বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুতে আমলে না নিলেও যখন সরকারের ঘুম ভাঙে ততক্ষণে বিদায়ের ঘণ্টা অনেকটাই বেজে গিয়েছিল। ফলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমনে কঠোর হয় সরকার। আন্দোলন দমনের জন্য দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠা পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেছে নিজের ইচ্ছেমতো। আর সেজন্যই তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পুলিশ বাহিনীর। গুলি চালিয়ে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যার ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা।
রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীবাসীকে পুলিশি সেবা দিয়ে থাকে ডিএমপির ৫০টি থানার ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য। ৫ আগস্টের পর ডিএমপির অন্তত ২২টি থানা বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার মধ্যে ১৩টি থানার ভবন ছাড়া কিছুই রক্ষা পায়নি। ক্ষোভের আগুনে পোড়া ১৩টি থানাগুলোর মধ্যে মিরপুর একটি। আগুনে পুড়ে কঙ্কাল হওয়া ভবন ছাড়া কিছুই রক্ষা হয়নি।
গত ৬ আগস্ট মিরপুর থানায় গিয়ে দেখা গিয়েছিল, থানার ভবনের সামনে যেতেই সাদা কাগজে লেখা, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, প্রবেশ নিষেধ। থানার ফটকে তিনটি গাড়ি ও একটা এপিসি পুড়ে ছাই। ভবনের নিচতলায় থাকা প্রতিটি রুমে ছাই ছাড়া কিছুই নেই। আগুনের তাপে ফ্লোরের টাইলসও ফেটে গেছে। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ভবনের ভেতরে আগুন জ্বলেছে। দ্বিতীয় তলায় যাওয়ার সিঁড়িটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেদিন থানার পেছনে অন্তত ২৫টি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো থানা ভবনে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি পুলিশ। মিরপুর থানা ঘুরে দেখা গেছে, ৫ আগস্টের বিক্ষুব্ধ জনতার দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া থানা ভবনের গায়ে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। থানার প্রতিটি কোনায় কোনায় সংস্কার করা হয়েছে। আনা হয়েছে নতুন আসবাবপত্র।
গত ৬ নভেম্বর যখন এই প্রতিবেদক থানায় প্রবেশ করেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দক্ষিণের সূর্যটা খানিক হেলে পড়েছে পশ্চিমে। থানার প্রধান ফটকে অস্ত্র হাতে দাড়িয়ে এক নারী কনস্টেবল। প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করতেই থানা ভবনের গেটে দেখা হয় রঙমিস্ত্রি নয়নের সঙ্গে। তিনি একনাগাড়ে রঙ করে চলছেন।
তার সঙ্গে খানিক আলাপে জানা গেল, প্রায় এক মাস ধরে থানার মেরামতে নয়নসহ অনেকেই কাজ করছেন। ঠিকাদারের নির্দেশ দু-একদিনের মধ্যে থানার কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। তাই দ্রুত কাজ করছেন।
নয়ন আরও জানান, থানা ভবনের ভেতরে টাইলস, গ্রিল, গ্লাস, সিলিংসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়েছে। সব কাজ শেষে রঙয়ের কাজ চলছে।
নয়নের সঙ্গে আলাপ শেষে থানা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই রঙয়ের টাটকা গন্ধ নাকে লাগল। ভেতরে দেখা গেল থানার সর্বত্রই নতুনত্বের ছোঁয়া। প্রতিটি কক্ষ গোছানোর কাজ চলছে। নতুন করে আনা হয়েছে আসবাবপত্র। তবে ভবনের ভেতরে থানার কোনো কার্যক্রম চলছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রথমে অন্যত্র কার্যক্রম চললেও বর্তমানে থানার পেছনে থাকা স্টাফ কোয়াটারে চলছে দাপ্তরিক কার্যক্রম।
থানা ভবনের পেছনে গিয়ে দেখা যায়, থানায় কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য তৈরি বহুতল স্টাফ কোয়াটারের নিচতলায় থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ। এই ভবনের সামনে একটি পাকা একতলা ভবনে বসেন ওসিসহ অন্য কর্মকর্তারা। ডিউটি অফিসারের ছোট কক্ষে টেবিল চেয়ার বসানোর পরে বেশি জায়গা অবশিষ্ট নেই। সেখানেই সেবা নিতে আসা দুই নারীর সমস্যার কথা শুনছেন ডিউটি অফিসার।
সেবা নিতে আসা দুই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই থানায় জিডি করতে এসেছেন। অনলাইনের সার্ভার কাজ না করায় হাতে লিখে জিডি করেছেন।
থানার সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, প্রথমে তো থানাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বড় ভবনে গিয়ে দেখি কেউ নাই। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম পেছনের ভবনে থানার কাজ চলছে। পরে এখানে এসে অভিযোগ দিলাম। থানার কর্মকর্তারা আন্তরিক। তাদের ব্যবহার ভালো।
সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়াস উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, থানার সংস্কারের কাজ শেষ না হওয়ার পুলিশ কোয়ার্টার থেকে কার্যক্রম চলছে। থানায় জনবল কিছুটা সংকট রয়েছে পাশাপাশি গাড়ি সংখ্যাও কম। আগে গাড়ি ছিল ৬ থেকে ৭টি, এখন মাত্র তিনটি গাড়ি রয়েছে। এটা দিয়ে টহল ও অপারেশনাল কার্যক্রম চলছে।
তিনি আরও বলেন, এখনো বেশ কিছু সংকট রয়েছে, তবে সীমিত এই সম্পদের মধ্যেই আমরা সাধারণ মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।