বায়ু দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রাজধানী

  • শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

শীতকাল মানে শুষ্ক মৌসুম। তবে রাজধানীতে এবার শীত পড়তে না পড়তেই বেড়েছে ধুলার পরিমাণ। এরসঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ু দূষণ। রাজধানী ঢাকায় যে হারে উন্নয়ন কাজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে তাতে দূষণের মাত্রা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। 

অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুর একটার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক অর্থাৎ বায়ুমান সূচক (একিউআই) ঢাকার অবস্থান জানাচ্ছে ১৬৭, যা অস্বাস্থ্যকর। সবশেষ বিকাল তিনটা দিকে ছাড়িয়ে যায় ১৭৪-এ। বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে এ সূচক তৈরি করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, পিএম ২.৫ এর নিরাপদ বা সহনীয় মাত্রা এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে বাংলাদেশে এই মাত্রা ৫০এর নিচে থাকলে সহনীয় হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু, সেই মাত্রা অতিক্রম করেছে আরো আগেই। এই মুহূর্তে পিএম ২.৫ এর মাত্রা রাজধানীতে ১৪৮। যা চরম অস্বাস্থ্যকর।

একিউআই এর র‌্যাঙ্কিং অনুসারে দূষণের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা/ছবি: সুমন শেখ

পিএম ২.৫ হচ্ছে অতিক্ষুদ্র কণা, যা সরাসরি নিঃশ্বাসের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করে। আর পিএম ১০ হচ্ছে ক্ষুদ্র কণা যেগুলো সাধারণত মানুষের নাকের লোমকূপে কিছুটা আটকে যায়। তাই তুলনামূলক পিএম ২.৫ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পিএম ২.৫ এর মাত্রা যত বাড়বে ততই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। এই অতিক্ষুদ্র্র কণার কারণে মানুষের অ্যাজমা, ফুসফুস ক্যানসারসহ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

একিউআই এর র‌্যাঙ্কিং অনুসারে দূষণের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এখানে একিউআই ১৭৪। আর ২০৯ একিউআই নিয়ে শীর্ষে চায়না আর ১৭৬ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে কলকাতা শহর। আর ঢাকার পর নেপালের রাজধানী কাঠমণ্ডুর অবস্থান। সেখানে একিউআই রয়েছে ১৭০।

এবার একটু আসা যাক একিউআই’র পরিমাপ মাত্রা ও স্বাস্থ্য তথ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একিউআই ১৫০-২০০ হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর, ২০০-৩০০হচ্ছে খুব অস্বাস্থ্যকর। আর ৩০০-৫০০ হচ্ছে জরুরি অবস্থা জারি করার মতো।

রাজধানীর বায়ু দূষণ পরিমাপ স্টেশন নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর তিনটি পয়েন্টে সার্বক্ষণিক বায়ু দূষণ স্টেশনে বায়ু পরীক্ষা করা হয়। সেই তিনটি স্টেশন হচ্ছে সংসদ এলাকা, ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং দারুস সালামে।

প্রশ্ন উঠেছে এই যন্ত্র দিয়ে কি শাহবাগ, পল্টন, যাত্রাবাড়ি, বেঁড়িবাঁধের বায়ুর পিএম ২.৫ পাওয়া যাবে? সংসদ এলাকায় এমনিতেই দূষণের হার কম থাকে। তাই পুরো ঢাকায় বায়ুমান সূচক বা বা পিএম ২.৫-এর প্রকৃত মাত্রা আরও ভয়ানক।      

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে রাজধানীর বায়ু দূষণের ৫০ ভাগ হয় ইট ভাটা থেকে, আর ৩০ ভাগ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে। এছাড়া ১০ ভাগ আসে গাড়ির জ্বালানি থেকে। এ ছাড়া আরো ১০ ভাগ হয় শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে।

উন্নয়নের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়/ছবি: সুমন শেখ

রাজধানীর আশপাশে যে সকল ইটভাটা রয়েছে, সেগুলো থেকে দূষিত বায়ু সরাসরি ঢাকার বাতাসের সাথে মিশছে। ফলে ঝুঁকি চরমে পৌঁছাচ্ছে।  বাংলাদেশে ইট পোড়াতে যে মানের কয়লা পোড়ানো হয়, তাতে সালফারের পরিমাণ ৫ শতাংশ, যা থাকার কথা ১ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বায়ু দূষণ বেড়ে যাচ্ছে।  

বায়ু দূষণ নিয়ে সোমবার (২৫ নভেম্বর) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে। রাজধানীর বায়ু দূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা। সেই সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার করণীয় বিষয়ে আলোচনা হবে। এভাবে এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দোষারোপ না করে কীভাবে সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়, সে নিয়ে আলোচনা হবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘সমস্যা আছে বলেই তো আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে। এখানে আমাদের করণীয় কী? আমরা নিয়মিত অভিযান করছি জরিমানা করছি এর চেয়ে বেশি কি করতে পারি? তাই আগামীকাল (সোমবার) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ঠিক হবে কার কী করতে হবে।’

শুষ্ক মৌসুম আসলেই দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়, এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে/ছবি: সুমন শেখ

বায়ু গবেষক ও পরিবেশ অধিদফতরের সিনিয়র কেমিস্ট মোহাম্মদ আব্দুল মোতালিব বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুম আসলেই দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এবারও তাই। তবে এখনো দিল্লির মতো পর্যায়ে যায়নি। যদি সহসাই বৃষ্টি না হয়, তাহলে ‍দূষণ বাড়তে পারে।’

বায়ু দূষণ নিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘এখন কেন আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা? এই সভা কেন দুই মাস আগে হয়নি?  আমাদের ঢাকার চিত্র তো প্রতি বছরই এক রকম। তাহলে আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে ‍দূষণ এই মাত্রায় আসত না। তারপরও যেহেতু বসছে এটা ভাল উদ্যোগ।’

বায়ু দূষণ কমাতে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে যে সকল উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, যারা করছেন, তারা যেন দিনে যতটুকু করতে পারেন ততটুকই রাস্তা কাটেন। একেবারে সব কেটে রাখলে দূষণ বাড়বে। সেবা সংস্থা বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের যে সকল রাস্তা কাটা হচ্ছে, তা যেন কাজ শেষেই কার্পেটিং করা হয়। আর গাড়ি নিয়মিত পরীক্ষা এবং উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা গেলে কমতে পারে বায়ু দূষণ।