দগ্ধ স্বামীকে চুল দেখে চিনলেন চম্পা

  • মনি আচার্য্য, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কেরানীগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ সোহাগের স্ত্রী চম্পা বেগম

কেরানীগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ সোহাগের স্ত্রী চম্পা বেগম

কেরানীগঞ্জ উপজেলার চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা সোহাগ ও চম্পা দম্পতি। সোহাগী নামে ছয় বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে আছে এই দম্পতির।

চুনকুটিয়া এলাকার ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কারখানায় কাজ করে সংসার চালাতেন সোহাগ। নিম্ন আয়ের সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও সুখ-শান্তির কমতি ছিল না সোহাগ-চম্পার সংসারে। একমাত্র মেয়ে সোহাগীকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১১ ডিসেম্বরে) রাতে ওই প্লাস্টিক কারখানায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সব কিছু পাল্টে গেছে। নিমেষেই অন্ধকারের ছায়া নেমে এসেছে চম্পার সুখের সংসারে।

ঘটনার ৪-৫ ঘণ্টা আগেও দুপুরে বাসায় খেতে গিয়েছিলেন সোহাগ। খেতে এসে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘দুপুর বেলা আমি খালি ভাত খাইতে আই না, তরে দেখতে আই’।

কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানার অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধরা

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন সোহাগ। আর আইসিইউ’র গেটের সামনে বসে আহাজারি করছেন তার স্ত্রী চম্পা বেগম। বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন চম্পা; আত্মীয়-স্বজন কেউই থামাতে পারছে না চম্পার কান্না। তার কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে বার্ন ইউনিটের পরিবেশ।

বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ’র সামনে এ চিত্র দেখা যায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে চম্পা বেগম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি তো সোহাগীর আব্বুরে প্রথমে চিনিই নাই! পরে আমি চুল দেইখা চিনছি। সারা শরীর পুইড়া গেছে গো! প্রতিদিন সকাল ৮টায় যাইতো কারখানায় আর আইতো রাইত ৮টায়। খালি মাঝখানে দুপুরে খাইতে আইতো।’

‘আমি বলতাম তুমি এত দূরে থেকে খাইতে আইয়ো কেন? যাইতে যাইতে তো তোমার পেট খালি হয়া যাইব। তখন সোহাগীর আব্বু আমারে বলতো, দুপুর বেলা আমি খালি ভাত খাইতে আই না তরে দেখতে আই। তরে না দেখলে আমার ভালো লাগে না।’

এ সময় চম্পার বড় বোন মমতাজ বলেন, আইসিইউতে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে সোহাগের। সে আমাকে বলেছে আমার মেয়ে সোহাগী ও স্ত্রী চম্পারে তোমরা দেইখা রাইখো। আমি মনে হয় আর বাঁচব না।

শুধু চম্পা নয়, আইসিইউ’র সামনে তার মতো আহাজারি করছেন কারখানাটির শ্রমিক মো. ফারুকের স্ত্রী আফসানা বেগম। তিনি আহাজারি করে বলছেন, ‘আমার জামাইরে এইহানে হুদাই আনছে। আমার স্বামীর সারা শরীর পুইড়া গেছে। আমরা জামাই নাই গো নাই!’

অগ্নিদগ্ধদের স্বজনরা

কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের ঘটনায় আহত ও নিহতদের স্বজনদের এমন আহাজারি দেখা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনেও।

কারখানার শ্রমিক ফয়সাল (২৯) বৃহস্পতিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢামেকের বার্ন ইউনিটে মারা যান। নিহতের বাবা হানিফ দেওয়ান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ফয়সালের স্ত্রী তাসলিমা বেগম পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট। আমার একমাত্র ছেলে ফয়সাল। সংসার চলত তার আয়ে। আমার ছেলে এভাবে চলে যাবে মানতে পারছি না। আগুন লাগার একদিন আগেও আমার বাপের সঙ্গে ফোনে কথা হইছিল। ওইটাই যে শেষ কথা কে জানতো?’

নিহত ও আহতদের স্বজনরা অভিযোগ করে জানান, কারখানাটিতে এর আগেও ৩-৪ বার আগুন লেগেছিল। কিন্তু এর পরেও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মালিক পক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।’

মো. সোহেলের ছোট ভাই আসাদ (১৪) কারখানাটিতে ইলেক্টিশিয়ানের কাজ করত। কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে আসাদের শরীরের ৫৫ শতাংশ অংশ পুড়ে গেছে। সে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

মো. সোহেল বলেন, এর আগেও কারখানাটিতে কয়েকবার আগুন লেগেছিল। কিন্তু এরপরেও মালিক কোন ব্যবস্থা নেয় নাই। মালিকের দোষের কারণেই আমার ভাইসহ এত লোক আজ মৃত্যুর মুখে।

বুধবার বিকেলে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ওই প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।