায় রেঁনাসাস ব্যক্তিত্ব। একটু জেদি। এক রোখা। কিন্তু মনে প্রাণে মানবদরদী। জন্মে ছিলেন রুপোর চামচ মুখে নিয়ে। কিন্তু আজীবন নিবেদিত থেকেছেন সবহারাদের কল্যাণ ভাবনায়।
শুধু তত্ত্বকথা নয় বাস্তবেও কী করে এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা যায় সেকথা লিখেছেন অন্তর দিয়ে। তার লেখা বইগুলোর কয়েকটির নাম উল্লেখ করলেই বোঝা যায় কী গহীনে ভাবতেন প্রান্তজনের কথা। সেই সব ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই তাঁর লেখা বইতে।
যেমন তিনি রেখে গেছেন আমাদের মনোজগতের উন্মেষের জন্য— ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’, ‘অপহৃত বাংলাদেশ’, ‘পিপলস সেলফ ডেভেলপমেন্ট’, ‘অসীমের স্পন্দন-রবীন্দ্রসংগীত বোধ ও সাধনা’, ‘যে আগুন জ্বলেছিল– মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ’, ‘সংস অফ টেগর, ফিলোসফি, সিলেক্টেড ট্রান্সলেশনস, পেইন্টিংস’, ‘পার্টিসিপেশন অব দি রুরাল পুয়োর ইন ডেভেলপমেন্ট’, ‘মাই স্টোরি অব ১৯৭১’, ‘একুশে ও স্বাধীনতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজবাস্তবতা’, ‘পথে যা পেয়েছি-১’, ‘পথে যা পেয়েছি-২’, ‘দ্য লস্ট মোমেন্ট: ড্রিমস উইথ অ্যা নেশন বর্ন থ্রু ফায়ার’ ইত্যাদি ।
এসব বই শুধু সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির শিক্ষার্থী ও রবীন্দ্রভক্তদের জন্যই যে শুধু মূল্যবান তাই নয়। যে কোনো পাঠককেরই মনকে নাড়া দেবে এসব বই। সমাজ মাধ্যমে বুদ হয়ে পড়ে থাকা তরুণ প্রজন্মের পক্ষে এসব বই খুঁজে বের করা কতোটা সম্ভব হবে আমি জানি না। কিন্তু এসব বইয়ের মাঝেই বেঁচে থাকবেন আমাদের আনিস স্যার।
আমার বড়ই সৌভাগ্য তিনি এবং মীর্জা নুরুল হুদা স্যার সত্তরে আমার সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির জন্য। আমি যেহেতু ঢাকা বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের মধ্যে ছিলাম তাই হুদা স্যার আমাকে পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞানে না গিয়ে অর্থনীতিতে কেন আসবার চেষ্টা করছি সে প্রশ্নটি করেছিলেন। বয়স কম। তবুও বলেছিলাম বিজ্ঞানের ভিত্তি আছে বলেই অর্থনীতিতে ভালো করবো বলে আশা করি।
আনিস স্যার মুচকি মুচকি হাসছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সস্নেহেই অর্থনীতি চর্চা করেছি আজীবন। আনিস স্যার আমাকে অর্থনীতি ও উন্নয়নকে মানবিকতার চোখে দেখতে বলতেন। জানিনা কতোটা পেরেছি তাঁর প্রত্যাশা পূরণ করতে। তবে রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে উন্নয়নকে প্রান্তজনের সখা করার সামান্য হলেও সচেষ্ট থেকেছি সারাটা জীবন। আনিস স্যারের এই বিদায় আমার মনে যে বিপুল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তা সহসাই পূরণ হবার নয়। তাঁর আত্মা শান্তিতে ঘুমাক সেই প্রার্থনাই করছি বিধাতার কাছে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।