উন্নয়ন বঞ্চিত অবহেলিত ফরিদপুর জেলার মানুষের এমনিতেই বিনোদনের জায়গা কম। সাধারণত পরিবার পরিজন নিয়ে তেমন ঘুরতে যাওয়ার জায়গা নেই। তাই বছরে স্থানীয় কয়েকটি মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন জেলার বাসিন্দারা।
বছর জুড়ে যে উৎসবের অপেক্ষায় থাকে তার মধ্যে অন্যতম জসীম পল্লী মেলা। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে অম্বিকাপুরে কবির বাড়ির প্রাঙ্গণে কবির জন্মদিন ১ জানুয়ারি থেকে কুমার নদীর তীরে মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন শুরু হয়। এ বছর কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে এখনো ‘জসীম পল্লী মেলা’ আয়োজনের দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়নি।
মেলার মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে। অনেকে মেলার খবর নিতে আসছে। তবে আদৌ মেলা হবে কি হবে না তা নিয়ে সংশয় ফরিদপুরবাসীর মনে। এখনো মেলার আয়োজন শুরু না হওয়ায় রয়েছে আক্ষেপ।
প্রথমদিকে জসীম মেলার আয়োজনে থাকা লেখক মফিজ ইমাম মিলন বলেন, জসীম পল্লীমেলা ফরিদপুর জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। জসীমউদ্দীনের স্মৃতি স্মরণে আমরা সে সময় কয়েকজন উদ্যোগ নিয়ে মেলা শুরু করি এবং রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে দাওয়াত করে মেলায় নিয়ে আসি। তখন থেকে মেলার গুরুত্ব বেড়ে যায়। পরের বছর থেকে জেলা প্রশাসন জসীম ফাউন্ডেশন এর নামে মেলার আয়োজন শুরু করে।
বিগত ৩৫ বছরে জসীম পল্লী মেলা ফরিদপুরের মানুষের প্রাণের উৎসবে রূপ নিয়েছে। অম্বিকাপুরসহ আশেপাশের মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইয়রে বাপের বাড়ি আসে মেলার উৎসবে। এ বছর মেলার আয়োজন না হলে ফরিদপুরবাসী আনন্দ উৎসব থেকে বঞ্চিত হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, জেলা শহরের বাসিন্দা ফরিদপুরের বাইরে যারা চাকুরি করেন তারাও প্রতিবছর ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন মেলা দেখতে। মেলার ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় ফরিদপুরের আশেপাশের ১০/১৫ জেলার মানুষ এই মেলায় বেড়াতে আসেন। এখনো এই বছর মেলার আয়োজন শুরু হয়নি। মেলা হবে কি না তাও কেউ বলতে পারে না।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্লা বলেন, ৭/১০ দিনের জন্য হলেও জসীম মেলার আয়োজন করার ইচ্ছা ছিল। অল্প সময়ের আয়োজনে স্টল মালিকদের ব্যবসা হবে না বিধায় অল্পদিনের মেলায় তারা অংশ নিতে চান না।
তিনি আরও বলেন, তাছাড়া মেলার আয়োজনের স্থান শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বেগ পেতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতি সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে মেলার আয়োজন আমাদের ভাবনায় নেই।
জসীম উদ্দীন এমনই এক ব্যাক্তিত্ব যিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। গ্রাম বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখের কথা সাহিত্যের পাতায় তুলে ধরে কবি জসীম উদ্দিন পেয়েছিলেন পল্লী কবির খেতাব।
কবির স্মৃতি আর গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে কবির জন্মবার্ষিকী ঘিরে ১৯৯১ সাল থেকে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়ির সামনে অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে কুমার নদের পাড়ে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে প্রথম জসীম মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
তখন মেলার ব্যাপ্তিকাল ছিল মাত্র তিন দিন। পরবর্তীতে মেলার সময়কাল বৃদ্ধি করে সাত, পনেরো এবং এক মাস করা হয়।
২০১৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত আয়োজিত হলেও ২০১৮ সালে কবিপুত্র জামাল আনোয়ারের সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বিরোধের জেরে দু বছর মেলার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া করোনার কারণে আরো দুই বছর মেলা করা যায়নি।
তবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ২০২৩ সাল থেকে জসীম পল্লী মেলা পুনরায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলায় চারু ও কারুপণ্য ছাড়াও আসবাবপত্র ও বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের সামাহার ঘটে।
নির্মল বিনোদনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, গান, নাচ, নাটক, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনা থাকে। শিল্পী সংগঠন বিভিন্ন সংস্কৃতি পরিবেশনায় অংশ নেয়।
এছাড়া মৃত্যুকুপ, পুতুল নাচ, সার্কাস তৈরি পণ্যের স্টল, বিভিন্ন খাবারের স্টল এবং আরও অনেক আকর্ষণীয় দিক থাকে।
১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর শহরতলীর কৈজুরী ইউনিয়নের ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা নিঝুম পাড়া গাঁ তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি জসীম উদ্দীন। কবির বাবার নাম আনছারউদ্দীন, মায়ের নাম আমেনা খাতুন।
কবির শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফরিদপুর শহরের হিতৈষী স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক শেষ করে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিক, ১৯২৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬১ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ছোট বেলা থেকেই কাব্য চর্চা শুরু করেন। কবির ১৪ বছর বয়সে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তৎকালীন কল্লোল পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী। এরপর তার ৪৫টি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া পল্লী কবির অমর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে- নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, এক পয়সার বাঁশি, রাখালী, বালুচর প্রভৃতি।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি (১৯৬৮), ইউনেসকো পুরস্কার (১৯৭৬), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
মৃত্যুরপর কবির স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে তার বাড়ির পাশে অম্বিকাপুরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে প্রায় ৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে দাফন করা হয়।