জাতীয় পার্টির উত্তেজনায় শীতল পরশ

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের

সিনিয়র নেতা রওশন এরশাদের বিবৃতির পরে অস্থিরতা দেখা দিলেও শীতল হয়ে এসেছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। স্বস্তির ঢেকুর তুলছেন জিএম কাদেরের অনুসারীরা।

অনেকে মনে করেছিলেন রওশন এরশাদ হার্ড লাইনে এগিয়ে যাচ্ছেন। যা তার বিবৃতির মাধ্যমে অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিলো। রওশন বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছিলেন জিএম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবেন।

বিজ্ঞাপন

রওশনের এই প্রতিক্রিয়ার পর তৃণমূলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিলো। আশঙ্কা করা হচ্ছিলো সবচেয়ে বেশি দফায় ভাঙনের শিকার জাতীয় পার্টি আবার ভাঙতে যাচ্ছে। বিবৃতি পরবর্তী পরিস্থিতি অবলোকন করছিলেন নেতাকর্মীরা।

এরপর সাংবাদিকদের দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জিএম কাদের বিবৃতিতে উড়ো চিঠি বলে মন্তব্য করেন। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। জিএম কাদেরের এই প্রতিক্রিয়ার পর অনেকে আতঙ্কে ছিলেন ঘটনা প্রবাহে। অনেকে ভেবেছিলেন রওশন এবার হার্ডলাইনে যেতে পারেন।

রওশন এরশাদ বিবৃতি দিয়েছিলেন ২২ জুলাই। আর জিএম কাদের সেই বিবৃতিকে উড়ো বলে মন্তব্য করেছিলেন ২৩ জুলাই। এরপর পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও রওশন কিংবা রওশন অনুসারীরা কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি। এতে স্বস্তি নেমে এসেছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে। বিশেষ করে যারা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি দেখতে চান তারা বেশ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

জাতীয় পার্টিতে এখন তিন ধরণের মানসিকতার কর্মী সমর্থক রয়েছে। বড় একটি অংশ রয়েছে যারা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি দেখতে চান। তারা কোনভাবেই চাননা জাতীয় পার্টি আবার ভাঙনের কবলে পড়ুক। নতুন করে সংকট তৈরি হোক। এই অংশে উদারপন্থী এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সংখ্যা বেশি।

আরেকটি গ্রুপ রয়েছে জিএম কাদেরের পেছনে একাট্টা। তারা তাকে জাপার যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে মনে করছেন। এদের মধ্যে কিছু নেতা রয়েছেন যাদের কারো কারো রওশনের নাম শুনলেও গা জ্বালা করে। রওশনের আশপাশে ঘিরে থাকা নেতাদের সঙ্গে যাদের ব্যক্তিগত কিংবা নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই শ্রেণির নেতারা মনে করেন কাদের-রওশন মিলে গেলে রওশনপন্থীদের চাপে তারা হারিয়ে যেতে পারেন। যেভাবে অতীতে তারা চাপে ছিলেন। এই টাইপের বেশ কিছু নেতা এখন জিএম কাদেরের পেছনে সক্রিয়।

তারা অনেকে মনে করছেন কিছু সুবিধাভোগি দল থেকে চলে গেলেই ভালো। তাতে পার্টি আগাছামুক্ত হয়। মুখে এমন কথা বললেও অন্তরে নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের রেশ বিরাজমান। জিএম কাদের যদি এই শ্রেণির নেতাদের মধ্যে মিলে যান তাহলে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ সঙ্কটাপন্ন বলে মনে করছেন উদারপন্থীরা।

আরেকটি গ্রুপ রয়েছে রওশন এরশাদের পেছনে একাট্টা। এই গ্রুপে সিনিয়র কিছু প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ সদস্যরা রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যারা অনেকেই রওশনের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিলেন। এই গ্রুপটির সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্বের সূত্রপাতও তখন থেকেই।

