ক্লোরোকুইন ওষুধে কি করোনা নিরাময় সম্ভব?

  করোনা ভাইরাস
  • ফাতিমা তুজ জোহরা, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। গোটা বিশ্ব এখন এ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পেছনে ছুটছে। সংকটকালীন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনসহ বেশকিছু দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ ক্লোরোকুইন (সিকিউ) করোনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) ও ক্লোরোকুইন (সিকিউ) জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বেড়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন আসে ক্লোরোকুইন আসলে করোনা মোকাবিলায় কতটা উপযোগী।

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪.কমের পাঠকদের জন্য ক্লোরোকুইন ওষুধ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য ও গবেষণা তুলে ধরা হলো—

ক্লোরোকুইন মূলত ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ওষুধ মূলত সিনচোনা নামক গাছ থেকে তৈরি হয়। ক্লোরোকুইন অন্ত্রের বাইরে ঘটছে এমন অ্যামোনিয়ার সংক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এ ওষুধ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাসের মতো রোগে প্রদাহবিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

চীনে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে বিস্তার করার পর রোগীদেরকে এ ওষুধ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ফ্রান্সেও এর ব্যবহার হয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্লোরোকুইনকে 'ঈশ্বরের উপহার' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এটার ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করেন।

ক্লোরোকুইন করোনা প্রতিরোধে কতটুকু ভূমিকা রাখে

চীনের চিকিৎসকরা বলছেন, চীন ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩৪ জন রোগীর পরীক্ষার জন্য ক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি রোগীদের অসুস্থতার তীব্রতা কমাতে কার্যকর ছিল। তবে এই ফলাফল এখনও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

সরকারি টাস্কফোর্সের নেতৃত্বদানকারী চীনা শ্বাস-প্রশ্বাস বিশেষজ্ঞ ঝং নানশান গত সপ্তাহে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এ সংক্রান্ত ইতিবাচক প্রতিবেদনগুলো দ্রুত সর্বত্র প্রচার করা হবে।

ফ্রান্সে ডিডিয়ার রাউল্টের নেতৃত্বে আইএইচইউ-মেডট্রিয়ানি ইনফেকশনের একটি দল, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তারা ৩৩ জন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। সেখানে তারা জানতে পারে, ক্লোরোকুইন গ্রহণকারী রোগীদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ এসব রোগীরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটি অ্যাজিথ্রোমাইসিনের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল। যা সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক যা গৌণ ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ দমনে ব্যবহৃত হয়।

ক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ ও সিকিউ) ওষুধ ল্যাবের পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম প্রমাণিত হয়েছে। সেল ডিসকভারি নামে এক সংবাদমাধ্যম জানায়, গত সপ্তাহে একটি চীনা গবেষণা দলের প্রকাশিত গবেষণায় এর ইতিবাচক কার্যকারিতার কথা জানানো হয়েছে।

এ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারসাইডের কোষ জীববিজ্ঞানের প্রফেসর কারিন লে রোচ এক ব্যাখ্যায় বলেন, এইচসিকিউ ও সিকিউ দুটোই দুর্বল ঘাঁটি, যা মানুষের কোষের অংশের পিএইচ উন্নত করে যাকে অর্গানেলস বলা হয় যা প্রাণীদেহের অঙ্গগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ও অ্যাসিডযুক্ত।

বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে— এ ওষুধ অন্য কোষগুলোতে প্রবেশে ভাইরাসের ক্ষমতাকে হ্রাস করে। শরীরে প্রবেশের পর অন্যকোষে প্রতিরূপ হতে বাধা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের প্রধান অ্যান্থনি ফাওসি সংবাদসসংস্থা এএফপি-কে বলেন, যদিও এ ওষুধ ভিট্রোতে (অণুজীব, কোষ বা জৈবিক অণু দিয়ে সম্পাদিত) কাজ করেছিল। আমি এখনও ভিট্রোতে ক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা দেখতে বৃহৎ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর ফলাফলের অপেক্ষা করছি।

একইসঙ্গে চীনের এক গবেষণা দেখিয়েছে, শুধুমাত্র ক্লোরোকুইন ব্যবহারের থেকে শারীরিক বিশ্রাম বেশি জরুরি। শারীরিক বিশ্রাম বলতে— ঘুম ও তরল খাবারের ওপর জোর দিয়েছে এ গবেষণা। ক্লোরোকুইন আসলে করোনা নিরাময়ে কতটা উপযোগী তা জানার জন্য প্রয়োজন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাগুলো অব্যাহত রাখা। কারণ এ ওষুধের ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের প্রাক্তন কমিশনার পিটার পিটস এএফপিকে বলেছেন, ক্লোরোকুইনের ব্যাপক ব্যবহার এমন ফল আনতে পারে যেখানে এ ওষুধের ঘটতি দেখা দিতে পারে। ফলে সাধারণ রোগীরা এ ওষুধ পেতে সংকটে পড়তে পারেন। 

এর ধারাবাহিকতায় কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। যেমন: স্পেন 'বিজ্ঞপ্তি না হওয়া পর্যন্ত' বাত ও লুপাস রোগীদের মধ্যে ক্লোরোকুইন ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভিয়ার ভেরান ইতোমধ্যে বলেছেন, কেবল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের গুরুতর পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য ক্লোরোকুইন ব্যবহার করা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকের জেনেটিক কার্ডিওলজিস্ট মাইকেল অ্যাকারম্যান এএফপিকে বলেন, হার্টের সমস্যার কারণে প্রায় এক শতাংশ মানুষ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আকস্মিক মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। সুতরাং মেডিকেল দলগুলোকে এ ওষুধ ব্যবহারের আগে তাদের ঝুঁকি বিশ্লেষণকে অবহিত করতে ইলেক্ট্রো-কার্ডিওগ্রাম করাতে হবে।

এর আরেকটি সমস্যা হলো রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নিজে থেকে এ ওষুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে একজন রোগী এ ওষুধ খেয়ে মারাও গিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ ক্লোরোকুইনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। এজন্য গবেষকরা বার বার ক্লোরোকুইন ব্যবহারের জন্য সতর্ক করেছেন। মোটকথা পরামর্শ ছাড়া এ ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট