বাকৃবিতে রঙিন চালের গবেষণা
ডায়াবেটিক ও স্থুলতা কমাবে কালো চালের আঁশ
পুষ্টিগুণে ভরপুর রঙিন চাল নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ছোলায়মান আলী ফকির এবং তার গবেষকদল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ওই গবেষণা দলে আরও যুক্ত ছিলেন কো-পিআই অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন-২ এবং স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ও সাগরিকা খাতুন।
রঙিন চাল নিয়ে প্রধান গবেষক ড. ছোলায়মান আলী ফকির বার্তা২৪.কমকে বলেন, রঙিন চালের (Oryza sativa L.) পুষ্টিগুণের কারণে এটি স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বর্তমানে জনপ্রিয় হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ি এলাকায় এবং প্রগতিশীল কৃষকেরা রঙিন চাল চাষাবাদ করছে। সাধারণ সাদা চালের তুলনায় এই চাল অধিক প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং আঁশ সমৃদ্ধ। রঙিন চালের ধানের রং সোনালি, লাল, কালো, বেগুনি বর্ণের হতে পারে। কিন্তু চালের রং লাল, বেগুনি, বাদামি বা কালো হয়। খোসা ছাড়ানোর পর ওই চালের দানা বাহির থেকে কালো বা লাল বহিস্থ আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে যাকে ব্রাণ বলা হয় এবং ব্রাণের ভিতরে এন্ডোস্পার্ম/ দানা ও ভ্রুণ/ জার্ম থাকে। দানা প্রধাণত স্টার্চ ও জার্ম প্রোটিন, আঁশ, ফাইটোক্যামিকেলস ও এন্থোসায়ানিন নামক লাল পদার্থ দ্বারা গঠিত।
রঙিন চালের চাষাবাদ পদ্ধতি সাধারণ বাদামি বা সাদা চালের মতোই। এটি সাধারণত 'আমন' মৌসুমে চাষ করা হলেও 'বোরো' মৌসুমেও চাষ করা যেতে পারে। প্রায় সব ধরনের মাটি যেমন বেলে-দোআঁশ এবং কাদা মাটি রঙিন চাল চাষের জন্য উপযোগী বলেন জানান অধ্যাপক ড. ছোলায়মান আলী ফকির।
চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে অধ্যাপক আরও বলেন, প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম সার যথাক্রমে ১২০, ৬০, ৮০ এবং ৫০ কেজি ব্যবহার করা হয়। এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং অন্য সব সার একত্রে জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করা হয়। অবশিষ্ট ইউরিয়া সমান দুই ভাগে চারা রোপণের ২৫ ও ৫০ দিন পর মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। অঙ্কুরিত বীজ, বীজতলায় বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিন পর মূল জমিতে (২৫ সেমি. x ১৫ সেমি.) দূরত্বে রোপণ করা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে চারা রোপণ এবং ১১৫-১২১ দিন পরে ফসল তোলা হয়। এসময়ের মধ্যে নিড়ানি, সেচ এবং অন্য সব প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করা হয়।
রঙিন চালের ফলন নিয়ে অধ্যাপক ড. ছোলায়মান বলেন, সাধারণত রঙিন চালের ধানের ফলন অন্য ধানের চেয়ে কিছুটা কম যা প্রতি হেক্টরে প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ টন। কালো চালের উচ্চমূল্য (কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা) হওয়ায় কম ফলনেও পুষে যায়। তবে কম ফলনের কারণ, অধিক রাসায়নিক সারের অসহনশীলতা, স্পাইকলেট বন্ধ্যাত্ব এবং অন্যান্য কারণ শনাক্ত করা গেলে ফলন বাড়তে পারে।
ব্রাণের লাল রং সাধারণত এন্থোসায়ানিনের উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। এন্থোসায়ানিনসহ অন্যান্য ফাইটোক্যামিকেলসের প্রচুর স্বাস্থ্য গুণাগুণ বিদ্যমান। গবেষণায় জানা গেছে, এন্থোসায়ানিন ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ প্রশমিত করে। কালো চালের ভাত, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, চিড়া, মুড়ি, মুড়কি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পিঠা (চিতই ভাপা, পুলি, তেল পিঠা ইত্যাদি) ও কেক প্রস্তুত করা যায়। কালো চাল/চালের গুড়া সাদা চাল/চালের গুড়া সংমিশ্রণে বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত করা সম্ভব বলে দাবি ওই অধ্যাপকের।
রঙিন চালের পুষ্টি ও ঔষধিগুণ নিয়ে অধ্যাপক বার্তা২৪.কমকে আরো জানান, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়দের খাবারে প্রোটিন, ভিটামিন, আঁশ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির প্রায়শই ঘাটতি থাকে। সাদা চালের চেয়ে কালো চালের ব্রাণে দুই থেকে তিনগুণ খনিজ পদার্থ বিশেষ করে আয়রন ও জিঙ্ক বিদ্যমান। অধিকন্তু আমাদের দেশে অটোরাইসমিল থেকে প্রাপ্ত ব্রাণ/ভূষি পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই ভূষিতে মূল্যবান পুষ্টিগুলো চলে যায়। রঙিন চালের ব্রাণে প্রোটিন এবং আঁশের পরিমাণ সাদা চালের চেয়ে বেশি। এ আঁশ ডায়াবেটিক ও স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে। ব্রাণে প্রোটিন, ফ্লাভোনয়েড, ফেনল ও ভিটামিন রয়েছে যা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে খুবই উপকারী।
রঙিন চালের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যাপক বলেন, রঙিন চাল অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার সহ্য করতে পারে না। ধানের দুগ্ধ অবস্থায় পাখি এবং পোকার দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে। অতএব, ধানের দানা দুগ্ধ অবস্থায় ক্ষেতে নেটিং দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। বেশির ভাগ রঙিন চালের জাত বিদেশি। ফলশ্রুতিতে উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিকর জিনোটাইপ উদ্ভাবন করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। কালো চালে বিদ্যমান এন্থোসায়ানিন একটি শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা দেহের ক্ষতিকারক রেডিক্যালসকে বিশোধন করে। এন্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ লাল বা কালো চাল এবং এদের থেকে তৈরি খাদ্য উপাদান বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করতে সাহায্য করবে।