বাংলাদেশে জাকাত ব্যবস্থার বাস্তবতা
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মে দান-খয়রাতের গুরুত্ব রয়েছে। তবে ইসলামি দানের একটি বিশেষ খাত জাকাত। এটা ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোরও একটি, যা বিত্তবান মুসলমানদের প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি দানের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত ব্যবস্থা বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে এক আশার আলো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে দারিদ্র্যের হার এখনো বেশ উচ্চ, জাকাতের সঠিক ব্যবহার দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
জাকাতের ধারণা ও তাৎপর্য
ইসলামে জাকাত মানে হলো- সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করা, যা ২.৫% নির্ধারিত। এটি শুধুমাত্র একজন দরিদ্র্য মুসলমানের অধিকার নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরের দুঃস্থদের সাহায্য করার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। জাকাতের মাধ্যমে, ধনী ব্যক্তি তার সম্পদের একটি অংশ গরীব, মিসকিন এবং অন্যান্য অসহায়দের কাছে পৌঁছে দেন, যা সমাজে আর্থিক ভারসাম্য স্থাপন করতে সহায়তা করে। জাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ এবং এটি একজন নেসাবের মালিক মুসলিমের ওপর ফরজ। পবিত্র কোরআন-হাদিসে জাকাতের গুরুত্ব এবং এর নিয়মাবলী নিয়ে বহু বর্ণনা রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের সুরা বাকারার ১১০ নম্বর আয়াতে হুকুম প্রদান করেন, ‘নামাজ কায়েম করো ও তোমরা জাকাত দাও।’ এই আয়াতে নামাজের সঙ্গে জাকাতের আদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন।
পবিত্র কোরআনের সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘জাকাত শুধুমাত্র গরিব, মিসকিন, যাদের হৃদয় ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে, দাসমুক্তির জন্য, ঋণী, আল্লাহর পথে সংগ্রামী এবং সফরে বের হওয়া ব্যক্তিদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত কর্তব্য।’ এই আয়াতে জাকাতের উপকারভোগীদের বর্ণনা করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার মধ্যে পড়েন।
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘সফলকাম মুমিন তারা, যারা বিনয়ের সঙ্গে নামাজ আদায় করে, অর্থহীন কথা ও কান থেকে বিরত থাকে এবং যারা তাদের জাকাত আদায় করে।’ -সুরা আল-মুমিনুন :৪
বর্ণিত আয়াতে জাকাত আদায়ের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ আরও উল্লেখ করেন, ‘হে মুমিনরা! যখন তোমরা আল্লাহর রাসূলের কাছে গোপন কথা বলো, তখন তার আগে কিছুটা দান দাও।’ -সুরা আল-মুজাদিলা : ১২
এটি একটি নির্দেশনা, যেখানে আল্লাহ বলেছেন যে, আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে কথা বলার আগে কিছু দান দেওয়া উচিত।
জাকাত বিষয়ে হাদিসের বর্ণনা
জাকাত বিষয়ে হাদিসে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক বর্ণনা রয়েছে। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জাকাত না দেওয়ার কারণে কোনো ব্যক্তি যদি তার সম্পদ জমা করে রাখে, তবে তার ওপর এই সম্পদের হিসাব নেওয়া হবে।’ -ইবনে মাজাহ : ১/৯৫০
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, জাকাত প্রদান না করলে ওই ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাকাত তোমাদের সম্পদের পবিত্রতা এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের প্রমাণ।’ -সহিহ মুসলিম : ৪
বর্ণিত হাদিসে জাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধারও একটি উপায়। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে সম্প্রদায়ই জাযাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের সংকটে নিপতিত করবেন।’ -তাবারানি
জাকাতের উদ্দেশ্য
জাকাতের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ গরিব ও অভাবী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন, যা সমাজে অর্থনৈতিক সমতা এবং আর্থিক স্বস্থি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক। এটি একদিকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক, অন্যদিকে দীন-দুনিয়ার উন্নতির মাধ্যম।
বাংলাদেশে জাকাত ব্যবস্থার বাস্তবতা
