পবিত্র মেরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

  • মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বায়তুল মোকাদ্দাস, ছবি: সংগৃহীত

বায়তুল মোকাদ্দাস, ছবি: সংগৃহীত

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য প্রত্যেক যুগেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হলেন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ও খাতামুল আম্বিয়া। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল! আমি আপনাকে গোটা বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ -সুরা আল আম্বিয়া : ১০৭

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তকে শক্তিশালী করার জন্য অন্য নবী-রাসূলদের মতো তাকেও দেওয়া হয়েছে অগণিত মুজেজা। তন্মধ্যে মেরাজ অন্যতম। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ২৩ বছরের নবুওয়তি জীবনের অন্যতম অলৌকিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো- এই মেরাজ। মদিনায় হিজরতের আগে মক্কায় অবস্থানকালে ২৬ রজব দিবাগত রাতে তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বাহন বোরাকে চড়ে মেরাজ গমনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন।

বিজ্ঞাপন

তবে মেরাজ কখন সংঘটিত হয় এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। হজরত মুসা ইবনে ওকবা (রা.) থেকে বর্ণিত, মেরাজের ঘটনা হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়। ইমাম নববি ও কুরতুবি (রহ.)-এর মতে, মেরাজের ঘটনা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পর সংঘটিত হয়েছে। ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, মেরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সবগোত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইমাম হরবি (রহ.) বলেন, ইসরা ও মেরাজের ঘটনা রবিউস সানি মাসের ২৭ তারিখ রাতে হিজরতের এক বছর আগে ঘটেছিল। বেশিরভাগ মতে, নবুওয়তের দশম বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখে মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়। ইমাম তিবরানি (রহ.) বলেছেন, যে বছর রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবুওয়ত দেওয়া হয়, সে বছরই মেরাজ সংঘটিত হয়। কারো কারো মতে, হিজরতের ১৬ মাস আগে রমজান মাসে মেরাজ সংঘটিত হয়।

মেরাজ গমন করে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশসহ ইসলামি সমাজ পরিচালনার বিধি-বিধান নিয়ে আসেন।

বিশ্ব মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্ব পালনকর্তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলেন মেরাজ রজনীতে। এ জন্য এ রাতটি প্রত্যেক মুসলমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব মুজেজার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজেজা হলো- মেরাজ। এ রাতে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে সব নবীর ইমাম হয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালিনের আসনে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ফলে এ রাতটি নিঃসন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে।

মেরাজ শব্দটি এসেছে আরবি ‘উরুজুন’ শব্দ থেকে। ‘উরুজুন’ অর্থ ঊর্ধ্বগমন আর মেরাজ অর্থ সিঁড়ি। যেহেতু সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা হয় সে জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঊর্ধ্বগমনকে মেরাজ বলা হয়। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে এক টানা ১২ বছর দাওয়াত দেন মক্কায়। কিন্তু তার দাওয়াতে কিছুসংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলেও অধিকাংশরা লেগে যায় বিরোধিতায়। ধীরে ধীরে বিরোধিতা তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে। নানা রকম অমানবিক নির্যাতন শুরু হয় রাসুলের ওপরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এ সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যান। নিজের প্রিয় হাবিবকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে আল্লাহ নিজ কুদরতে মেরাজের আঞ্জাম দেন। বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে তারই প্রমাণ ঘটে।

এক মুহূর্তে ঘটে যায় মেরাজের ঘটনা। তাফসিরকারকগণ বলেন, চোখের এক পলক সময় ব্যয়িত হয়। বর্ণিত আছে, মেরাজ থেকে ফেরার পর দরজার কড়া নড়তে এবং অজুর পানি গড়াতে দেখেছেন রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ গমনের বর্ণনা এসেছে এভাবে, ‘তিনি সেই পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা যিনি তার স্বীয় বান্দাকে এক রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশকে করেছেন তিনি বরকতময়। যাতে তাকে নিজের কিছু কুদরত দেখান। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুরই শ্রোতা ও দ্রষ্টা।’

২৬ রজব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানি বিনতে আবু তালেবের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ হজরত জিবরাইল (আ.) এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদে হারামে নিয়ে যান। সেখানে তার বুক বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে সিনা মোবারক ধৌত করে শক্তিশালী করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বোরাক নামক এক ঐশী বাহনে করে সশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়ে যান। বোরাক হলো এমন একটি প্রাণী, যা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি আকৃতির একটি জন্তু। তার দুই উরুতে রয়েছে দুটি পাখা। তা দিয়ে সে পেছনের পায়ে ঝাপটা দেয়, আর সামনের দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলে।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মোকাদ্দাসের দরজায় খুঁটির সঙ্গে বোরাকটিকে বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং বায়তুল মোকাদ্দাসে এসে সব নবীর ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বোরাকে চড়ে ঊর্ধ্বে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন। পথিমধ্যে হজরত মুসা (আ.) সহ অনেক নবী-রাসুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সপ্তম আসমানের পর বায়তুল মামুরে গিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.)-কে রেখে তিনি রফরফ নামক আরেকটি ঐশী বাহনে চড়ে বিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন। সেখানে আল্লাহর সঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথোপকথন হয়। আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিধি-বিধান রাসুলকে উপহার দেন। মেরাজ থেকে আসার পর এ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হলে বিনাপ্রশ্নে তা বিশ্বাস করেন হজরত আবু বকর (রা.)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ গমনের বিষয়ে পবিত্র কোরআন-হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ ছাড়া মুফাসসিররাও এ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য প্রমাণাদি পেশ করেছেন।

মেরাজের ঘটনা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো- মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের অসীম ক্ষমতার ওপর নিঃশঙ্কচিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করা। মহান আল্লাহ্ চাইলে সবকিছুই করতে পারেন এবং তার ক্ষমতা অপরিসীম। এই চেতনাকে মাথায় রেখে আল্লাহ্কে ভয় করে সার্বক্ষণিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের চিন্তা করে সব কাজ করা। পাশাপাশি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাকে উপলব্ধি করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজ জীবনের আদর্শ বানানো। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের অস্তিত্ব, জান্নাত, জাহান্নামের মতো বিষয়গুলো যা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান নয়, সেগুলোতে পরিপূর্ণভাবে ঈমান আনা এবং এতে কোনো প্রকার সন্দেহ না রাখা।

পবিত্র মেরাজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান বিশ্বের মজলুম মুসলমানদেরকে কাফেরদের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক: আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক।