চৈতালির কদর কমেছে, তবে কুমড়ায়ই সমৃদ্ধি আড়িয়ল বিলে

  • রাজু আহম্মেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

চৈতালির কদর কমেছে, তবে কুমড়ায়ই সমৃদ্ধি আড়িয়ল বিলে

চৈতালির কদর কমেছে, তবে কুমড়ায়ই সমৃদ্ধি আড়িয়ল বিলে

দিগন্ত জোড়া সবুজের বুক চিরে টলটলে পানির অপ্রশস্ত খাল। সে খালে ইঞ্জিনবোটের ফটফট শোনা যায় সারা দিনমান। যেনো সে শব্দেই জেগে থাকে আড়িয়ল বিল। কিন্তু কৃত্রিম সে শব্দকে উপেক্ষা করে এখানে ঋতুভিত্তিক সৌন্দর্য ফুটে থাকে। প্রকৃতি ধরা দেয় তার আপন চেহারায়। বিলের শো-শো বাতাস , শীতে পত্র-পল্লবহীন গাছেও পাখিদের কিচিরমিচির আর আর্দ্র মাটির বুকে সবুজে আবরণ প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার সাধ জাগায়। বিল জুড়ে জালের মতো ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট খাল। শীতে এই খালগুলোই বিলের আশীর্বাদ। বর্ষায় খালগুলো মিইয়ে যায় পানির তোড়ে। তখন বিল জুড়ে থৈ থৈ জল। কিন্তু শীত আর শুষ্ক মৌসুমে এই খালই ভরসা। খালই বিলের প্রাণ।

বিজ্ঞাপন

মুন্সিগঞ্জ জেলার ৯৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়েই এই আড়িয়ল বিল। যার দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটারের বেশি এবং প্রস্থ প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। একদিকে পদ্মা নদী অন্যদিকে ধলেশ্বরী। তারই মাঝখানে এক বিপুল অবভূমি এই বিল। আড়িয়ল বিল। দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রাচীন জলাশয়। বর্ষায় বিশাল এই বিল পানিতে থাকে টইটুম্বর। শীতকালে এটি হয়ে ওঠে শীর্ণ-শুষ্ক। বিল রূপ নেয় ফসলের মাঠে। যতদূর দেখা যায় দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ শস্য খেত। প্রধানত ধান, সরিষা আর কুমড়ার চাষ হয় এই বিলে।

আড়িয়ল বিলের মাঠ থেকেই তোলা হয় বিপুলাকায় সব কুমড়া। বলা হয়, এই বিলের কুমড়ার আকারই সবচেয়ে বড়। এমনও শোনা গেছে একেকটি কুমড়ার ওজন ৪ মণেরও বেশি বেশি হয় এখানে।

বিজ্ঞাপন

বর্ষায় বিল ভরা মাছ , শুষ্ক মৌসুমে কুমড়া, শসা, আর নানা জাতের সবজি। আর হয় ধানের চাষ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক ভাণ্ডার এই বিল। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট আড়িয়ল বিলে ভাগ্য গড়ে, জীবিকা চলে এখানকার লক্ষ মানুষের।


এই যেমন মোহাম্মদ সেলিম। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে শুষ্ক মৌসুমে আড়িয়ল বিলে চাষ ফেলেন তিনি। কুমড়ার চাষ করে নিজের ভাগ্য বদলেছেন। সন্তানদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে এখনো বিলের কাদা গায়ে মেখে দিনভর খাটেন তিনি।

মোহাম্মদ সেলিমের মত আরেক কৃষক নুরুল ইসলাম। বংশ পরম্পরায় এ বিলের পানি ও মাটির সাথে তার সকল সখ্য। এখানে চাষ করে অভাব ঘুচেছে সংসারে। বিদেশ পাঠিয়েছেন দুই সন্তান।

সেলিম ও নূরুল ইসলামের মতো আরও অনেক কৃষকের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন প্রত্যেকের ভাগ্য বদলের পিছনে আছে প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট আড়িয়ল বিল। বিশেষ করে এ বিলে চাষ করা কুমড়াই এসব মানুষের ভাগ্য বদলের রহস্য।