ওই নির্বাচন জিএম কাদের কঠোরভাবে বর্জন করেছিলেন। পরে একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলে থাকার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। এই পন্থীদের পেছনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সংখ্যা খুবই নগন্য বলে মনে করা হয়। তবে সিনিয়র নেতা ও বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভায় থাকার কারণে কিছু অনুসারী রয়েছে। কারো কারো নিজ নিজ এলাকায় রয়েছে ব্যক্তিগত বলয়।

এই গ্রুপটি কোনভাবেই জিএম কাদেরকে নেতা মানতে নারাজ। তারা চান রওশন নেতৃত্বে থাকুক। আর তারা নিজেরা তার সঙ্গে থেকে রাজনীতি করতে চান। এই মতাদর্শের নেতাদের মধ্যে অনেকে সরকারি দলে একপা দিয়ে রেখেছেন। হয়তো রওশনের নেতৃত্বে জাপা, নয়তো সরাসরি নৌকার পালে বাতাস দিতে চান। তবুও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে নয়।

তবে কিছু অতি উৎসাহী নেতার কারণে জিএম কাদেরের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন উদারপন্থীরা। অতি উৎসাহীদের আচার আচরণ এবং ফেসবুকে নানা রকম নেতিবাচক স্ট্যাটাস অনেককে কাদের বিমুখ করে তুলছে। অতি উৎসাহীদের কর্মকাণ্ডে জিএম কাদেরের সমর্থন কিংবা মদদ না থাকলেও পরোক্ষভাবে দায় তার কাঁধেই গিয়ে পড়ছে। ক্ষুব্ধ অনেক নেতা গোপনে রওশনপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।

পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরকে যে শতভাগ নেতাকর্মী মানতে চাইছেন না তা তিনি নিজেও অবগত। ২০ জুলাই জাতীয় পার্টির যৌথসভায় জিএম কাদের মন্তব্য করেছেন তার প্রতি ৯৯ শতাংশ নেতাকর্মীর সমর্থন রয়েছেন।

জাতীয় পার্টির এই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় গত ১৬ জানুয়ারি জিএম কাদেরকে তাঁর অবর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ২২ মার্চ আরেক সাংগঠনিক নির্দেশনায় ১৬ জানুয়ারির নির্দেশনা বাতিল করেন এরশাদ।

এরপর কাদেরকে বহালে আন্দোলনে নামে রংপুরের নেতারা। অনেকটা বাধ্য হয়ে ২২ মার্চের নির্দেশনা বাতিল করে কাদেরকে পুনর্বহাল করেন এরশাদ।

গঠনতন্ত্রে পদ না থাকলেও ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন এরশাদ। এরপর রওশন পন্থীদের চাপে রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেছিলেন এরশাদ।

এরশাদের মৃত্যূতে শূন্য হয়ে যাওয়া রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপ-নির্বাচনকে জিএম কাদেরের অগ্নি পরীক্ষা মনে করা হচ্ছে। এখানে সিদ্ধান্তে কোনো ভুল কিংবা গড়মিল হলে মাসুল দিতে হবে সারাজীবন ধরে। এমনকি দল ভেঙে খণ্ডও হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

জাতীয় পার্টির এ দুর্গের উপ-নির্বচানে রওশন তার পুত্র রাহগীর আল মাহি সা’দ এরশাদকে মনোনয়ন দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে পারে। অনেকদিন ধরেই ছেলে সা’দকে রাজনীতি আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন রওশন। বিগত সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম সদর আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে দাবী।

কিন্তু রওশন এরশাদের এই অভিপ্রায়ে ছাড় দেবেন না কাদের পন্থীরা। রংপুর জাতীয় পার্টির নেতারাও বেকে বসতে পারেন। বিশেষ করে কাদেরপন্থী বলে পরিচিত মহানগর জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি এসএম ইয়াসির নিজেও প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে নামতে পারেন।

জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিগত বেশ কিছু নির্বাচনে প্রার্থী না পেয়ে নেতা হায়ার করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচন অন্যতম। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীই দিতে পারেনি দলটি। সে কারণে জিএম কাদেরকে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন উদারপন্থীরা।