করোনায় সচেতন হয়েই কী লাভ তাদের!

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস
  • সাদিয়া কানিজ লিজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস/ছবি: বার্তা২৪.কম

বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস/ছবি: বার্তা২৪.কম

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ভয়ের অন্য নাম। চীন থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, হয়ে বাংলাদেশেও দেখা দিয়েছে এই ভাইরাস। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে দেশে দুজন মারাও গেছেন। সকল ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে করোনার।

দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে এবং করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে সরকারি ভাবে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, সভা-সেমিনার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা সচেতনতামূলক পরামর্শ ও রোগের উপশম সম্পর্কে বার্তা দিতে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এ সচেতনতার বার্তা কি সব শ্রেণির মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে? নাকি এক শ্রেণির মানুষ এখনো অন্ধকারেই রয়েছে!

বিজ্ঞাপন

কাওরান বাজার রেল লাইন বস্তি, প্রায় তিন শতাধিক মানুষের বাস যাদের বেশিরভাগই কাজ করেন মাছের আরতে। বলতে গেলে মাছের আঁশটে, দুর্গন্ধ, মশা, মাছি, পচা-গলা, অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর আর ঘিঞ্জি পরিবেশ যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। করোনাভাইরাস রোধে যে সব সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হচ্ছে তাদের কাছে প্রায় সবই অসম্ভব।

বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস/ছবি: বার্তা২৪.কম 

সবসময় মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখা, কিছুক্ষণ পর হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া, কাপড় পরিষ্কারের পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্নভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এমনকি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এর সবই এখন বস্তিবাসীর জানা কথা। কিন্তু জানলেও মানার উপায় নেই তাদের। পেটের তাগিদে ঘর থেকে বের হতেই হচ্ছে স্বল্প আয়ের এই মানুষদেরকে।

যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা কী করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ কিনে পোষাবেন? তারা যে নোংরা পরিবেশে থাকেন এসব ব্যবহার করেও খুব বেশি কি লাভ হবে!

বস্তির আশপাশের নোংরা পরিবেশ/ছবি: বার্তা২৪.কম 

মো. জাকির হোসেন রেললাইন বস্তির মুদি দোকানি, করোনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অনেকটা বিচক্ষণভাবেই উত্তর দিয়ে বললেন, করোনাভাইরাসের কথা শুনছি। কিন্তু তা নিয়ে আমরা আর কি চিন্তা করমু! যে পরিবেশে আমগো (আমাদের) বসবাস, সমস্ত শরীরে জীবাণু ভরপুর। এখানে মশা, মাছি, নোংরা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ এগুলা নিয়ে সব সময় আমগো বসবাস। এখানে আর কেমনে পরিষ্কার থাকমু! এখন আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি।

মাস্ক ব্যবহারের প্রশ্ন তুললে এই দোকানি বলেন, শুনছি এই রোগের জীবাণু বাতাসের সাথে ঘোরাফেরা করে। আমার মনে হয় না মাস্ক ব্যবহার করে এই রোগের থেকে বাঁচা যাইবো।

বস্তির একটু ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতেই কয়েকজনকে এক সাথে বসে থাকতে দেখা যায় এসময় ভাইরাসের প্রসঙ্গ তুলতেই তারা বলেন, হ হ জানি তো এইডার নাম করোনাভাইরাস। কিন্তু আমরা কি আর পরিষ্কার থাকতে পারমু! অবস্থা তো দেখতাছেন। কে দেখবো আমগোরে (আমাদেরকে)।

বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস/ছবি: বার্তা২৪.কম 

গফুর নামে বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, আমরা মাছ কাটতে কাটতে কোন রকম পানি দিয়া হাত ধুইয়া ভাত খাই। আপনারা বাজারে গেলেই দেখবার পারবেন যারা মাছ কাটে তারা মাছের আঁশইটার হাতেই চুন লইয়া পান খায়। রোগ হ্যাগো (তাদের) হইবো না। বড়লোক মাইনষেরা সাবান দিয়া হাত ওয়াশ কইরা ভাত খায়। রোগ তাগোই হইবো। আমগো বস্তিতে ঢুকতে পারবো না রোগ।

এ সময় তেজগাঁও রেললাইন বস্তির বাসিন্দা নার্গিস বেগম নামে একজন বলেন, বড়লোকের আছে টেকা গরিবের আছে আল্লাহ। দেখতাছেনতো, ডেঙ্গু জ্বরে কত মানুষ মরছে আমগো কিছুই হয়নি। পরক্ষণেই আবার তিনি বলেন, আপা এগুলো তো রাগের কথা, ক্ষোভের কথা, মুখের কথা কইছি কিন্তু সারা দেশের মানুষই তো শুনছি বিপদে আছে রোগ কি আর আটকায় রাখা যাইবো! আমরা তো আরো বেশি বিপদে আছি।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যেসব জিনিস ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে তার কিছুই ব্যবহার করছেন না বস্তিবাসীরা। আগের মতোই তারা চলাফেরা করছেন। নেই সচেতনতার বালাই। হয়তো বাস্তবতা তাদেরকে হার মানতে বাধ্য করছে। রাজধানীর কড়াইল বস্তি, তেজগাঁও, কাওরানবাজার রেললাইন বস্তিসহ কয়েকটি বস্তি ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

নোংরা পরিবেশে শিশুদের বিচরণ/ছবি: বার্তা২৪.কম 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বার্তা ২৪.কম-কে বলেন, বস্তিবাসীর ঝুঁকি তো অবশ্যই বেশি কারণ তারা ঘনবসতি এলাকায় থাকে, নাগরিক সুবিধা বলতে গেলে একেবারেই সর্বনিম্ন পর্যায়ে, পানি সরবরাহও কম। কাজেই বস্তিবাসীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের এখানে যদি সামাজিক সঙ্গরোধ করতে হয় তাহলে তো বেশ কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে।

তাদের জন্য করনীয় কি তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বস্তির আশেপাশেই সঙ্গরোধের এর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বস্তিবাসীরা এখনই একটি গণকমিটি করে যদি খোঁজ খবর নেয় যে তাদের মধ্যে কারো জ্বর বা সর্দি কাশি হয়েছে কিনা বা তাদের সাথে বিদেশ ফেরত কারো যোগাযোগ আছে কিনা, সেই সাথে তরুণ যুবকদের উচিত সচেতনতা তৈরি করা। এখনই তারা একটি গণকমিটি করে সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি করুক। সরকারকে এবং সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি উত্থাপন করলে অবশ্যই সমস্যার সমাধান হবে। এবং এটি এখনই করা উচিত।