কোনো নেক আমলই ছোট নয়

  • মাওলানা আহমাদ হুসাইন ইউশা, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘যে অণু পরিমাণও নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে’   

‘যে অণু পরিমাণও নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে’  

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে অণু পরিমাণও নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে অণু পরিমাণও মন্দ কাজ করবে সেও তা দেখতে পাবে।’ -সুরা যিলযাল : ৭-৮

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেমন দামী, তেমনই জীবনের ছোট-বড় প্রতিটি আমলই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। একটি গোনাহ যেমন অনেক বড় বিপদের কারণ হতে পারে, তেমনি একটি বাহ্যত ছোট নেকিও জান্নাত লাভের কারণ হতে পারে। বান্দার অন্তর যদি সমর্পিত হয়, আর আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে সচেষ্ট থাকে, তাহলে ছোট আমলের বিনিময়েও আল্লাহ অনেক বড় সওয়াব দান করেন। পক্ষান্তরে অন্তর যদি উদাসীন হয়, তাহলে ছোট গোনাহও ধ্বংসের কারণ হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করেন না। কোনো কাজ যত ক্ষুদ্রই হোক, আল্লাহর জন্য করা হলে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। আল্লাহ অবশ্যই বান্দাকে তার বিনিময় দান করেন। আর আল্লাহ এমন ‘দাতা’ যে, ক্ষুদ্র বান্দা তার জন্য কিছু করবে, আর তিনি বান্দাকে কিছু দেবেন না; কোনো বিনিময় দেবেন না- আল্লাহর দরবারে এমনটি কখনও হতে পারে না। এ কথাই ওপরের আয়াতে ইরশাদ হয়েছে।

আসলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বান্দার ‘কিছু করা’- এ কথাটির পরিধি কত যে বিস্তৃত হতে পারে, তা যেমন মানুষের ধারণায় নেই, ঠিক তেমনি সামান্য বিষয়ের বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে যে প্রতিদান দেওয়া হয় সে সম্পর্কেও ধারণা নেই। সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে, যতটুকু ধারণা আছে, তার অনুশীলন নেই।

বিজ্ঞাপন

মহান আল্লাহ ‘শাকির’ তথা বান্দার আমলের মূল্যায়ন করেন। কী পরিমাণ ছোট ও ক্ষুদ্র বিষয়ের প্রতিদানও আল্লাহ দান করেন, তার একটি নমুনা হিসেবে নিম্নোক্ত হাদিসটি লক্ষ্য করতে পারি।

ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ঘোড়ার মালিক তিন প্রকার। একজনের জন্য ঘোড়া সওয়াবের কারণ। আরেকজনের জন্য বৈধ আবরণ। আর কারও জন্য গোনাহের কারণ।

ঘোড়া তার জন্য সওয়াবের কারণ, যে ঘোড়াকে আল্লাহর রাস্তার জন্য নিয়োজিত রেখেছে। এমনকি ঘোড়ার মালিক সেই ঘোড়াকে কোনো চারণভূমিতে বেঁধে এসেছে। এই ঘোড়া সেখানে যা কিছু খায় তার জন্য ঘোড়ার মালিক নেকি লাভ করে। ঘোড়াটি যদি দড়ি ছিঁড়ে এক দুই টিলা অতিক্রম করে (কোথাও) মল-মূত্র ত্যাগ করে, তাহলে এই মল-মূত্রও ঘোড়ার মালিকের নেকির কারণ হয়। ঘোড়াটি যদি কোনো নদী অতিক্রম করার সময় পানি পান করে- যদিও মালিকের পানি পান করানোর ইচ্ছা ছিল না- তবুও ঘোড়ার মালিক নেকি লাভ করে। আর যদি কোনো ব্যক্তি স্বচ্ছলতা, বৈধতা ও নির্মুখাপেক্ষিতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ঘোড়ার মালিক হয় এবং ঘোড়ার গর্দান ও পিঠ (অর্থাৎ ঘোড়া সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়ে) আল্লাহর হক আদায় করতে না ভোলে, তার জন্য ঘোড়া বৈধ উপকরণ। পক্ষান্তরে ঘোড়ার মালিকের উদ্দেশ্য যদি হয় গর্ব ও লৌকিকতা এবং অপর মুসলমান থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, তাহলে এই ঘোড়া হবে গোনাহের কারণ।

অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কেউ জানতে চাইল গাধা সম্পর্কে। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো বিধান আমার প্রতি অবতীর্ণ হয়নি। তবে আমার কাছে রয়েছে এমন একটি আয়াত, যা এ ব্যাপারে অত্যন্ত ব্যাপক ও অনন্য। তা হলো, ‘যে অণু পরিমাণও নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে অণু পরিমাণও মন্দ কাজ করবে সেও তা দেখতে পাবে’ (সুরা যিলযাল : ৭-৮)। -সহিহ বোখারি : ৩৬৪৬

হাদিসটি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে উপলব্ধি করা যায়, যে কাজ আল্লাহর জন্য করা হয়; আল্লাহ তা কতখানি ব্যাপ্তি দান করেন এবং তার খুঁটিনাটি বিষয়ের নেকি ও বিনিময় দান করেন। এই হাদিসে ঘোড়ার মালিককে তার ঘোড়ার খাদ্য, পানি এমনকি মল-মূত্র- সবকিছুর জন্য আলাদাভাবে নেকি দান করা হয়েছে। হাদিসের শেষ অংশ থেকে একথা অনুভূত হয়, এমন ব্যাপকভাবে নেকি প্রদান শুধু ঘোড়ার সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেকোনো পশু পালন; বরং যেকোনো কাজ, তা যদি সত্যিকারভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, অন্তরে যদি থাকে সঠিক বোধ ও উপলব্ধি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সব কাজে মুমিনের জীবন হবে উদ্দেশ্যমুখী। আর এই চিন্তা-পদ্ধতি প্রয়োগ করে, জীবনের দৈনন্দিন কাজগুলোতেও সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করতে পারবে। ফলে তার জীবনের স্বাভাবিক কাজগুলো নেক আমলে পরিণত হবে।

এ জন্যই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ছোট ছোট নেকির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত দীর্ঘ এক হাদিসের অংশ এমন, ‘সাহাবি বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নেক কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি ইরশাদ করলেন, কোনো নেক কাজ তুচ্ছ মনে করো না। এমনকি যদি এক পাক দড়ি কিংবা জুতোর ফিতা কাউকে দেওয়ার সুযোগ হয়। অথবা এমন যে, তোমার বালতি থেকে অপরকে পানি ঢেলে দিলে, মানুষ চলাচলের পথ থেকে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিলে, অথবা হয়তো তোমার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হলে আনন্দিত চেহারায়। কারও সঙ্গে হয়ত সাক্ষাৎ করলে সালাম বিনিময়ের উদ্দেশ্যে। এমনকি জমিনের বুকে দুঃখ ভারাক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে সান্তনা দেওয়া...। -মুসনাদে আহমাদ : ১৫৯৫৫

এই হাদিসে মোট সাতটি আমলের কথা বলা হয়েছে। আমলগুলো আলাদাভাবে বিশেষ কোনো নেক আমল নয়; বরং শুধু সালামের উল্লেখ ছাড়া অপরাপর আমলগুলো খুবই সাধারণ এবং যাপিত জীবনের অংশ। অথচ তারপরও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবিকে সম্বোধন করে উম্মতকে সতর্ক করেছেন- ‘কোনো নেক আমলকে মোটেই তুচ্ছ মনে করবে না।’