১০৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ এরশাদ
১০৮ বয়সী কোনো মানুষের শারীরিক বর্ণনা দেওয়া কঠিন। তবে যার কথা বলছি, তিনি এখনও সামান্য চলাফেরা করতে পারেন। চশমা ছাড়া চোখে দেখেন, লিখতে পারেন, পড়তে পারেন। তিনি একজন আলেম। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে আলেম হয়েছেন। তবে পাশের সাল মনে করতে পারেননি।
স্মৃতি থেকে যতটুকু বললেন, তার সারমর্ম হলো- ‘একদল লোক এসেছিলেন তার এলাকায় তাবলিগের কাজে। সেই দলে ছিলেন একজন আলেম। তিনি আমাদের গ্রামের মসজিদে বয়ান করেছিলেন ও খুতবা দিয়েছিলেন। আমি তার বক্তৃতা শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে ওই দলের সঙ্গেই মিয়ানমার থেকে ভারতের ট্রেন ধরেছিলাম।’
মাওলানা মোহাম্মদ এরশাদ। দারুণ একজন ক্যালিগ্রাফার। তিন বছর ধরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছেন। স্মৃতির বাকিসবই আরাকান। কিন্তু আর কী ফেরা হবে সেখানে? জানেন না।
মাওলানা এরশাদ তার ফেলে আসা জীবনের গল্প বলেছিলেন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে। যে গল্পের শেষাংশ শুধুই বিষাদময়। অথচ দারুণ জীবন কাটিয়েছেন তিনি। ৫০ বছর বয়সে ১৯৬২ সাল থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের জাতীয় রেডিওতে তিনি নিয়মিত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেছেন।
দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে রেঙ্গুনের সুফিয়া মাদরাসা এবং জামিয়া ফোরকানিয়ায় হাদিস পড়িয়েছেন। পাঠদানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন মাদরাসার সার্টিফিকেট, কাগজপত্র ও সাইনবোর্ড ডিজাইনের কাজ করতেন। এ বিষয়ে তার বেশ সুনামও ছিল।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এখন তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসে বসে অতীতের স্মৃতি মনে করেন আর উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন। চোখের পানি তো শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। জীবনের শেষলগ্নে এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা ভাবেননি কখনও।
চার সন্তানসহ তার এই উদ্বাস্তু জীবনের শুরু ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস ক্র্যাকডাউনের প্রেক্ষিতে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে দেশত্যাগের দুর্ভাগ্যজনক দিনটির কথা তিনি ‘কখনোই ভুলতে পারবেন না।’
‘সন্ধ্যা থেকেই গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বিনাকারণে সামরিক বাহিনী গুলি চালানো শুরু করে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। লোকেরা ভয়ে দৌঁড়াচ্ছিল, আমি আমার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের একত্রিত করে বলি, যেসব মূল্যবান জিনিস আছে তা সঙ্গে নিয়ে পালাতে হবে,’ বলছিলেন মাওলানা এরশাদ।
পালানোর সময় বৃদ্ধ এরশাদ সঙ্গে নেন তার শখের ও পরম যত্নের ক্যালিগ্রাফির খাতাগুলো। ‘এগুলো আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আমি এগুলো ফেলে আসতে পারি না,’ তিনি বলেছিলেন।
বাংলাদেশে তার আশ্রয় হয়েছে বালুখালী শিবিরে। ক্যালিগ্রাফির এই ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ ক্যালিগ্রাফিতে অসাধারণ দক্ষতার জন্য পরিচিত রোহিঙ্গা সমাজে। শরণার্থী শিবিরে ক্যালিগ্রাফির চর্চা তার কাছে আরাকানের দিনগুলো স্মরণ করার মতো। প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই, তবুও বিভিন্ন রঙের মার্কার কলম আর মোটা সাদা কাগজে এখনও ক্যালিগ্রাফি আঁকেন আপন মনে। কিন্তু কে দেবে তার এই শিল্পকর্মের স্বীকৃতি ও মূল্য?
‘যখন আমি ক্যালিগ্রাফির খাতা নিয়ে বসি, মনে হয় আমি নিজের দেশে ফিরে এসেছি,’ এরশাদ বলেন।
তার পরও ‘প্রতিদিন এক ঘন্টার মতো ক্যালিগ্রাফি আঁকেন’ শখের বসে। তার বেশিরভাগ লেখায় থাকে কোরআন-হাদিসের বাণী। এগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে নেয়। বিনিময় বলতে কাগজ আর মার্কারের দাম।
মোহাম্মদ এরশাদ ১৯১২ সালে মিয়ানমারের মংডু জেলার উদঙ্গপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার একান্ত চাওয়া নতুন প্রজন্মের কাছে ক্যালিগ্রাফি পৌঁছে দেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে আমার কাছ থেকে ক্যালিগ্রাফি শিখেছে আমি আমার মেয়েকেও শিখিয়েছি।’
বালুখালী শিবিরে বসবাসরত প্রায় সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেন। আগ্রহীরা তার কাছে কোরআন-হাদিসের আলোচনা শুনতে যান। রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে এরশাদ হলেন- ওই সব রোহিঙ্গা শিল্পীর মধ্যে অন্যতম, যারা তাদের সৃজনশীল অভিব্যক্তিকে নিজেদের সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের ব্যবহার করে আসছেন।
এই বালুখালী শিবিরে আরও বেশ কয়েকজন সৃজনশীল লোক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬০ বছর বয়সী কাওয়ালি গায়ক বশিরুল্লাহ একজন। শরণার্থীদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। তার জন্ম মংডু জেলার মংলিপাড়ায়। ‘একদিন মর্যাদার সঙ্গে বাড়ি ফেরার এবং সেখানে গান চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন’ এই গায়ক।
আসলে প্রতিভা এমন এক জিনিস, যা কোনোভাবেই গোপন থাকে না। ‘রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আকুতি’ নামের কবিতা লিখে ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ সায়েদুল্লাহ বালুখালী শিবিরে তরুণদের আইকনে পরিণত হয়েছে।
মাওলানা এরশাদ ও বশিরুল্লাহর বিপরীতে সায়েদুল্লাহর পাঠক কেবল রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০১৭ সালে তার প্রথম কবিতা ‘শরণার্থী জীবন’ ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
‘কবিতাটি ছিল আমাদের দুঃখ, যন্ত্রণা ও স্বপ্ন নিয়ে। আমি ফেসবুকে এটি আপলোড করার সময় আমি খুব বেশি প্রতিক্রিয়া আশা করিনি। তবে প্রতিক্রিয়া ছিল বিশাল...। কবিতাটি প্রচুর মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে।’
সায়েদুল্লাহ ১৫ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। বিগত দিনে তিনি ৩০টিও বেশি কবিতা রচনা করেছেন। ‘শিক্ষা আর উন্নত জীবনের প্রত্যাশী’ তরুণ এই কবির মতো আরও অনেক প্রতিভাই শরণার্থী শিবিরে রয়েছে। কিন্তু কে রাখে কার খবর?
-আরব নিউজ অবলম্বনে