বাংলাদেশ, যে দেশটি জন্ম থেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে; এখানে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে সন্নিহিত প্রায় ২০-২৫ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তাদের জন্য জাকাতের আহরিত অর্থ-সম্পদ সঠিকভাবে বিতরণ হলে এটি তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ জাকাত ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর জাকাত সংগ্রহ করে তা উপযুক্তভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করে থাকে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করছে। যদিও দেশে জাকাত সংগ্রহের ব্যবস্থা ও সঠিক বিতরণে কিছু সমস্যা রয়েছে, তবুও এর মাধ্যমে অনেক দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে।
জাকাতের প্রভাব
জাকাতের সঠিক প্রয়োগ একটি শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে। এটি শুধুমাত্র গরিবের সহায়তা নয়, বরং সমাজে ন্যায্যতা, সহানুভূতি এবং সমবেদনা তৈরি করে। মুসলিম সমাজে জাকাতের মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান ও সামাজিক দূরত্ব কমে আসে এবং একটি সদ্ব্যবহার ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে আর্থিক বৈষম্য অত্যন্ত তীব্র, জাকাতের মাধ্যমে এই বৈষম্য কিছুটা কমানো সম্ভব।
জাকাতের আধুনিক ব্যবস্থাপনা
বর্তমানে বাংলাদেশের জাকাত ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ এবং বিতরণ করা হচ্ছে, যা এর সঠিক বিতরণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট, মাদরাসাসমূহ এবং এনজিওগুলো এ বিষয়ে কাজ করছে। সরকারের সহযোগিতায় এগুলো আরও সম্প্রসারিত হতে পারে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জাকাত বোর্ডের উদ্যোগে জাকাত ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তত্ত্বাবধানে ‘মোবাইল গেইম ও এ্যাপ্লিকেশন এর দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়েছে। https://ezakat.gov.bd/ এই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত জানা যাবে। এ এ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে জাকাত প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তার রশিদ ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। যা জাকাত প্রদানকারী তাৎক্ষণিক নিতে পারবেন।
জাকাত এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে খুব সহজেই স্বল্পসময়ে ঘরে বসে অনলাইনে জাকাত প্রদান করা যাবে। দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রবাসীরাও এই এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে জাকাত প্রদান করতে পারবেন। জাকাত ফান্ড পরিচালনা পদ্ধতি ও নীতিমালা, জাকাত প্রদানের নিয়মাবলী, জাকাতের নেসাব, জাকাত সংগ্রহ ও বন্টন নীতিমালা, জাকাত বন্টনের নির্ধারিত খাত, জাকাত গণনার নিয়মসহ জাকাত সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য এই এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে জানা যাবে।
ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে জাকাত অন্যতম। স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। পরিকল্পিতভাবে জাকাত প্রদান করলে সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র এবং বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত হবে।
তাই, দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরের সব ব্যবসায়ী শিল্পপতি ও বিত্তবান মুসলিমকে দুঃস্থ ও অসহায় মুসলিমদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত এ্যাপ ব্যবহার করে জাকাত প্রদানের জন্য সরকারি জাকাত বোর্ডের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সরকারি জাকাত ফান্ডে জাকাত প্রদানকারীর অর্থ সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত। সরকারি জাকাত বোর্ডে জাকাতের অর্থ-প্রদান করে যে রশিদ বা সনদ পাওয়া যায় তা-ই আয়কর রিটার্নের সঙ্গে জমা দিলে এই পরিমাণ কর মওকুফ হয়।
ইসলামে জাকাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মতো একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশে, জাকাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় বাংলাদেশে জাকাত ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব। যদি এ ব্যবস্থাপনা আরও সুসংগঠিত ও কার্যকরী হয়, তাহলে বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূর হয়ে দেশ সমৃদ্ধ হতে বেশি দিন প্রয়োজন হবে না।
লেখক: মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ)।
[email protected]