ব্যর্থতার গল্প লিখে শ্রীলঙ্কায় সিরিজ হারল বাংলাদেশ
শেষ দিনে অবিশ্বাস্য, অলৌকিক কিছু ঘটেনি। হয়নি কোনো বিশ্ব রেকর্ড। প্রকৃতিও সাহায্য করতে আসেনি। বৃষ্টি বা আলোর স্বল্পতায় খেলাও বন্ধ হয়নি। শেষে পুরনো শঙ্কাটাই সত্যি হলো। দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ হার মানল ২০৯ রানের বড় ব্যবধানে। শুধু ম্যাচই নয়। হাতছাড়া হলো সিরিজও। প্রথম টেস্ট ড্র হওয়ায় দুই টেস্টের সিরিজ ১-০ ব্যবধানে জিতল লঙ্কানরা।
হারের শঙ্কাটা জেগেছিল প্রথম ইনিংসেই। টাইগাররা ২৫১ রানে গুটিয়ে গেলে শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসেই লিড পেয়ে যায় ২৪২ রানের। কেননা স্বাগতিকরা ৭ উইকেটে ৪৯৩ রানের পাহাড় গড়ে আগেই প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে রেখেছিল। পরে ৯ উইকেটে ১৯৪ রান তুলে দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশের সামনে জয়ের জন্য ৪৩৭ রানের মহা চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় ক্যাপ্টেন দিমুথ করুনারত্নের দল।
চতুর্থ ইনিংসে এমন পাহাড়সম লক্ষ্য ছোঁয়া বড়ই অসম্ভব জেনেও অবিশ্বাস্য কিছুর প্রত্যাশায় ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই মাঠে নামে মুমিনুল হকরা। চতুর্থ দিন শেষে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা ১৭৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেললে হারের শঙ্কাটা আরও বেড়ে যায়। মানে ম্যাচ জয়ের মিশনটা তখন হয়ে দাঁড়ায় হার এড়ানোর লড়াই। শেষ দিনে আর অবিশ্বাস্য কিছুই ঘটেনি। বরং দুঃস্বপ্নের হারের ব্যবধানটাই কমাতে পেরেছে বাংলাদেশ।
এবারও ধ্বংসযজ্ঞ চালান অভিষিক্ত প্রবীণ জয়াবিক্রম। এবার তিনি পাঁচ উইকেট শিকার করলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস থামে ২২৭ রানে। ফলে দুই ইনিংস মিলিয়েও লঙ্কানদের প্রথম ইনিংসের সমান রান তুলতে পারেনি টাইগাররা। অভিষেকেই ম্যাচসেরা হওয়া জয়াবিক্রমের সঙ্গে চার উইকেট নেন রমেশ মেন্ডিস।
টাইগারদের প্রথম ইনিংসে জয়াবিক্রম নিয়ে ছিলেন ৬ উইকেট। এবার নিলেন পাঁচ উইকেট। দুই ইনিংস মিলিয়ে অভিষেকেই জয়াবিক্রম নিলেন ১১ উইকেট। ১৬তম বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে কমপক্ষে ১০ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করলেন জয়াবিক্রম। ১৯৮০ সালের পর চতুর্থ বোলার হিসেবে অভিষেকে কমপক্ষে দশ উইকেট শিকারের রেকর্ড ছুঁলেন তিনি। শ্রীলঙ্কার হয়ে এই প্রথম কীর্তিটি গড়লেন বাঁ-হাতি এ স্পিনার। ২০০৮ সালের পর অভিষেকে এই প্রথম কোনো বোলার এমন দুরন্ত পারফরম্যান্স উপহার দিলেন।
ক্যান্ডির পাল্লেকেলে জয়ের জন্য টাইগারদের দরকার ছিল অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য কিছু পারফরম্যান্স। আর পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়া। কিন্তু এই কথাগুলো কেবল গল্প আর স্বপ্নের বেড়াজালেই আটকে রইল। আলোর মুখ দেখতে পারল না। কেননা প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও যে ব্যর্থতার গল্প লিখেছে মুমিনুল হকের দল।
