মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: ভারতের জয়, চীনের পরাজয়

  • রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত-চীন কৌশলগত দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে নিজেদের মিত্রদের ক্ষমতায় দেখতে চায় এশিয়ার দুই সুপার পাওয়ার ভারত ও চীন। সে ধারাবাহিকতায় মালদ্বীপ নিয়েও ভারত ও চীনের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ ছিল। যাতে শেষ পর্যন্ত ভারতের জয় হয়েছে।

সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনপন্থী আব্দুল্লাহ ইয়ামিনকে হারিয়ে দিয়েছেন ভারতপন্থী বিরোধী দলীয় নেতা ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ। নির্বাচনে ৫৮.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ইব্রাহিম সলিহ। নির্বাচনে নিজেদের মিত্র জয়ী হওয়ায় ভারতও দারুণ খুশি।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনের প্রাথমিক ফল ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দেশটির তৃতীয় প্রেসিডেন্টশিয়াল ইলেকশনের সফলতাকে আমরা স্বাগত জানাই।’

‘নির্বাচনে বিজয় লাভ করায় ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।’

এদিকে নির্বাচনের প্রাথমিক ফল প্রকাশের পর চীন এখনো কোন প্রতিক্রিয়া দেয় নি। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ নির্বাচনের পর কোনদিকে যায় সেটি দেখতে চায় বেইজিং।

২০১৩ সালে ইয়ামিন যখন ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই চীন ও মালদ্বীপের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন গতি লাভ করে। কিন্তু তার প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের যে ঐতিহ্যগত জোট রয়েছে-সেটিও আরো উন্নত হয়।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং মালদ্বীপ সফর করেন। মালদ্বীপের রাজধানী মালের পার্শ্ববর্তী হুলহুয়েতে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশটির চুক্তি হয়।

একই সঙ্গে চীন সেখানে ১.৪ কি.মি দীর্ঘ সংযোগ সেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে, যেটি চলতি বছরের ৩০ আগস্ট শেষ হয়। সেতুটি হুলহুলে ও মালেকে সংযুক্ত করেছে।

শি জিংপিংয়ের সফরের দুইমাস পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি’র স্বপ্নের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিমানবন্দর, সংযোগসেতুর মত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছিল।

২০১৭ সালে প্রায় ৩ লাখ চীনা পর্যটক মালদ্বীপ ঘুরে গেছেন। যেটা বিশ্বের আর যেকোনো দেশের পর্যটকের চেয়ে বেশি। মোট কথা সবদিক দিয়েই চীন-মালদ্বীপ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইয়ামিনের শাসনামলে দারুণ উন্নতি হয়।

শুধু  তাই নয় কৌশলগত দিক দিয়েও সম্পর্ক বৃদ্ধিতে দুই দেশ এগিয়ে এসেছিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে দুই দেশ যৌথভাবে ভারত মহাসাগরের মাকুনুদোহতে ‘জয়েন্ট ওশেন অবজারভেশন স্টেশন’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল।

তখন টাইমস অব ইন্ডিয়াতে একজন বিশ্লেষক লেখেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের মধ্যদিয়ে চীন ভারত মহাসাগরে শিপিং রুট হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত জায়গা পাবে। সেই সঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে চীনা নৌবাহিনীর সম্মুখ অবস্থান আরো কার্যকর  করবে।’

এখন আদৌ বিষয়টা সেটা কি না-অথবা গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লাইনে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য চীনাদের সরল চিন্তাভাবনা কি না-সেটিও দারুণ কৌতুহলের জন্ম দেয়।

কিন্তু মালদ্বীপের বিরোধীদলীয় ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি), যারা সাম্প্রতিক নির্বাচনে সলিহ’র জোটের অন্তর্ভুক্ত, তারা তখন বলেছিল, এ প্রকল্প সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এই প্রকল্প দিয়ে ভারত-চীন সম্পর্কের কৌশলগত রেড লাইন সেদিন চীন অতিক্রম করেছিল যেটি ভারতের প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু  এর  পাল্টা জবাব হিসেবে ভারত কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তখন দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা পরিষ্কার করে কিছু বলেন নি।

আয়তন ও জনসংখ্যা বিবেচনায় মালদ্বীপ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। মাত্র ৪ লাখ ১৭ হাজার মানুষের বসবাস।তবে মাত্র ২৯৮ একর ভূমি থাকলেও হাজারেরও অধিক প্রবাল দ্বীপের দেশটিকে বিশাল সমুদ্র সীমার মালিক করে দিয়েছে।

ভারতের সঙ্গে ভৌগলিক নৈকট্যের কারণে নয়াদিল্লী সবসময় দেশটিতে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে আসছে। যা দ্বীপ দেশটির অস্থিরতা দূর করতে অতীতের ভারতীয় হস্তক্ষেপগুলো দেখলে বোঝা যায়।

