আম্পানের হুঙ্কার, উপকূলজুড়ে শঙ্কা

  ঘূর্ণিঝড় আম্পান
  • রফিকুল ইসলাম মন্টু, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সমুদ্র মোহনায় দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের চিত্র | ছবি: র. ই. মন্টু

সমুদ্র মোহনায় দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের চিত্র | ছবি: র. ই. মন্টু

অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হওয়ায় শঙ্কা বাড়ছে গোটা উপকূলজুড়ে। উপকূলের বহু এলাকায় ছোট ধাক্কা সামলানোর সামর্থ্যই যেখানে নেই; সেখানে প্রবল ঝড়ের এত বড় ধাক্কা কীভাবে সামলাবে উপকূল?

এমন প্রশ্ন স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে করোনা সতর্কতার মাঝেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রশাসন। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজনের তূলনায় কম থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিঝড় আম্পান প্রথম দিকে দেশের পশ্চিম উপকূলে আঘাত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও অতিদ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি রূপ বদলে ফেলেছে। এর শক্তি বেড়েছে; বেড়েছে ব্যাসার্ধ। ফলে এখন আশঙ্কা শুধু পশ্চিম উপকূলে নয়; এর তাণ্ডব ছড়িয়ে যেতে পারে সমগ্র উপকূলজুড়ে। পশ্চিম উপকূলের সুন্দরবন লাগোয়া এলাকার মানুষজন যেমনি আতঙ্কিত; তেমনি শঙ্কা ছড়িয়েছে মধ্য কিংবা পূর্ব উপকূলে।

আবহাওয়া দপ্তর এরই মধ্যে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা এবং এসব জেলার সন্নিহিত দ্বীপ-চরের জন্য সতর্কতা জারি করেছে।

মাঠের তথ্য সূত্র বলছে, উপকূলের দুর্গম জনপদের বহু মানুষ এখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আতংকে দিন কাটান। জোয়ারের পানি বাড়লে, জলোচ্ছ্বাস হলে, ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে ভয় বাড়ে। পূর্ব উপকূলের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিম উপকূলের শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত বহু স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষের সেই আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলেছে। উপকূলীয় পাঁচটি দ্বীপ উপজেলার মধ্যে সবগুলোই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীর উপজেলার ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি এলাকার প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। উঁচু জলোচ্ছ্বাসে এইসব এলাকা থেকে পানি ঢুকবে। অন্যদিকে উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের মানুষেরা পুরোপুরি অরক্ষিত। পাশের উপজেলা কুতুবদিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বর্ষাকাল এলেই সেখানকার মানুষ আতঙ্কে থাকে।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ধাক্কা দিয়েছিল কুতুবদিয়ায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল উত্তর ধূরুংয়ের বেশ কিছু এলাকা। সেই ক্ষত এখনও স্পষ্ট। কায়ছার পাড়া, নয়াপাড়া এলাকার লোকজন সেই থেকেই ভোগান্তি পোহাচ্ছে। কুতুবদিয়ার তাবালর চর এলাকার বেড়িবাঁধ অত্যন্ত নাজুক। এর ওপর আবারও ধাক্কা এলে সেখানকার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়বে।

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের চারিদিকে নতুন বেড়িবাঁধের কাজ চলমান থাকলেও অন্তত আট কিলোমিটার বাঁধ নাজুক পড়ে আছে, কাজ অসমাপ্ত। দক্ষিণ-পশ্চিম সন্দ্বীপের সারিকাইত, হরিষপুর, মাইটভাঙা, আজিমপুর, রহমতপুর, কালাপানিয়া এলাকার অবস্থা নাজুক। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের বড় ধাক্কায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এসব এলাকায়। আম্পানের খবরে ১৯৯১ সালের স্মৃতি উসকে দেয় এই এলাকার মানুষদের।

সারিকাইতের বাংলাবাজারের ফিরোজ উদ্দিন বলেন, সেবার ঘূর্ণিঝড়ে সব হারাইছি। এবার কী হয় জানি না। বেড়িবাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বহু এলাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নটি বেড়িবাঁধ বিহীন অবস্থায় রয়েছে। সেখানে ৫০ হাজার মানুষের বাস। অন্যদিকে ঢালচরের হাতিয়া অংশে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার লোক।

এছাড়াও তমরুদ্দি, নলচিরা, সুখচর, চর ঈশ্বর ও চানন্দী ইউনিয়নের অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ নাজুক। চারিদিকে বেড়িবাঁধ থাকায় মোটামুটি স্বস্তিতে ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। তবে চিন্তা রয়েছে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা কলাতলী চর নিয়ে। বেড়িবাঁধ বিহীন ওই চরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস। মনপুরা ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ড রয়েছে সেখানে। অন্যদিকে ঢালচরের মনপুরা অংশে প্রায় দেড় হাজার মানুষ রয়েছে।

