‘রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কারের আগে অর্থনীতির সংস্কার প্রয়োজন’

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিপূরক হচ্ছে অর্থনীতি। দেশ গঠনে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কার করতে চাইলে সবার আগে অর্থনীতি সংস্কার প্রয়োজন। অর্থনীতির সংস্কার ছাড়া সামনের দিকে আগানো সম্ভব নয়।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) কর্তৃক বিআইআইএসএস এ আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ; অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা একথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

সংলাপে বক্তারা বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে মিথ্যা। সেখান থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। পরিসংখ্যানকে ঠিক করতে হবে। অর্থনৈতিক কাঠামোকে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। রফতানি পণ্যের বহুমুখিতা বাড়াতে হবে। আয়কর আদায়ের আওতা বাড়াতে হবে। আর অবশ্যই রাজনৈতিক ঐক্যমত ছাড়া এগুলো সম্ভব না। যদি আমরা রাজনৈতিক ঐক্যমত সৃষ্টি করতে পারি তাহলে মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানও করতে পারবো।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ার মুনিরা খান বলেন, দেশ থেকে কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেল, এখানে আমাদের সংস্কার আনতেই হবে। এখনো পাচার চলছে। মিডিয়া এবং ব্যাংক যখন বলে ১০টা ব্যাংক দুর্বল তখন সে ব্যাংকগুলোর লোকেরা তো টাকা উঠিয়ে নিবেই। টাকা তুলে সে হয় বাড়িতে লুকিয়ে রাখবে আর না হয় দেশের বাহিরে পাচারের ব্যবস্থা করবে।

সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, আস্থার সংকট বিগত সরকারের সময় ছিলো, এখনো আছে। আস্থার সংকট কাটাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেটা এই আলোচনার মধ্যে আসছে। সেটা নিশ্চিত না করা গেলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। আবার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে রাজনৈতিক সংকট যাবে না।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের দুটি বিষয় একদম শেষ করে দিচ্ছে- এক ব্যাংকিং সুশাসন, আরেকটি এনার্জি সেক্টর। আমাদের পলিসিগুলোতে সংশ্লিষ্ট যারা আছে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা এমন পলিসি করি যেখানে সম্পৃক্তদের কোন সম্পর্ক থাকে না। ফলে সে পলিসিও বাস্তবসম্মত হয় না। বাস্তবায়নও হয় না।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমরা কেউ স্বস্তিতে নাই। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রিগুলো গ্যাস পাচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সুরক্ষা নেই। আমরা কার সঙ্গে কথা বলবো? এমন অনিশ্চয়তা থাকলে কেউ ভাল থাকবো না।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সবুর খান বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূল হচ্ছে পরিসংখ্যান। দেশের সব পরিসংখ্যান সঠিক চাই। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে পরিসংখ্যান। আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু যাকে ঋণ দিচ্ছি তার ট্যাক্স ফাইলে সে সম্পদ আছে নাকি সেটা দেখি না। পৃথিবীর সবার ক্রেডিট রেটিং আছে কিন্তু আমাদের নাই।

যারা সুন্দর কথা বলে তাদের দরকার নাই। যারা কথা না বলে কাজ করতে পারে তাদের দরকার বলেও যোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন হচ্ছে না। আমাদের মূল কর্মসংস্থান হচ্ছে ইনফরমাল খাতে। ফরমাল খাতে আমাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আমরা অধ্যাপক ইউনূসের ইমেজকে দেখিয়ে তো সেখানে কোন কাজ করছি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, আমাদের জিডিপি ও জনসংখ্যার যে তথ্য সে তথ্য নিয়ে কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন আছে। আগে আমাদের তথ্য ঠিক করতে হবে। তাহলে আমরা পরিমাপ করতে পারবো যে খাদ্যের পরিমাণ কত লাগবে। সেজন্য আমাদের তথ্যের জায়গাটা ঠিক করতে হবে।

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা না আসলে মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়ে। আমরা দেখি রাজনীতিবিদরা হয়ে গেছেন আমলাতান্ত্রিক আর আমলারা রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। আমাদের এখানে ট্যারিফ কমিশন আছে কিন্তু তারা কোন কিছুর দাম নির্ধারণ করে না, সেখানেও সংস্কার আনতে হবে।

বারভিডার প্রেসিডেন্ট আব্দুল হক বলেন, বাজার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কো অপারেটিভ সোসাইটি করতে পারি কি না সেদিকে আমাদের চিন্তা করতে হবে। জাপানের মত শিল্পোন্নত দেশে এখনো কো-অপারেটিভ চালু আছে। ডলারে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে ব্যাংকের ভোল্টে রাখা হয়েছে। অনেকের বাড়িতেও কোটি কোটি টাকা আছে, সেগুলো কিভাবে ব্যাংকে আনা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিতে চায় না, সেক্ষেত্রেও আমাদের পলিসিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেনো তারা ঋণ পায়।

তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অল্প শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোন রোডম্যাপ এখনো আমাদের নেই। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা ইকোনমিক জোন তৈরি করে তাদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করতে পারি।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা বলেন, উপজাতিদের ক্ষেত্রে শুধু বৈষম্যহীন হলেই হবে না, তাদের ক্ষেত্রে পজিটিভ বৈষম্য করতে হবে। তাদের সেফটিনেটের আওতায় আনতে হবে। তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। তাদের নানা রকম সহায়তা দিয়ে আমাদের সবার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে যারা ডিফল্টার তাদের সবাইকে আমরা চিনি, আমরা তাদের আগেও গোপন রাখার চেষ্টা করেছি, এখনো হয়তো করে যাচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যাংক পুনরুজ্জীবিত করতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য আমরা যাদের ঋণ দিয়েছি তাদের ঋণগুলো নিয়মিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা কম করে হলেও যেনো নিয়মিত ব্যাংকে ফিরে আসে, বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্রভা সুভা জামান বলেন, ক্রনি ক্যাপিটালিজমকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে।অন্তর্বর্তী সরকার যতই সংস্কার করুক, সংস্কার ইউনিভার্সাল প্রসেসে না গেলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক কুক্ষিগত করে নিবে।