মো. সেলিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, "বোঝার বয়স থেকে আড়িয়াল বিলে খাইটা খাই। দাদা করে গেছেন , বাবা করেছেন, এখন আমি করি। সেই একই কাজ- কুমড়ার চাষ করি। এবারও আল্লাহর রহমতে ২-৩ লাখ টাকার কুমড়া বেচমু। লাউ আছে কিছু জমিতে। সেগুলো উঠামু।"

এবার একটু দাম কম এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, "দিন দিন ফলনও কমতেছে। তবে তাও যা ফলে সংসার চইলা যায়। ছেলে মেয়ে বড় হইছে। যা হয় দু:খ নাই । ভালোই চলছে।"


নুরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকে এ বিলে পইড়া আছি। "এবার কানি পাঁচেক জমিন চাষ করছি ইরি ধান। ৪-৫শ মন ধান আল্লাহ দিতে পারে। কুমড়া বেচমু কয়েক লাখ টাকার । আমার পরিবারে ছেলে মেয়ে আমরা দুইজন নাতি নাতনি মিলে ১২ জন। সবার খরচ এই চাষ থেকে চলে। পোলারা দেশের বাইরে গেছে । আল্লাহ দিলে ভালোই চলে।

আরেক কৃষক আব্দুল গনি জানালেন, এই বিলে তাদের ভাগ্য বদলেছে । "বর্ষায় মাছ, শুষ্ক মৌসুমে ধান, সরিষা, কুমড়ার চাষ আমাদের ভাগ্য বদল করেছে ।"

কয়েক লাখ মানুষ এই বিলে খেটে বাচে। এই অঞ্চলের মানুষ আগে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করত। বিল পারি দিয়ে দিনে অন্যত্র কাজে যেত আর অনেক রাতে ফিরে আসত বাড়ি। কিন্তু অনেকের জন্যই এখন সেই দিন গত হয়েছে। এই বিলে চাষাবাদ ও তা থেকে উৎপাদন হওয়ার পর থেকে এখন অনেকেরই জীবনে সচ্ছলতা এসেছে । বিলে চাষাবাদ করে আয় করা অর্থে অনেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন সন্তানদের। আর সেই বিদেশ থেকে আসা অর্থে তাদের বড় বড় ব্যবসা হয়েছে। বড় বড় বাড়ি হয়েছে।

"কুমড়া মানুষের দুঃখ ঘুচাইছে এখন আল্লাহ দিলে অনেক চাষ হয়। নতুন করে শাপলা চাষ হচ্ছে। তাতেও অনেক মানুষের বেকারত্ব ঘুচেছে। জীবিকা হয়েছে। আমরা আরিয়াল বিলকে আশির্বাদ মনে করি," বলেন আব্দুল গনি।


চাষপদ্ধতি নিয়ে জানতে চাইলে চাষিরা জানান, বর্ষা মৌসুমে টইটুম্বুর পানিতে আড়িয়াল বিল দখল করে কচুরিপানা। পানি কমলে সেই কচুরিপানা দিয়েই তারা ভিটা তৈরি করেন। এমন একেকটি ভিটা তৈরিতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা । পরে রোদের তাপে কচুরি পানা পচে শুকিয়ে মিশে যায় মাটির সাথে। ততদিনে ভাদ্র মাস হাতছানি দেয় প্রকৃতিতে। মিষ্টি রোদের ঝলমলে পরিবেশে কুমড়ার বীজ বোনা হয়। শুরু হয় ভাদ্র থেকেই। শেষ হয় কার্তিক মাসে।

কেউ কেউ শোনালেন সবচেয়ে বড় কুমড়ার জাত চৈতালির কথা। বললেন, আড়িয়ল বিলে একসময় শুধু চৈতালি জাতের বড় আকারের কুমড়ার চাষই হতো। তবে এত বড় কুমড়া খুচরা বাজারে বিক্রি অপেক্ষাকৃত দুষ্কর। এ কারণে ব্যবসায়িক মন্দা দেখা যেতো। তাছাড়া রয়েছে ইঁদুরের উৎপাত। একটি বড় কুমড়া ইঁদুর কাটলে গোটাটাই নষ্ট। এসব কারণে চৈতালীর কদর এখন কিছুটা কম। এখন বিভিন্ন জাতের কুমড়ার চাষ হয় এখানে। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের কুমড়া চাষে আগ্রহ বেশি কৃষকদের। কারণ এর ফলন বেশি।

ইন্দোনেশিয়ান বেঙ্গল টু ,মল্লিকা-১, লাল তীরসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের কুমড়ার বীজ বপন করেন কৃষকরা। ঢাকার সিদ্দিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় বীজ। কার্তিক মাসে বীজ বপণের পর থেকেই শুরু হয় পরিচর্যা। এরপর বীজ ফুটে গাছ হয়। বাড়তি পরিচর্যায় গাছ বড় হতে থাকে। আর পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত গাছগুলোয় কুমড়া ফলতে থাকে। যা বাজারজাত করা হয়। আড়িয়ল বিলের কুমড়ার কদর আছে ক্রেতাদের কাছে। তাই নামেও চলে অনেক কুমড়া। আর স্বাদেও তা সেরা।

ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেউ কেউ এখনো বাণিজ্যিকভাবে চৈতালির চাষ করেন । সৌখিন চাষীরাই বেশি করেন। তবে সে সংখ্যা এখন অনেক কম।


বাজারজাত করারও রয়েছে বিশেষ কৌশল। বিস্তৃত খেত থেকে কুমড়া কেটে নৌকা করে খাল বেয়ে নেওয়া হয় বিলের ঘাটে। সেখান থেকে ছোট বড় নৌকার ওপরেই গাদি ঘাটে সাজানো হয় কুমড়ার পসরা। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে তা নিলামে উঠে। দর হাঁকে কৃষক। দর কষাকষির এক পর্যায়ে নির্ধারণ হয় কুমড়ার কাদির দাম। এর পর ট্রাকে উঠানো হয় কুমড়া। শুরু হয় কুমড়ার বাণিজ্যিক যাত্রা। আগে ঢাকার শ্যামবাজারে কুমড়া গুলো বিক্রি হলেও এখন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কেজি হিসেবে বিক্রি হয় ।

জোবায়ের মোল্লা নামের একজন কৃষক জানালেন, আগে কুমড়া বাজারজাত করতে শুধু নদী পথ ব্যবহার হতো। ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে কুমড়া উঠিয়ে নেওয়া হতো গাদি ঘাটে। সেখান থেকে আবার নদী পথে শ্যামবাজার যেত। এরপর দেশের বিভিন্ন বাজারে মিলত আড়িয়াল বিলের কুমড়া।

এক দিকে যেমন কদর কমেছে চৈতালি জাতের কুমড়ার । অন্যদিকে সক্ষমতাও কমেছে আড়িয়ল বিলের চাষাবাদের। তা ছাড়া খণনের অভাবে বিলের খালগুলোও হয়ে পড়ে পানিশুণ্য। কৃষকদের অভিযোগ, রাস্তাঘাট না থাকায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পণ্য আনা নেওয়া করতে হয়। এতে ভোগান্তির শেষ নেই। এছাড়া কৃষি অধিদফতরের আওতাধীন সুযোগ সুবিধাও পান না এখানকার কৃষকরা।

গাদি ঘাট এলাকায় কথা হয় কৃষক আবু বক্করের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা বারো মাসই কষ্ট করি। মোবাইলে অনেক খবর দেখি সহযোগিতা পায় সবাই। আমরা তো পাইনা । এখানে রাস্তা না থাকায় আমাদের চলাচলে কষ্ট। ধান কুমড়া আনা নেওয়ায় অনেক কষ্ট করতে হয়। আমাদের দাবি এখানে উন্নত প্রযুক্তি আসুক খাল গুলো খনন করা হোক ।

একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের দেখা যায় না এ দিকে। কোন সহযোগিতা পাই না আমরা। বিলের কৃষিভিত্তিক আধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানালেন তিনি।