শেষ দিনে অতিথিরা ২৬০ রানের ঘাটতি পূরণের দুঃসাধ্য লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামে। কিন্তু শেষের পাঁচ উইকেট নিয়ে পুরোপুরি বোলিং বান্ধব হয়ে পড়া পিচে কোনো ভাবেই সেটা সম্ভব হয়নি। ৫ উইকেটে ১৭৭ রান নিয়ে পঞ্চম দিনের খেলা শুরু করে বাংলাদেশ বাকি পাঁচ উইকেট হারিয়ে দলীয় স্কোরে যোগ করে মাত্র ৫০ রান। পঞ্চম দিন সফরকারীরা উইকেটে টিকে ছিল মাত্র এক ঘণ্টার একটু বেশি সময়। সকালের সেশনটাও পুরো শেষ করতে পারেনি তারা।
আগের দিনের অপরাজিত ব্যাটসম্যান মেহেদী হাসান মিরাজ তার ৪ রানের ইনিংসটাকে ৩৯ রানে রূপ দিয়ে ফিরেন সাজঘরে। আর লিটন দাস নিজের আগের দিনের ১৪ রানের সঙ্গে শেষ দিনে যোগ করেন মাত্র ৩ রান। তাদের দুজনের পরে লোয়ার-অর্ডারের বাকি ব্যাটসম্যানদের কেউ দুই অঙ্কেও পৌঁছতে পারেননি।
টেস্টে এত বিশাল আকাশ ছোঁয়া রান তাড়া করে এর আগে কেউ জিততে পারেনি। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতেছে সর্বোচ্চ ২১৫ রান তাড়া করে। বিদেশের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের ২৮২ রানের বেশি করার নজির নেই। চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৪১৩ রান তুলেছিল ২০০৮-০৯ মৌসুমে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আর ২০০৩ সালে ৪১৮ রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল ক্যারিবিয়ানরা। জিততে হলে এ সব রেকর্ড ভাঙতে হতো অতিথিদের। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হয়নি। তার ধারের কাছে যাওয়াও সম্ভব হয়নি।
ক্যারিয়ারের সেরা একটি টেস্ট সিরিজ খেললেন লঙ্কান ক্যাপ্টেন দিমুথ করুনারত্নে। দুই টেস্টের ৩ ইনিংস (২৪৪, ১১৮ ও ৬৬) মিলিয়ে সংগ্রহ করলেন রেকর্ড ৪২৮ রান। ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এর আগে এ ব্যাটার করে ছিলেন ৩৫৬ রান। দুরন্ত এ ব্যাটিং পারফরম্যান্সে সিরিজের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতে নিলেন এ তারকা ওপেনার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংস: ৪৯৩/৭ ডি., ১৫৯.২ ওভার (থিরিমান্নে ১৪০, করুনারত্নে ১১৮, ওশাদা ৮১, ডিকভেলা ৭৭*, রমেশ ৩৩ ও নিসানকা ৩০; তাসকিন ৪/১২৭, তাইজুল ৮৩/১, শরিফুল ১/৯১ ও মিরাজ ১/১১৮)।
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ২৫১/১০, ৮৩ ওভার (তামিম ৯২, মুমিনুল ৪৯, মুশফিক ৪০, সাইফ ২৫, মিরাজ ১৬; জয়াবিক্রম ৬/৯২, লাকমল ২/৩০ ও রমেশ ২/৮৬)।
শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংস: ১৯৪/৯ ডি., ৪২.২ ওভার (করুনারত্নে ৬৬, ধনাঞ্জয়া ৪১, নিসানকা ২৪, ডিকভেলা ২৪; তাইজুল ৫/৭২ ও মিরাজ ২/৬৬, সাইফ ১/২২ ও তাসকিন ১/২৬)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ২২৭/১০, ৭১ ওভার (মুশফিক ৪০, মিরাজ ৩৯, সাইফ ৩৪, মুমিনুল ৩২, শান্ত ২৬, তামিম ২৪, লিটন ১৭; জয়াবিক্রম ৫/৮৬, রমেশ ৪/১০৩)।
ম্যাচ ফল: শ্রীলঙ্কা ২০৯ রানে জয়ী।
সিরিজ ফল: দুই টেস্টের সিরিজ ১-০ ব্যবধানে জিতল শ্রীলঙ্কা।
ম্যাচ সেরা: প্রবীণ জয়াবিক্রম।
সিরিজ সেরা: দিমুথ করুনারত্নে।