কলাতলীর বাসিন্দা মো. নুরুন্নবী বলেন, বড় ঘূর্ণিঝড় এলে আমাদের বিপদের শেষ থাকবে না। চরে তিনটি স্কুল কাম সাইক্লোন শেলটার থাকলেও তাতে সর্বোচ্চ তিন হাজার লোক ধরবে। তবে মনপুরা উপজেলা প্রশাসন কলাতলী ও ঢালচর মনপুরা অংশের লোকজনকে দ্বীপ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভোলার অন্যান্য দ্বীপগুলোর মধ্যে চর মোজাম্মেল, চর জহিরুদ্দিন, হাজীপুর, মদনপুর, কাচিয়া, ঢালচর, চর নিজামসহ দ্বীপাঞ্চলের মানুষেরা বেশ আতংকিত। করোনার মাঝে ঘূর্ণিঝড়ের এই হুঙ্কার তাদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করেছে। ভোলার চরফ্যাসনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও তা নদীর ভাঙনে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।

ভোলা সদরের মাঝেরচর, রামদাসপুর, চর চটকিমারা, দৌলতখানের মদনপুর, হাজীপুর, মেদুয়া, বোরহানউদ্দিনের চর জহিরুদ্দিন (আংশিক), তজুমদ্দিনের চর মোজাম্মেল, চর জহিরুদ্দিন (আংশিক), লালমোহনের কচুয়াখালীর চরের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বিপদের মাঝে বসবাস করছে।

ঢালচর ইউনিয়নের বাসিন্দা এম, আবদুর রহমান বিশ্বাস বলছিলেন, এরকম বিপদে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের। এখানে আশ্রয় নেওয়ার মত কোন ব্যবস্থা নেই। আম্পানের শক্তির খবর পেয়ে এ দ্বীপের মানুষের মনে ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি ফিরে আসছে। সেসময় দ্বীপটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

ঢালচরের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। ভোলা সদরের মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছিরউদ্দিন নাননু বলেন, চরের মানুষকে এপারে আনার প্রয়োজন নেই। চরের ১০ হাজার মানুষ সেখানেই আশ্রয় নিতে পারবে।

এদিকে ভোলার জেলার ২১টি চরে বসবাসকারী প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে জেলা প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক জানিয়েছেন, লোকজনকে নিরাপদে আনতে ২০টি নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাইক্লোন শেলটারের পাশাপাশি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লোকজনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

মেঘনা অববাহিকায় লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চর আবদুল্লাহ’র প্রায় ৮ হাজার মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রামগতি উপজেলা সদর থেকে এ দ্বীপের দূরত্ব ট্রলারে প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। স্থানীয় বাসিন্দা আলাউদ্দিন মাষ্টার জানান, এখানকার তিনটি বাজারে ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। তবে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মত কোন আশ্রয়কেন্দ্র, মাটির কিল্লা অথবা অন্যকোন পাকা ভবন এখানে নেই। ফলে বাসিন্দারা শংকায় রয়েছে।

বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীভাঙনের শিকার মানুষেরা এসব চরে ঠাঁই নিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এইসব মানুষেরা অসহায় হয়ে পড়ে। মাঝারি আকারের উচ্চতায় জোয়ারের পানি এলেও এসব এলাকার মানুষের রক্ষা নেই। জীবন বাঁচানোর মত আশ্রয়ের ব্যবস্থা এসব চরে একেবারেই সীমিত। বড় কোন গাছপালাও নেই; যা আঁকড়ে ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে চরবাসী জীবন রক্ষা করবে।

পটুয়াখালীর গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, বাউফলে রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বেশকিছু অরক্ষিত চরাঞ্চল। স্বাভাবিক জোয়ারেই সেসব চরে পানি প্রবেশ করে। অনেক স্থানে নেই বেড়িবাঁধ। আবার কোথাও বেড়িবাঁধ থাকলেও তা প্রবল জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে।

রাঙ্গাবালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। একই অবস্থা রাঙ্গাবালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চালিতাবুনিয়ার। গলাচিপার চরকাজল, চর বিশ্বাস, পানপট্টির অনেক স্থানের মানুষের বারোমাসই ঝুঁকিতে বসবাস।

বরগুনার তালতলী, পাথরঘাটা, পিরোজপুরের মাঝেরচর, শরণখোলার বগী, তাফালবাড়িয়া, খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার গাবুরার প্রাকৃতিক ঝুঁকি কোনভাবেই কমছে না। এসব এলাকার মধ্যে সিডর বিধ্বস্ত বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা এবং আইলা বিধ্বস্ত কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগরের মানুষের প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকির মাত্রা অত্যাধিক।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা কমে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা। অনেক স্থানে নির্মিত হয়েছে নতুন বেড়িবাঁধ। যোগাযোগ উন্নয়ন ঘটেছে। এইসব কারণে দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। তা সত্বেও রয়েছে ঝুঁকি। উপকূলের বহু এলাকা এখনও রয়েছে অরক্ষিত। জোয়ারের পানি বাড়লেই ডুবে যায় ঘরবাড়ি। ছোট ধাক্কাতেই ভেঙে যায় নাজুক বেড়িবাঁধ। উপকূলের সব স্থানে যেমন বেড়িবাঁধ নেই; তেমনি বাঁধের উচ্চতাও প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি। ফলে ১৯৯১, ১৯৭০, ২০০৭-এর ঘূর্ণিঝড়ের মতো বড় আকারের ধাক্কা এলে উপকূলে বড় বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে।