তাজরীন ট্রাজেডি: ৬ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আহত কেউ

  • মাহিদুল মাহিদ, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, সাভার (ঢাকা)
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তাজরীন ট্রাজেডি

তাজরীন ট্রাজেডি

সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক শিল্পের একটি কালো অধ্যায় তাজরীন ট্রাজেডি। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকার তাজরীন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১১৩ জন শ্রমিকের প্রাণহানিসহ তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। যারা হারিয়েছে তাদের কর্মক্ষমতা। এখন তারা জীবনযাপন করছেন মানবেতর। দেশের ইতিহাসে শতাধিক শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ট্রাজেডি এটাই প্রথম।

২৪ নভেম্বর মনে করিয়ে দেয় নিহতদের পরিবারের স্বজন হারানোর বেদনা। এই দিনে কেউ হারিয়েছে মাকে, বোনকে, বাবাকে কেউ বা আবার হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। এইদিন ডুকরে কেঁদে ওঠে স্বজন হারানো মানুষগুলো। উপার্জনক্ষম মানুষগুলোই এখন তাদের পরিবারের বোঝা, কেউবা কোনোমতে দোকান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন যুদ্ধ। কেউবা চিকিৎসা করাতেই নামমাত্র ক্ষতিপূরণসহ শেষ করেছেন তাদের সর্বস্ব। আবার অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন ক্ষতিপূরণ থেকেও। তারা গত ৬ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন ক্ষতিপূরণের আশায় আর প্রহর গুনছেন পুনর্বাসনের।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটু সহযোগিতার আশায় আহতদের অনেকেই সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন ওই একই এলাকায়। আহত স্বামী নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আহত স্ত্রী দিনাতিপাত করছেন চরম দুর্ভোগে। আহত স্বামী নিয়ে দিনাতিপাত করা সেই আহত স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের। তিনি বার্তাটেয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, আমার স্বামী রবিন প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। কখন কি বলে আর কি করে তা তিনি নিজেও বোঝেন না। এখন আমি নিজেও অসুস্থ। সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।

তাজরীন ট্রাজেডি

আরেক আহত শ্রমিক শিল্পী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, তাজরীনে দুর্ঘটনায় আমি আহত হই। তারপর থেকে কোনো কাজ করতে পারি না। পায়ে হেঁটে কাপড় বিক্রি করেছি কিন্তু বেশি অসুস্থ হওয়ায় এখন আর তাও করতে পারি না। এখন দুমুঠো ভাত যোগাতেও আমার কষ্ট হয়। পরে শ্রমিক নেতা সোহাগ দশ হাজার টাকা দিয়ে আমাকে পিঠার দোকান করে দিয়েছেন। দিনে ২ থেকে ৩ শত টাকা আয় হয়। এটা দিয়ে বাসা ভাড়া খাওয়া চলে না। আমি চাই আমার মত যারা আহত আছেন তাদের তাজরীনের ভবনে পুনর্বাসন করা হোক। দুর্ঘটনা হলে এত কষ্ট সহ্য করতাম, কিন্তু এটা পরিকল্পিত ঘটনা। তাই তাজরীনের মালিক দেলোয়ারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

সব কিছু ভুলে তাজরীনের আহত শ্রমিকরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তারা দশজন মিলে টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু সেটাও বেশি দিন চালাতে পারেন নি তারা। টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করা আহত শ্রমিক সবিতা রানী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমাদের দিকে কেউ নজর দেয়নি। পর্যাপ্ত পুঁজি আর অসুস্থতাজনিত কারণে কয়েক মাস পরেই ওই টেইলার্স বন্ধ হয়ে যায়।

তাজরীন ট্রাজেডি

নিহতদের পরিবার ভোগ করছে স্বজন হারানোর বেদনা। পঙ্গু সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে তাদের পরিবার। ঘটনার সাত বছর পার হতে যাচ্ছে কিন্তু এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের। অনেকেই শুধুই চিকিৎসার খরচ পেয়েছেন। কেউ আবার পেয়েছেন নাম মাত্র কিছু ক্ষতিপূরণ। চিকিৎসা নেওয়া রেহানা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, আমাদের কিছুদিন আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিলো। সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য কিছু সরকারি ওষুধ দিয়ে দায় এড়াতে চেয়েছে সবাই। আমাদের দিকে নজর দিয়ে কাজ করতে না পারার কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে আমাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে জোরালো অনুরোধ জানাই।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকেই শ্রমিক সংগঠনগুলো তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে সব ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিককে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ ও মালিক দেলোয়ার হোসেন সহ সকল দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবি করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি তুহিন চৌধুরী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও শিল্পাঞ্চল সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিকদের জন্য সরকারি হাসপাতাল গড়ে তুলে তাজরীনের আহত শ্রমিক তথা সকল শ্রমিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা উচিৎ। কারণ দেশের ৭৬% আয় এই শিল্প থেকে আসে। তাই শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করলে তাজরীন ও সকল শ্রমিকদের কষ্ট লাঘব হবে। সেই সাথে আহতদের ক্ষতিপূরণসহ তাজরীনের মালিক দেলোয়ারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশন কারখানায় ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১১৩ জন নিহত ও তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলা জনিত মৃত্যুর দণ্ড-বিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়। ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে চার্জশিট দেন। এতে তাজরীন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।