মানুষের ভুলে বেড়েছে ট্রেন দুর্ঘটনা

  • তৌফিকুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রেল দুর্ঘটনা থামছেই না, ছবি: সংগৃহীত

রেল দুর্ঘটনা থামছেই না, ছবি: সংগৃহীত

দেশের রেলপথে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বেড়েছে প্রযুক্তিগত উন্নত সুবিধা। তবুও সবচেয়ে নিরাপদ যাত্রা হিসেবে পরিচিত রেল দুর্ঘটনা যেন থামছেই না। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

ট্রেন দুর্ঘটনার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৮৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৪৬ জন মারা গেছেন। ২০১৫ সালে ১২৮টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন মারা গেছেন। ২০১৬ সালের ৯৬টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১২ জন। ২০১৭ সালে ১১০টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১২ জন এবং ২০১৮ সালের ১০৫টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৮ জন।

বিজ্ঞাপন
গত ১০ বছরে ৩ হাজার ৪৮৬টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ট্রেন দুর্ঘটনার নানা কারণ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা, সিগন্যাল অমান্য করা, চলন্ত ট্রেনের বগি আলাদা হয়ে যাওয়া, দুটি ট্রেনের সংঘর্ষ। এছাড়াও ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েও দুর্ঘটনা ঘটেছে।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুটি কারণে ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। একটি হলো ‘ট্রেনের কারিগরি ত্রুটি বা টেকনিক্যাল এরর’। আরেকটি হচ্ছে ‘মানবসৃষ্ট ত্রুটি বা হিউম্যান এরর’।

গত ১০ বছরে তিন হাজার ৪৮৬টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে যেখানে প্রায় ৪০০ যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই হয়েছে হিউম্যান এররে বা মানুষের ভুলে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবার মন্দবাগ স্টেশনে তূর্ণা নিশিতা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তূর্ণা নিশিতা ট্রেনের চালক, সহকারি চালক ও গার্ডকে দায়ী করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ভুলের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে মানুষের ত্রুটি অর্থাৎ হিউম্যান এরর দায়ী।

কারিগরি ত্রুটি ও মানুষের ভুল এই দুই কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা বেশি হয়।

গত ১৪ অক্টোবর নির্ধারিত চালক ছাড়া ট্রেন পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশন থেকে পাবনা স্টেশনে চলে যায়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এতে নির্ধারিত চালক ছিলেন না, চালকের সহকারী ট্রেনটি চালিয়ে নিয়ে যান, ফলে এই ঘটনা ঘটে।

আমরা অনেক সময় ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে দেখি। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারিগরি ত্রুটি বা টেকনিক্যাল এরর-এর কারণে হয়ে থাকে।

গত ২৯ নভেম্বর কমলাপুর স্টেশনে চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা ট্রেনের ‘চ’ বগিতে এসির কানেকশন থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেটি তাৎক্ষণিকভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল বলে ঢাকা ডিভিশনাল ট্রেন কন্ট্রোলার সূত্রে জানা যায়।

চালকের ক্লান্তি ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো চালকের ক্লান্তি। পর্যাপ্ত লোকোমাস্টার না থাকায় বিরতি ছাড়াই একের পর এক ট্রেন চালিয়ে যান লোকো মাস্টাররা। ফলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে অনেক বেশি ক্লান্তি এসে ভর করে শরীরে। এতে করে মনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটে যায় দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ট্রেন একটি টেকনিক্যাল বিষয়। এদিক থেকে ওদিক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। ‘টেকনিক্যাল এরর’ ও ‘হিউম্যান এরর’ দূর করার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা। তাছাড়া যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা যদি সতর্কতা এবং দক্ষতার সঙ্গে ট্রেন পরিচালনা করেন তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবে না।’

ট্রেন দুর্ঘটনায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর সহকারী অধ্যাপক সাইফুল নেওয়াজ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ‘হিউম্যান এরর’। একটা ট্রেন চালানোর সঙ্গে শুধু লোকোমাস্টার জড়িত থাকে তা নয়। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত থাকেন। ট্রেন চালানোর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। আর যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারাও অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। সারা বিশ্বের রেল ব্যবস্থা এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। তাই কোনো রেল লাইনের সমস্যা আছে কিনা তা আধুনিক প্রযুক্তিতে বের করা যায়। কিন্তু আমরা সেদিকে এখনো যাইনি।

তিনি বলেন, ‘হিউম্যান এরর’ দূর করার জন্য আমাদের যে টেকনোলজি প্রয়োজন সেগুলো ব্যবহার করি না। এখনও আন্দাজের উপরে ট্রেন চালানো হয়। ট্রেন চালানোর সঙ্গে যারা জড়িত লোকোমাস্টার থেকে শুরু করে লাইনম্যান তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। এর সঙ্গে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালও তৈরি করতে হবে।’

রেল দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার প্রসঙ্গে বুয়েটের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আমাদের রেল ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি আধুনিক হয়নি। আরো আধুনিকতার প্রয়োজন আছে। ইনফরমেশন সিস্টেমগুলো আগের মতই আছে। তাছাড়া ট্রেনের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি চালকের সংখ্যা।

ট্রেন চালানো একটি টেকনিক্যাল বিষয়। এদিক-ওদিক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

ফলে বিরতি ছাড়াই একের পর এক ট্রেন চালিয়ে যান লোকো মাস্টাররা। এতে করে একসময় ক্লান্ত হয়ে যান তারা। দুর্ঘটনার এটিও একটি কারণ। এছাড়াও লোকোমাস্টাদের এখনো সিগন্যাল দেখেই ট্রেন চালাতে হয়। অনেক সময় কুয়াশার কারণে সিগন্যাল দেখতে পায় না। সুতরাং তাদের সামনে যে প্যানেল বোর্ড আছে সেখানেও যদি লোকমাস্টারকে নোটিশ করে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। সব মিলিয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রেলকে আরো উন্নত করা দরকার।’

এদিকে, আগামী বছর রেলওয়ে থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে যাচ্ছেন। রেল সূত্রে এমনটি জানা গেছে।

এমনতেই রেলে জনবল সংকট। তারওপর এই বিশাল সংখ্যক লোক অবসরে গেলে জনবল সংকট আরো বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে নিয়োগ না হওয়ায় রেলওয়েতে জনবলের সংকট রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে কাজ করা হচ্ছে।