হালদার চরের ‘ভান্ডারি মুলা’ আকারে বিশাল, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও অনন্য এক কৃষিজ পণ্য হলো ‘ভান্ডারি মুলা’। এটি শুধুমাত্র হালদা নদীর চরের বালুমাটিতে চাষ হয় এবং স্থানীয়ভাবে বিশেষ চাহিদার কারণে এটি কৃষি ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার দরবার শরীফের ওরশ শরীফ উপলক্ষে এই মুলার উৎপাদন এবং ব্যবহারের বিশেষ পরিচিতি সৃষ্টি করেছে।
ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সঙ্গে ভান্ডারি মুলার একটি ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। এখানে প্রতি বছর মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত ওরশ শরীফে মুলাটি বিশেষভাবে তবরুক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারির (ক.) দরবারে মাংস মুলার তবরুকের প্রচলন রয়েছে, যা ভক্তদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
বিশাল আকার ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
ভান্ডারি মুলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর আকার ও ওজন। প্রতিটি মুলার দৈর্ঘ্য প্রায় দুই থেকে তিন হাত এবং ওজন ৩ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত হয়। এটি ‘জাপানি হাইব্রিড তাসাকিসান’ মুলা নামে পরিচিত। কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে মুলাগুলোর ওজন ২ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হয়েছে। এর নরম ও মিষ্টি স্বাদ, বিশাল আকৃতি এবং বিশেষ পুষ্টিগুণ ভক্ত ও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে।
ভান্ডারি মুলার চাষাবাদ শুরু হয় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে। হালদা নদীর চরাঞ্চলের উর্বর মাটি এবং জৈব সারের ব্যবহার এর উৎপাদনশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়। ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, চরের মাটি অত্যন্ত উর্বর এবং উৎপাদিত ফসল অত্যন্ত পুষ্টিকর। চলতি বছর ভান্ডারি মুলার বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকরা এ মুলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বাজারজাতকরণ ও চাহিদা:
ভান্ডারি মুলার চাহিদা স্থানীয় বাজারে অত্যন্ত বেশি। এক একটি মুলার দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়। ফটিকছড়ির ওরশ শরীফে আসা ভক্তরা নিয়ত করে এই মুলা কিনে থাকেন। এটি শুধু খাদ্য নয়, বরং আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলি করার একটি উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিক্রেতারা জানান, মাঘ মাসের মেলায় মুলার বিক্রি দ্বিগুণ হয়। এ বছর কৃষক ও বিক্রেতারা মুলার চাহিদা দেখে আশান্বিত।
পুষ্টিগুণ:
ভান্ডারি মুলা শুধুমাত্র আকারে নয়, পুষ্টিগুণেও অনন্য। এটি ভিটামিন সি, ডায়েটারি ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। এটি হজমশক্তি উন্নত করতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। পুষ্টিবিদদের মতে, ভান্ডারি মুলা একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংযোগ:
ভান্ডারি মুলা শুধু একটি সবজি নয়, এটি ফটিকছড়ির মানুষের ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় আবেগের প্রতীক। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের ওরশ শরীফে মুলার ব্যবহার একটি ধর্মীয় আচার। ভক্তরা এটি তবরুক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিয়ত পূরণে এটি খান। এটি স্থানীয় জনগণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভান্ডারি মুলা চাষে কৃষকদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ইতিবাচক। কৃষক মোহাম্মদ শফিক জানান, আমি গত চার বছর ধরে ভান্ডারি মুলা চাষ করছি। চলতি মৌসুমে ফলন ভালো হয়েছে। গতবারের তুলনায় এ বছর মুলার দামও বেশ ভালো। এ মুলা চাষে আমাদের পরিবার ভালোভাবেই লাভবান হচ্ছে।
বিক্রেতা মোহাম্মদ আজিজ বলেন, আমরা সারা বছরই অপেক্ষা করি মাঘের মেলার জন্য। কারণ এ সময় মুলার বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। এবার আমরা দ্বিগুণ পরিমাণ মুলা এনেছি এবং এর বেশিরভাগই ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
ভান্ডারি মুলার চাষাবাদে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। হালদা নদীর পানিদূষণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি মুলার উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। এই মুলার চাষকে আধুনিক কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করলে এটি আরও লাভজনক হয়ে উঠবে।
ভান্ডারি মুলা হালদা নদীর চরের একটি অনন্য ফসল, যা স্থানীয় কৃষকদের জীবিকা এবং ভক্তদের জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এর বিশাল আকার, পুষ্টিগুণ এবং ঐতিহ্যবাহী গুরুত্ব এটিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি বিশেষ কৃষিজ পণ্য হিসেবে তুলে ধরেছে। সঠিক যত্ন, গবেষণা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে এর উৎপাদন ও জনপ্রিয়তা আরও বাড়ানো সম্ভব। এটি শুধু ফটিকছড়ি নয়, বরং সারা দেশের মানুষের কাছেও একদিন পরিচিত হয়ে উঠবে।
ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, ভান্ডারি মুলার সঠিক পরিচর্যা ও উর্বর মাটির কারণে চলতি বছর এর বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিচ্ছি যাতে তারা এই মুলার উৎপাদন আরও বাড়াতে পারেন। ভবিষ্যতে এই মুলা রফতানির সম্ভাবনাও রয়েছে।