গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে পুরান ঢাকায় ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে ঝরে যায় ৭২টি তাজা প্রাণ। চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনের সেই অগ্নিকাণ্ড চুড়িহাট্টা ট্রাজেডি নামে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে।
অনিরাপদ একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে ওয়াহেদ ম্যানশন ও এর আশপাশে থাকা রাসায়নিকের পণ্যের কারখানা ও গুদাম।
বছর ঘুরে এলেও সেই অগ্নিকাণ্ডের উত্তাপ এখনো রয়েছে আগুনে দগ্ধদের পরিবারগুলোতে। স্বজন হারানোর বেদনায় আজো অশ্রু ফেলেন হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা।
আগুনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের ক্ষতি কোনভাবেই পূরণ হবার নয়। তবে আর্থিক ক্ষতি তো পূরণ হওয়া সম্ভব। ঘটনার পরপর ৩০টি বেসরকারি ব্যাংক নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্যে ৩০ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেয়। সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা হয় বলেও খবর পাওয়া যায়। তবে অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণের কোন টাকা এখনও হাতে পাননি বলে অভিযোগ করেছেন হতাহতদের স্বজনরা।
চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির এক বছর পূর্তির দিনে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে সমবেত স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, এক বছর পেরিয়ে গেলেও হতাহতদের পরিবার কোন ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য পায়নি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনুদানের ৩০ কোটি টাকা কোথায় জানতে চান তারা।
ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনেই একটি টেবিল পেতে সেখানে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছে কয়েকটি সামাজিক সংগঠন। পাশেই মসজিদ, মসজিদের সামনে মাঠা ও ছানা বিক্রি করছেন চল্লিশোর্ধ্ব লিয়াকত আলী।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গণস্বাক্ষর সংগ্রহের স্থানের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে শুরু করলেন, “এই-এইহানেই মানুষ পুইড়া ছাই হইয়া গেছে! মানুষ পুইড়া যে দাঁত মাজনের ছাইয়ের মতো হইতে পারে চুড়িহাট্টায় আগুন না লাগলে জানতাম না জীবনেও!”
ওয়াহেদ ম্যানশনের দেওয়াল দেখিয়ে তিনি আরও বলেন, “এই দেওয়ালডিতে আগুন, কালি আর সিমেন্ট উইঠা যাওয়ার দাগ আছিল। নতুন কইরা সিমেন্ট দিয়া হেডি মিশায়া ফালাইছে। কিন্তু যাগো আপনাজন মরছে, তাগো কি মনের দাগ মুছবো?” এমন প্রশ্ন ছুড়ে জবাবের অপেক্ষা না করে নিজের কাজে মনোযোগ দেন লিয়াকত আলী।
অগ্নিকাণ্ডের দিন ঘটনার পনের মিনিট আগে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন জুম্মান। ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশেই বন্ধুর দোকান মদিনা ডেকোরেটর। প্রতিদিনের মতো সেই দোকানের সামনে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে বসেছিলেন তিনি। কিন্তু আড্ডা শেষ করে আর ঘরে ফিরতে পারেন নাই। পরের দিন সকালে জুম্মান ও তার বন্ধুর ঝলসানো লাশ পাওয়া যায় মদিনা ডেকোরেটরের ভেতরে। জানালেন নিহত জুম্মানের ছেলে রাশেদ হাসান।
তিনি বলেন, “এখনো কোথাও আগুন দেখলে আঁতকে উঠি! একটা ভয় কাজ করে। সেই ঘটনার পরে থেকে আমরা এখনো কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে পারি নাই। আমারা পাঁচ ভাই আর বাবা-মায়ের সংসার ছিল। বাবা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি এভাবে চলে যাওয়ার পরে আমরা অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ পাইনি। আমরা চাই নিহতদের প্রত্যেকের পরিবাবারের জন্য যেন স্থায়ী কোন ব্যবস্থা করা হয়।”
নিজের ব্যবসার জন্যে মালামাল কিনতে সেদিন চুড়িহাট্টায় এসেছিলেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির আব্দুর রহিম। মালামাল নিতে এসে আগুনে প্রাণটাই হারান তিনি। তার মরদেহ পর দিন ঢামেক বার্ন ইউনিটে শনাক্ত করেন তার ছোট ভাই এছহাক আলী।
ভাই হারানো এছহাক জানান, তার ভাইয়ের দুই মেয়ের একজনের বিয়ে হয়েছে, আরেকজনের এখনও বিয়ে দেওয়া বাকি। আব্দুর রহিম ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র রোজগারে ব্যক্তি। ভাই না থাকায় তার পরিবার নিয়ে এছহাক পড়েছেন বিপাকে। ভাইয়ের পরিবার নিয়ে চিন্তা করলে চোখে অন্ধকার দেখেন তিনি।
আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত সিদ্দিক উল্লাহর ছেলে আহসান উল্লাহ বলেন, “বাবার মৃত্যু চিৎকার আমি মোবাইলে শুনেছি! আমার বাবা সিদ্দিক উল্লাহ এসেছিলেন হোমিও ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার দেখানো শেষে নিজের অবস্থা ও অবস্থান জানাতে আমাকে ফোন দেন তিনি। কথা বলার এক পর্যায়ে মোবাইলেই বিকট শব্দ শুনতে পাই, সাথে বাবার আর্তচিৎকার। তারপর থেকেই বাবার মোবাইল বন্ধ পাই। টিভিতে দেখে জানতে পারি বাবা যেখানে ছিল সেখানেই আগুন লেগেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের সংসার অচল প্রায়। এই ক্ষতি আমরা কি দিয়ে পূরণ করবো এখনো ভেবে পাই না!
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে এসে উপস্থিত হতে থাকেন অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা। সেখানে সম্মিলিতভাবে গণস্বাক্ষরের আয়োজন করেছে কয়েকটি সামাজিক সংগঠন।
আরও পড়ুন: শেষ হয়নি চুড়িহাট্টার তদন্ত, জামিনে আসামিরা