বায়ুদূষিত ঢাকা, দিল্লি, লাহোরের পাশে ঝকঝকে ইন্দোর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখলের জন্য নিয়মিত লড়াই চালিয়েই যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশের তিন শহর। মোটামুটি ভাবে প্রথম আসনটি বাংলাদেশের ঢাকা, ভারতের দিল্লি কিংবা পাকিস্তানের লাহোরের কব্জায় থাকছে পাকাপাকিভাবেই। বাতাসের মান সূচক (একিউআই) এই তিন শহরের ক্ষেত্রে এতোটাই খারাপ ও নাজুক যে, বায়ুদূষণের শীর্ষ স্থানটি সচরাচর অন্য কোনও শহর ছিনিয়ে নিতে পারছে না। কিংবা বলা যায়, বিশ্বের অন্য কোনও শহরই নিজের চরম অধঃপতন ও অবক্ষয় ঘটিয়ে বায়ুদূষণের শীর্ষ স্থানটি পেতেও চায় না। আমরা কিন্তু লজ্জাজনক প্রথম স্থানটি অন্য কাউকে নিতেই দিচ্ছি না।

অথচ মুঘল রাজধানীর উদ্যানময় ঢাকা, দিলওয়ালাদের শহর দিল্লি আর খানাপিনা-গজল-কাওয়ালির আড্ডা লাহোর দূষিত নয়, হওয়ার কথা ছিল রুচি, সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের শহর। যেমনভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষিত ঢাকা, দিল্লি, লাহোরের পাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে ইন্দোর শহর।

বিজ্ঞাপন

দূষিত শহর নিয়ে এতো আলোচনা হয় যে, সচরাচর মানুষ সুন্দর, স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন শহরের কথা জানেই না। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন শহরের নাম জানতে চাইলে অনেকেই দক্ষিণ ভারতের শহরগুলোর দিকে তাকাতে চাইবেন। কিন্তু বাস্তবে এমন শহরটি হলো মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর। স্বচ্ছতার নিরিখে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ইন্দোর। তবে একবার নয়, একেবারে পরপর সাত বছর ইন্দোর পরিচ্ছন্ন শহরের তকমা জিতে চলেছে।

ইন্ডিয়া স্মার্ট সিটিস অ্যাওয়ার্ড কনটেস্ট ২০২২-এ ইন্দোর ১২টা ক্যাটাগরিতে ৬টাতে জয় পেয়েছিল। ন্যাশানাল স্মার্ট সিটি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল এই শহর এবং গোবর্ধন বায়ো সিএনজি প্ল্যান্টে একেবারে শীর্ষে ছিল। শহর এলাকার সামগ্রিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতেও একেবারে ওপরের দিকে রয়েছে ইন্দোর। সিটি লাইফ লাইন প্রজেক্টের সফল রূপায়নও হয়েছে ইন্দোরে। এই শহর বৃষ্টির জলে চাষ আবাদ, ওয়াটার প্লাস, ওয়াটার সারপ্লাস প্রকল্পেও একেবারে ফাটাফাটি সাফল্য পেয়েছে। হ্রদ, জলাধারের জলও এখানে অত্যন্ত উন্নত ধরনের। সেই সঙ্গেই আরও তিনটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেমন নদী সংলগ্ন এলাকার পরিচ্ছন্নতা, অর্থনৈতিক দিক থেকে ও কোভিডের সময় সার্বিকভাবে মোকাবিলার ক্ষেত্রেও এগিয়ে ছিল ইন্দোর, যার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি শহর হলো গুজরাতের সুরাট।

বিজ্ঞাপন

পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে শহরের আসন পাকা করতে ইন্দোরে স্মার্ট সিটি প্রকল্পগুলো সফল রূপায়ণের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। পাশাপাশি ‘গ্রিন বন্ড‘ ইস্যু করা হয়, যাতে শয়ে শয়ে স্ট্রিট ফুডের ভেন্ডার আর ভোক্তা-নাগরিক সমাজও উপকৃত হয়েছেন। ফলে বিশ্বের নানা শহরে সবাই মিলে যখন শহরকে নষ্ট, অপরিচ্ছন্ন, নোংরা ও দূষিত করছেন, ইন্দোর শহরকে তখন সবাই মিলে পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখছেন। এ কারণেই ইন্দোর একমাত্র ভারতীয় শহর, যা আন্তর্জাতিক ক্লিন এয়ার ক্যাটালিস্ট প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ইন্দোর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং মধ্য প্রদেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সহযোগিতায় প্রকল্পটি শহরের বাতাসকে বিশুদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে।

ইন্দোর ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল ও বৃহত্তম শহর এবং একটি বড় শিক্ষা কেন্দ্র। একমাত্র ইন্দোর ছাড়া ভারতের অন্য কোনও শহরে আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি) এবং আইআইএম (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট) এই উভয় বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের শাখা নেই। মালওয়া মালভূমির দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ৫৫৩ মিটার (১,৮১৪ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ভোপাল থেকে ১৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

