‘আবেগের আনন্দলোকে ছিল সাদির বিচরণ’

  • সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সদ্য প্রয়াত সাদি মহম্মদ

সদ্য প্রয়াত সাদি মহম্মদ

আজ একজন সংগীতের নিভৃতচারি রাজাধিরাজ স্বেচ্ছায় প্রয়াত হলেন কন্টকাকীর্ণময় এই পৃথিবী থেকে। তিনি সাদি মহম্মদ। রাবীন্দ্রিক বাতাবরণে অভ্যস্ত এক নন্দিত জীবনের অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। কাব্যিক এই শিল্পীর জীবন ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ, সাবলীল ও সাধারণ। অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠে তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তার গাওয়া ‘আনন্দধারা বহিছে ভুরনে’, ‘কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি’সহ অগণিত কালজয়ী গান তার সুরের মূর্ছনায় পেয়েছে শ্রুতি মধুরতা। তার দরাজ গলায় আবেগাপ্লুত হয় শ্রোতা। একাকিত্বের মাঝেই তিনি সুখের আস্বাদন খুঁজে পেতেন। জীবনে চলার পাথেয় হিসেবে তিনি তার শিল্পীসত্ত্বাকে বেছে নিয়েছিলেন। চলনে, বলনে, বচনে, ভঙ্গিমায় তিনি ছিলেন এক শান্ত স্রোতস্বিনী নদীর মতন। সেই নদীতে শব্দহীন ঢেউ বয়ে যেত অনবরত। রবীন্দ্র সংগীতের সুরের লহরীর এই মহান জাদুকর তার স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে হয়তো খুঁজে পেয়েছেন তার স্বপ্নলোকের চাবি। কিন্তু আমরা হারিয়েছি এক মহান কীর্তিমান সাদি মহম্মদকে। যিনি তার সুরের ফল্গুধারায় সম্মোহিত করে রাখতেন শ্রোতামন্ডলীকে।

গাইছেন সাদি মহম্মদ

চিরবিদায় নিয়েছেন সাদি মহম্মদ। আবেগের আনন্দলোকে ছিল সাদির বিচরণ। সমাজ সংসারে যখন যুগবদলের হাওয়া বইছে ঠিক সেই সময় সাদি মহম্মদ ছিলেন বড্ড সেকেলে। ভালবাসতেন রবি ঠাকুরের সেই চিরায়ত সময়। যে সময়ে মানুষের মনে ছিল না জীর্ণতা। আজন্মকাল মানুষের মনে রবে খুব নীরবে রবীন্দ্রসংগীতের বরপূত্র সাদি মহম্মদকে। রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি ধারণ করেছিলেন তার মন ও মননে। যখন তিনি গাইতেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...’, তখন তিনি কি সত্যি ভেবেছিলেন কোন একদিন সত্যি এই বসুধায় পড়বে না তার পায়ের চিহ্ন? তবে তিনি এই দেশে রেখে গিয়েছেন তার গানের মাধ্যমে প্রিয় পদরেখা। যা দেখে পুলকিত হবে লাখো কোটি রবীন্দ্র সংগীতপ্রেমী।

বিজ্ঞাপন
ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ ও প্রাণপ্রিয় মায়ের সঙ্গে সাদি

তার সুরে ব্যক্ত হতো ব্যাকুলতা। সাদির সুরের মুগ্ধতায় বিমোহিত হতো হাজারো ভক্তশ্রোতা। তার কন্ঠের সুরে যেন প্রাণের স্পন্দন পেতো সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রসংগীতের সুরের ঘোরে সর্বদা আচ্ছন্ন থাকতেন সাদি মহম্মদ। তার দরাজ গলায় রবীন্দ্রসংগীতে গানে মর্মস্পর্শী আবেদন তৈরি হতো তা রবীন্দ্রসংগীতকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়।

সদ্য প্রয়াত সাদি মহম্মদ

একজন শিল্পীসত্ত্বা যে কতটা নিটোল হয় তা সাদি মহম্মদের জীবনাচরণ দেখলে বোঝা যায়। সদা নির্লোভ, নির্মোহ ও নির্ভেজাল মানুষটি হয়তো বেঁচেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংগীতকে বুকে লালন করার জন্য। বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় তার অবদানের কথা ব্যাখ্যাতীত। তিনি আজ আনন্দলোক ও স্বপ্নলোকের চাবি খুজতে পরলোকে চলে গেলেন আমাদের সবার আনন্দঅশ্রু ঝড়িয়ে। বড্ড অভিমানি সাদি বুঝাতে পারেননি কাউকে তার নিশ্চুপ মনের বেদন। যে বেদনে আজ আমরা আবেগাপ্লুত হই তার মৃত্যুর পরে। তিনি গেয়েছিলেন, ‘আনন্দধারা বহিছে ভূবনে...’, সেই আনন্দধারার খোঁজ কি আমরা রেখেছিলাম। হয়তো অন্য ভূবনে তিনি ঠিকই দেখতে পাবেন সেই আনন্দধারা। তিনি আগুনের পরশমনি আমাদের প্রাণে জ্বালিয়ে বেঁচে থাকবেন আজন্মকাল। তাইতো তিনি জীবনের পরিসর পেরিয়ে আজ চলে গেলেন লোকান্তরে। সাদী মোহাম্মদেরা আমাদের এই পৃথিবীতে আসেন দুষ্প্রাপ্য হয়ে। কিন্তু আমরা তাদের দুষ্প্রাপ্যতা চিনতে পারি যখন তাদের চলে যাওয়ার সময় হয়।

ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের সঙ্গে সাদি

পদক আর পুরস্কারের ভারে নয়, রাবীন্দ্রিক ঘরানার এই প্রথিতযশা শিল্পী আজীবন আমাদের স্মৃতির মাঝে অমলিন হয়ে বেচে থাকবেন ভালবাসার পাত্র হয়ে। পৃথিবীর সকল ছায়া, মায়া ও কায়া ত্যাগ করে স্বপ্নলোকের ওপারে ভাল থাকুন আর আমরা এপারে আপনাকে অহর্নিশ ভালবাসে যাব।