১৯৯৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ভারতের ১৬০০ সৈন্য মালদ্বীপে প্রেরণ করেছিল। শ্রীলঙ্কা থেকে আগত তামিল বিদ্রোহীরা তখন দেশটির সরকার উৎখাত করে বিদ্রোহীদের আস্তানা গড়ে তুলতে চেয়েছিল বিধায় মালদ্বীপ সরকারের সহায়তায় ঐ সৈন্য প্রেরণ করা হয়।

তিন দশকের অধিক সময় ধরে- ১৯৭৮ থেকে ২০০৮- মালদ্বীপ মামুন আব্দুল গাইয়ুমের স্বৈরশাসনে ছিল। মামুন ছিল ইয়ামিনের সৎভাই। গাইয়ুমের শাসনামলে দেশটি তাদের পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো হয়।

কিন্তু সে সময়টা দুর্নীতির জন্যও বিখ্যাত। ২০০৮ সালে দেশটির প্রথম সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে গাইয়ুম হেরে যায়, যা ছিল অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক। নির্বাচনে রাজনৈতিক বন্দী, বিরোধী দলীয় তরুণ রাজনীতিবিদ মোহামেদ নাশিদ ক্ষমতায় আসেন।

ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ধরে রাখেন কিন্তু সেই সঙ্গে আরও দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মন দেন। কিন্তু ২০১২ সালে বিতর্কিত পরিস্থিতিতে নাশিদকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে ২০১৫ সালে জেলে যেতে হয়। তখন ইয়ামিন ক্ষমতায় ছিলেন।

নাশিদের গ্রেফতার নিয়ে তখন যে পরিস্থিতি ছিল সেটাকে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ‘রাজনৈতিক প্রভাবিত’ এবং এ জন্য তারা ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিন্দা করেন।

২০১৬ সালে নাশিদকে দেশত্যাগ করে ব্রিটেনে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়, যেখানে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, মালদ্বীপে ‘রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি’ দেওয়ার প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ফিরিয়ে দেয়ার পর যখন দেশে রাজনৈতিক সংকট চলছিল তখন নাশিদ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়।

ভারতকে ‘সামরিক বাহিনীর সমর্থনে’ সেখানে যাওয়ার জন্য ‘যথেষ্ট দাঙ্গাপুলিশ বেষ্টিত’ একজন কর্মকর্তা পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি।

নাশিদ সম্ভবত ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সহমর্মিতা পাওয়ার চেষ্টায় তখন সংকটের জন্য চীনের দিকে আঙ্গুল তোলেন। সামরিক প্রয়োজনে চীনের বিরুদ্ধে দ্বীপ দেশটির ভূমি দখলের অভিযোগ তোলেন তিনি। তার বক্তব্য সংকটকে আরো ঘনীভূত করে।

মালেতে থাকা চীনা দূতাবাস অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতিতে বলেন, ‘এধরনের বক্তব্য এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরু ‘। ‘চীনা জনগণের আবেগকে আহত করেছে এ ধরনের বক্তব্য’।

১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র পরিচালিত চীনা ট্যাবলয়েড পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস খবরের শিরোনাম করে, ‘মালদ্বীপে ভারতীয় সামরিক আগ্রাসন রুখে দেবে চীন’- কিন্তু কিভাবে সেটা করা হবে খবরে বলাও হয় নি- জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়া ‘উপযুক্ত কারণ’ ব্যতীত সামরিক হস্তক্ষেপের কোন পরিস্থিতিও সে সময় সেখানে ছিল না।

তাই ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে যখন সংকট ছিল তখন ভারত সামরিক হস্তক্ষেপের চাইতে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করাকেই শ্রেয় মনে করে।

যখন নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়, তখন শ্রীলঙ্কায় নির্বাসনে থাকা নাশিদ সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।

নাশিদ এখনো এমডিপি চেয়ারম্যান। এমডিপিসহ আরো তিনটি রাজনৈতিক দল ইয়ামিনের বিপক্ষে নির্বাচনে লড়ার জন্য সলিহকে সমর্থন দিয়েছিল। এদিকে আগামী নভেম্বরের আগে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে না। ক্ষমতা হস্তান্তরের এ বিলম্বের জন্য শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।

ইয়ামিনের শাসনামলে যে ভারতের প্রভাব দেশটিতে কমতে শুরু করেছিল তারা অবশ্যই চাইবে যেন সলিহ শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যদিয়ে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে।

ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক স্বার্থে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা দ্বীপ দেশটির নির্বাচনে সলিহর বিজয়ের পর, চীনের ক্ষতির মাত্রা বুঝতে হলে বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া দেখা ছাড়া ভিন্ন উপায় নেই।