ঐতিহাসিকভাবে ইন্দোর ষোড়শ শতাব্দীতে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে প্রসিদ্ধ ছিল। ঔপনিবেশিক আমলে ইন্দোর ব্রিটিশ সেন্ট্রাল এজেন্সির সদর দপ্তর ছিল। ইন্দোরে ১৮৭৫ সালে রেলওয়ে, ১৯০৬ সালে বৈদ্যুতিক সরবরাহ, ১৯০৯ সালে ফায়ার ব্রিগেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ সালে শহরের প্রথম মাস্টার-প্ল্যানটি বিখ্যাত স্থপতি ও শহর পরিকল্পনাবিদ প্যাট্রিক গেডেস তৈরি করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে মধ্য ভারত প্রদেশ গঠিত হলে ইন্দোর গ্রীষ্মকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায়। তবে, ১ নভেম্বর ১৯৫৬ সালে মধ্য ভারত থেকে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে হলে রাজধানী ইন্দোর থেকে ভোপালে স্থানান্তরিত হয়। দেশভাগের কারণে ইন্দোরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানি হিন্দু অভিবাসী বাস করে, যাদের অধিকাংশই জাতিতে সিন্ধি জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং পেশায় ব্যবসায়ী।

নর্মদা নদী তীরের ইন্দোর খাদ্য সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এতে মহারাষ্ট্রীয়, মালউই, রাজস্থানী এবং গুজরাতি প্রভাবের মিশ্রণ রয়েছে। শহরের রাস্তার খাবার বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ইন্দোরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি রাস্তার খাবারের জায়গা হল চাপান দোকান এবং সারাফা বাজার । স্মার্ট সিটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে চাপান দোকান এলাকাকে একটি স্মার্ট ফুড স্ট্রিট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্য দিকে, সারাফা বাজার হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাতের খাবারের বাজার। পুরো শহর থেকেই এখানে প্রচুর ভিড় হয় এবং বিভিন্ন স্থানের পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

ইন্দোর বিভিন্ন ধরনের নামকিন বা সুস্বাদু আইটেমের জন্যও উল্লেখযোগ্য এবং শহর জুড়ে অনেক জনপ্রিয় নামকিনের দোকান রয়েছে। ইন্দোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে পোহা, কচোরি, সামোসা, জলেবি, গুলাব জামুন, রবদি, গজক, ইমারতি, ভেল, পানি পুরি, হট ডগ, ডিম ব্যাঞ্জো, মুগ ভাজিয়া, মুগ ডালের হালওয়া, দই ওয়াড়া, সাবুদানা খিচড়ি, সাবুদানা ওয়াদা, ধোকলা ও সেভ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০১৮ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী ইন্দোর ভারতের শীর্ষ নিরামিষ প্রধান শহর বলে চিহ্নিত হয়, যেখানে ৪৯% বাসিন্দাই মাংসের পণ্য পরিহার বা বর্জন করে।

ইন্দোর ভারতের মধ্যাঞ্চলের শিক্ষা ও বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য বিখ্যাত। পাবলিক লাইব্রেরি, ক্লাব, সামাজিক সংস্থার ঐতিহ্য ইন্দোরের নাগরিক সমাজকে অগ্রসর ও পরিবেশ-বান্ধব আরবান বসবাসের বহুমাত্রিক সুযোগ উন্মোচিত করে দিয়েছে। ইন্দোর শহর ও জেলায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত মানুষের নামের তালিকা সত্যিই অসাধারণ, যার মধ্যে রয়েছেন ভারতের অন্যতম সংবিধান রচয়িতা ও দলিল সম্প্রদায়ের নেতা ড. আম্বেদকর, ওস্তাদ আমীর খান, লতা মুঙ্গেশকর, নায়ক সালমান খান, অভিনেতা জনি ওয়াকার (বদরুদ্দীন জামালুদ্দীন কাজি), ক্রিকেটার সি. কে নাইডু ও রাহুল দ্রাবিড়, কবি রাহাত ইন্দোরী প্রমুখ।

ঢাকা, দিল্লি, লাহোরের চেয়ে ইন্দোর বয়সে পুরনো ও ঐতিহ্যে ঋদ্ধ না হলেও আধুনিকতার পথে এগিয়ে যেতে নিজেকে দূষণমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখার যে দীক্ষা দিয়েছে, তার মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভাষায়: Today, Indore embodies its rich legacy, blending ancient heritage with modern culture. As you wander through its streets, you'll be captivated by the majestic palaces boasting stunning architecture, intricately carved temples, and mouthwatering street food tantalising the senses.

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।