ভারতের আসন্ন নির্বাচন: জোট নিয়ে জট পাকছে, খুলছে কই?

  • ঋত্বিক মুখোপাধ্যায়, কলকাতা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ভারতের আসন্ন নির্বাচন: জোট নিয়ে জট পাকছে, খুলছে কই?

ভারতের আসন্ন নির্বাচন: জোট নিয়ে জট পাকছে, খুলছে কই?

 

ভারতে আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ যে কোন মুহূর্তে ঘোষণা করা হতে পারে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলগুলোর প্রস্তাবিত জোট নিয়ে জট খোলার কোন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না, উল্টো জট যেন ক্রমশ পাকিয়েই যাচ্ছে। একদিকে রাম মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিজেপি যত শক্তিশালী হচ্ছে, বিরোধীদলগুলোর প্রস্তাবিত জোট যেন ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যেন ইমারত গড়ে তোলার আগেই ভিত্তি প্রস্তরই ভেঙে পড়ছে। 

বিজ্ঞাপন

বিরোধী জোটের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তার দলবদল তকমার প্রতি সুবিচার করেই যেন এই নিয়ে নবম বার দল বদল করে আবার বিজেপিতে যোগদান করেছেন এবং নিজের মুখ্যমন্ত্রীর গদি বাঁচিয়ে রেখেছেন। জোটের আরেক শরিক ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন জমি কেলেঙ্কারি মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরজেডি প্রধান লালু প্রসাদ যাদব এবং তার পুত্র তেজস্বী যাদবের উপর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সাঁড়াশি আক্রমণ আরও জোরদার হয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপরও তদন্তকারীর সংস্থার খাড়া ঝুলছে। এসব কিছু নিঃসন্দেহে জোটকে দুর্বল করে তুলবে।

কিন্তু এসবের থেকেই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় একতরফাভাবেই জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসা এবং এ রাজ্যে কংগ্রেসের হাত ছেড়ে একলা চলো নীতির ঘোষণা করা। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন জনসভা থেকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানানো শুরু করেছেন। তাকে এমন কথাও বলতে শোনা গেছে যে, এবারে নির্বাচনে কংগ্রেস সারাদেশে চল্লিশটির বেশি আসনও পাবে না। এসব দেখে অনেকেই বলতে শোনা যাচ্ছে জোটের আর তাহলে বাকি রইল কী?

জোট গঠনের প্রাক্কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কিন্তু জোটের স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরদার সওয়াল করেছিলেন।  জোটের প্রথম দিককার বৈঠকে  কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন  খারগের নাম জোটের প্রধান মুখ বা জোটের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। কেউ বারে বারে বলে আসছিলেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রাখা ছাড়া বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকা ছাড়া জোটের সাফল্য সম্ভব নয়। এবং দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র জয়রাম রমেশ ও প্রতিদিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্তুতি গাইছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের  লোকসভার নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী যেভাবে ধারাবাহিকভাবে মমতা এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করে আসছিলেন তার নিন্দা এবং তা বন্ধ করতে বলে রাহুল গান্ধীও প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

এত কিছু সত্বেও একতরফাভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোট ভেঙে বেরিয়ে এলেন কেন? সরকারিভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এ রাজ্যে কংগ্রেসকে দুটি থেকে তিনটি আসন ছেড়ে দিতে রাজি ছিল কিন্তু কংগ্রেস নাকি আরও দুই থেকে তিনটি আসনের দাবি জানাচ্ছিল। তাতেই কি ভাঙল এই জোট? রাজনীতি সচেতন মানুষই জানেন বা স্বীকার করবেন যে, জোট-ধর্মে এই ধরনের দাবি পাল্টা দাবি যাকে ইংরেজিতে বলে বার্গেনিং বা পলিটিক্যাল বার্গেনিং...তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ধরা-ছাড়ার মধ্য দিয়ে জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ নিশ্চয়ই সে সম্পর্কে অবহিত। তাই তার বোধহয় আরও একটু উদারতা বা ঔদার্য দেখানো সমীচীন হত!

অনেকেই এমন কথা বলছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সত্যিই বিজেপিকে সরানোর ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হতেন তাহলে এই উদারতা তিনি নিশ্চয়ই দেখাতেন। এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একতরফাভাবে মমতা-বিজেপি আঁতাত নিয়ে গুঞ্জন রাজনীতির অলিতে গলিতে আরও অনেক জোরদার হবে। অন্যান্য ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে শাসকদলের প্রধানদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি যতটা সক্রিয় পশ্চিমবঙ্গে কি তারা ততটাই? নাকি শুধু বারেবারে সমন দেওয়া এবং ডেকে পাঠানোতেই তাদের দায়িত্ব খালাস হয়ে যায়? এমন প্রশ্ন বা সংশয় কিন্তু বিজেপির অন্দরমহলের একটা অংশ থেকেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু শুধু কয়েকটা আসনের জন্য বা মমতা বিজেপি আঁতাতের জন্যেই  জন্যই ভাঙল এই প্রস্তাবিত জোট যা নিয়ে অনেকেরই অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল?

তিনি জোট ছেড়ে বেরোলে যে এই প্রশ্নগুলো এই সংশয়গুলো দানা বাঁধবে তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ কি জানতেন না বা বোঝেননি? এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন। ৩৪ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক অপেক্ষার পর, এবং লড়াইয়ের পরে, বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে পরপর তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জাতীয় রাজনীতিতে অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চান সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই যে মুহূর্তে তিনি খারগের হাতে বিরোধী জোটের ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন, সেদিনই অনেকে ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোটের ব্যাপারে ততটা আন্তরিক বা সিরিয়াস নন। যেদিন থেকে তিনি নিতীশ কুমারের দলবদলের ইঙ্গিত বা খবর পান, সেদিন থেকেই তিনি এই জোটের নিষ্ফলতার বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যান।

পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটা আলাদা হলেও, রামমন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে দেশ থেকে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে সরানো যে ক্রমশ অলীক স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে সেটা বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন এই পরিস্থিতিতে ‘এলার্জি’ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোটা মোটেই উইন-উইন থাকছে না। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরাধরি হলে কংগ্রেস বরং এই রাজ্যে নিজেদের শক্তি কিছুটা বাড়িয়ে উপকৃত হতে পারে কিন্তু মমতার এর থেকে খুব একটা কিছু পাওয়ার নেই। আর সারাদেশে যেখানে জোটের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, সেখানে তার পক্ষে রাজ্যের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই রাজনৈতিকভাবে সমীচীন এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন যে, মমতা এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক পরিণত, পরিপক্ব এবং তার মতো আমজনতা বা সাধারণ ভোটারের মন বুঝতে পারার ক্ষমতা খুব কম রাজনীতিবিদেরই আছে। তিনি নিরন্তর সরাসরি আমজনতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন। আর তাই তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ফিডব্যাক-নির্ভর।

তিনি যদি তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনড় থেকে নিজের রাজ্য থেকে আরও বেশি সংখ্যক সাংসদ নিয়ে গিয়ে বিরোধীদের মধ্যে একক বৃহত্তম দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন আর বিজেপিবিরোধী দল-জোটগুলো যদি কোনো কারণে ভালো ফল করতে পারে তাহলে বিরোধীদের মুখ হিসেবে তার উঠে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকবে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় বলা হয়, ‘ইটস এ গেম অফ গ্লোরিয়াস আনসারটেইনটিস্। নাথিং ক্যান বি প্রেডিক্টেড আন্টিল দ্য লাস্ট বল ইস বোল্ড।’ শুধু শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে টিকে থাকতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে টিকে থাকতে চান এবং সসম্মানে টিকে থাকতে চান।