মুয়াজ্জিনদের জীবনযুদ্ধ: নেই বেতন কাঠামো, খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে
‘ভাই, কষ্টের কথা কারে কমু। আপনে তবু জিগাইলেন। কেমনে সংসার চালাই, বাড়ির সবাই কেমন আছে? আইজ তুরি কেউ জিগায়ও নাই। মাস শেষে যা পাই, দোকানের বাকি আর চাইল কিনতেই শেষ। বাজার, পোলাপানের খরচ, পোশাক-আশাকের কথা ভাবতেই শরীর দুর্বল অইয়া যায়। ঋণ পরিশোধের ভয়ে কারও কাছে হাত পাতবারও পারি না। বাধ্য অইয়া মাঝে-মধ্যেই রোজা থাকি’- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর সেগুনবাগিচার এক মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ আল আমিন।
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, মালিবাগ ও রামপুরার অন্তত ১৪-১৫টি মসজিদের মুয়াজ্জিনের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনযুদ্ধের করুণ কাহিনির কথা জানা গেছে। এসব মুয়াজ্জিনদের কারও বেতন ১০ হাজার টাকার বেশি নয়। আর বাৎসরিক বোনাস বলতে থোক বরাদ্দ ৫ হাজার টাকা। কেউ আবার একটু বেশি পান। অনেক মুয়াজ্জিনের বেতন আরও কম। অনেক মসজিদ কমিটির লোকজন তাদের সঙ্গে বাড়ির কাজের লোকের মতো আচরণ করেন। অনেকে বাসার বাজার-সদাইও করান। চাকরি হারানোর ভয়ে আপত্তি করতে সাহস পান না সমাজের অবহেলিত এসব সম্মানিত মানুষ।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মুয়াজ্জিনরা যে সম্মানী পান, তা দিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর। তারপরও বাধ্য হয়ে বুকে পাথরচাপা দিয়ে হাসিমুখে প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আজান দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তারা। তাদের সমস্যার কথা কমিটির লোকজনও আমলে নিতে চান না। কমিটির মর্জির ওপর নির্ভর করে চাকরিও।
ঢাকায় ঠিক কতগুলো মসজিদ আছে, এর আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১৬ সালে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে জানান, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ জরিপ ২০০৮ অনুযায়ী ঢাকা শহরের মসজিদের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭৭৬টি। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি। এসব মসজিদের মুয়াজ্জিনদের দেখভালের জন্য কোনো স্বতন্ত্র সংস্থা নেই। তাদের চাকরিবিধি ও বেতন কাঠামো নেই। মসজিদ পরিচালনা কমিটির লোকজনের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল সবকিছু।
চৌধুরীপাড়া বাইতুন নূর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন কারি আবদুর রহমান ২৫ বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। টিনের মসজিদের স্থানে সুরম্য ভবন তৈরি হয়েছে। বর্তমানে তার সম্মানী মাসিক ১২ হাজার টাকা, আর মহল্লার লোকজন তার তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য মুয়াজ্জিনি করি। কী পাইলাম, কী পাইলাম না, তা ভাবি না। জীবনতো চলেই গেলো! মহল্লার লোকজনের মায়ায় আর কোথায় যেতে মন চায় না।’
নাখালাপাড়া মুয়াজ্জিন আবুল বাশার বলেন, ‘আমি যে সম্মানী পাই, তা বলার মতো না। মসজিদের কাছেই দোকান দিয়েছি। তা দিয়াই সংসার চলে।’
আলেম ও লেখক মুফতি আবদুর রব বলেন, ‘মসজিদ পরিচালনা কমিটির লোকজন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন ভাবার সময় পান না। তারা রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় গ্রুপিং, সামাজিক দ্বন্দ্ব আর মসজিদের উন্নয়ন নিয়ে মেতে থাকেন। ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতনের কথা তুললেই নানা সমালোচনা শুরু হয়। এমনকি চাকরিচ্যুতও করেন অনেকে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনানী এলাকার এক ইমাম বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসকেরা ধর্মীয় মূল্যবোধের লোকজনকে অবহেলিত রাখার যে চেষ্টা চালিয়েছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে। ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের সমস্যার কথা শোনা এবং দুঃখের কথা ভাবার কেউ নেই।’
উত্তরার কলেজ শিক্ষক ও এক মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য বজলুর রশিদ খান বলেন, ‘আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের এবং শেষ বিদায় জানাজার সঙ্গী ইমামদের মাসিক আয় খুবই কম। ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যে টাকা সম্মানী পান, তা দিয়ে কোনোভাবে চার সদস্যের সংসার চালানো অসম্ভব। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বেতনের কথা ভাবা উচিত।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক উপপরিচালক বলেন, ‘মসজিদ নির্মাণ, পরিচালনা, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম ও খতিবদের দেখভালের কোনো দায়িত্বই আমাদের কাজের আওতাভুক্ত নয়। তবে ইমামদের জন্য সীমিত আকারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অবশ্য মডেল মসজিদ প্রকল্পের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমের বেতন ওই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। সেখানে ইমামের বেতন ১৫ হাজার, মুয়াজ্জিনের বেতন ১০ হাজার এবং খাদেমের বেতন ৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন কমিটির লোকজনই দিয়ে থাকেন।’
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, ‘ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি বেতন কাঠামো তৈরি করছে। যার কাজ চলমান রয়েছে। কাজ শেষে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নিয়ে গেজেট করা হবে। আর এটি সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ইমামদের জন্য কার্যকর হবে।’
গত ৩১ ডিসেম্বর বরিশাল ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি বরিশাল কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, যেসব মসজিদ বেসরকারিভাবে পরিচালিত তাদেরও আমরা উদ্বুদ্ধ করব। পাশাপাশি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মসজিদের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা প্রস্তাব রেখেছি। একইসঙ্গে তাদের জন্য উৎসব ভাতা দেওয়ার প্রস্তাবও রেখেছি। আশা করি এতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবন মান উন্নত হবে।