ঋণ দিলেন জালিয়াতি করে, পদে বহাল মাহবুব মোরশেদ

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঋণ দিলেন জালিয়াতি করে, পদে বহাল মাহবুব মোরশেদ

ঋণ দিলেন জালিয়াতি করে, পদে বহাল মাহবুব মোরশেদ

আওয়ামী লীগের সাবেক এক সংসদ সদস্যের ৩টি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে জামানতবিহীন ৪৫ কোটি ঋণ দেওয়ার পরেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (আইবিবি) পিএলসি-র একেএম মাহবুব মোরশেদ এখনো নিজের পদে বহাল রয়েছেন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি)।

তার এ ধরনের কার্যকলাপের ফলে বেড়েছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (আইবিবি) পিএলসি'র প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত মাহবুব মোরশেদ এই ঋণ জালিয়াতিটি করেছেন ব্যাংকের নবাবপুর রোড শাখার ব্যবস্থাপক থাকার সময়। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি এই জালিয়াতিতে জড়ান। জামানতবিহীন ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানটির মালিক কুমিল্লা-৪ আসনের এমপি আবুল কালাম এখন পলাতক। তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের কোনো উদ্যোগও নেই।

ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ৪৫ কোটি টাকা বিধিবহির্ভূত ঋণসহ বর্তমানে প্রায় ১৮৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে আবুল কালাম আজাদ ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ জন্য দায়ী মাহবুব মোর্শেদ।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত এমপি আবুল কালাম আজাদ একজন ধূর্ত, চালাক এবং ব্যাংক লোপাটকারী। নানা কৌশলে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। জামানত না থাকায় এসব ঋণের টাকা এখন আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির শাখা পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।

এসইভিপি একেএম মাহবুব মোরশেদ ব্যাংকটির নবাবপুর রোড শাখার দায়িত্বে থাকার সময়ে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের প্রতিষ্ঠান ঢাকা ব্রিডার্স অ্যান্ড হ্যাচারি লি.কে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া ৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দেন। আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তিনি জামানত না নিয়েই ওই ঋণ বিতরণ করেন। আবুল কালাম আজাদের মালিকানাধীন নামসর্বস্ব কোম্পানি টয়ো ফিড লি., আল আমিন এগ্রোভেট লি., ঢাকা ব্রিডার্স অ্যান্ড হ্যাচারি লি.কে দেওয়া ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগ থেকে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষায় এ ঋণ জালিয়াতি ধরা পড়ার পর বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হলেও তা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।

এর আগেও ইসলামী ব্যাংকটির একই শাখা থেকে টয়ো ফিড লি., আল আমিন এগ্রোভেট লি. এবং ঢাকা ব্রিডার্স অ্যান্ড হ্যাচারি লি. এর নামে ১৯ কোটি ৪ লাখ টাকার ঋণ দেন মাহবুব মোর্শেদ। এর বিপরীতেও প্রধান কার্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেননি তিনি। এ ছাড়া ওই ঋণের বিপরীতে কোনো ধরনের জামানতও নেওয়া হয়নি। একই গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আল আমিন পোলট্রি ফিড এর নামে প্রধান কার্যালয়ের ১০ কোটি টাকার একটি অনুমোদন থাকলেও অন্য ৩টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রদান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ক্ষমতা ও বিধিবহির্ভূত।

বিধি অনুযায়ী টয়ো ফিড লি., আল আমিন এগ্রোভেট লি., ঢাকা ব্রিডার্স অ্যান্ড হ্যাচারি লি. এর নামে একই ব্যাংকের নবাবপুর শাখা থেকে ১১০ কোটি টাকার পূর্বতন ঋণ থাকা অবস্থায় একই গ্রাহকের আর একটি প্রতিষ্ঠান (আল আমিন পোলট্রি ফিড) এর নামে শাখা থেকে কোনো ঋণ অনুমোদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে ব্যাংকের এই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে মাহবুব মোর্শেদ ঋণ দিয়েছেন।

৪৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণকালে আবুল কালাম আজাদকে সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রথমে শতভাগ মার্জিনে (অগ্রিম পরিশোধ) এলসি খোলার অনুমোদন দিলেও মার্জিন (কোনো অর্থ) না নিয়েই উক্ত এলসি খুলে দেন মাহবুব মোরশেদ। মালামাল আসার পর পুরো টাকা আদায় করে ডকুমেন্টস দেওয়ার কথা থাকলেও গ্রাহক থেকে কোনো টাকা না নিয়ে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে মাহবুব মোরশেদ শাখার কর্মকর্তাদের ডকুমেন্টস ছাড় করতে বাধ্য করেন।

এ ছাড়া প্রধান কার্যালয় কর্তৃক আবুল কালাম আজাদের দুটি প্রতিষ্ঠান টয়ো ফিড লি. এর নামে ৫৫ কোটি টাকা এবং আল আমিন এগ্রোভেট লি. এর নামে ১৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদিত হয়। উক্ত ঋণের বিপরীতে ৪৪ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার জমি, দালান ও যন্ত্রপাতি জামানত হিসেবে বন্ধক নেওয়ার কথা থাকলেও একেএম মাহবুব মোরশেদ শুধু ৫ কোটি টাকার সম্পদ বন্ধক নিয়ে ৬৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ঋণ ছাড় করেন।

প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন পত্রের শর্ত ছিল সাউথইস্ট ব্যাংকে এই গ্রাহকের সব দায় শোধ করে সেখানে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি ইসলামী ব্যাংকে বন্ধক নেওয়া হবে যা পরবর্তী সময় আর করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন শাখার কর্মকর্তারা। অথচ ঋণের পুরো টাকা গ্রাহককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে যা বর্তমানে শ্রেণিকৃত অবস্থায় আছে এবং গ্রাহক পলাতক থাকায় তা আদায়ের কোনো সম্ভাবনাও নেই।

অভিযোগে জানা যায়, একেএম মাহবুব মোরশেদ আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রধান কার্যালয়কে না জানিয়ে এসব ঋণের ব্যবস্থা করে দেন। নিয়মানুযায়ী কোনো গ্রাহকের নামে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন না থাকলে ওই গ্রাহককে শাখা কোনো ঋণ অনুমোদন দিতে পারে না। ইতোমধ্যে ব্যাংকের নিজস্ব অডিটে (নিরীক্ষা) বিষয়টি ধরা পড়ে এবং দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে এই মাহবুব মোরশেদ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা বনে গেছেন এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, বোর্ডকে হুমকি এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা চাপা দিতে বাধ্য করেন। ফলে ব্যাংকটির এই বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন।

তারা আরও বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি এবং দুদক তদন্ত করলে উক্ত মাহবুব মোরশেদ-এর আরও অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র বের হয়ে পড়বে। তাই অনতিবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এ কর্মকর্তাসহ জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় আনা উচিত বলে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

এসব অভিযোগের সত্যতা এবং ওই কর্মকর্তার ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিরুল মওলার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।