দিলীপ কুমার, পরিচালকের চোখে

  • কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার

 

বিশিষ্ট পরিচালক তপন সিংহ কাজ করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমারের সঙ্গে। তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'চলচ্চিত্র আজীবন'-এ দিলীপ কুমার সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ্য করেছেন। সে লেখার কিছু অংশ উপস্থাপন করা হলো:

বিজ্ঞাপন

দিলীপ কুমারের সঙ্গে কাজ করার সুযােগ হয়েছিল 'সাগিনা মাহাতাে' ছবিতে। এই লােকটি সবারই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। লােকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ভালােবাসেন। কখনও একসঙ্গে দুটি ছবি করেননি। বম্বের রেওয়াজ যার যত বেশি ছবি তার তত নাম এবং ততােধিক দাম। যখন দিলীপ কুমার অদ্বিতীয় নায়ক ছিলেন তখনও কোনাদিন একটি বৈ দুটি ছবি করেননি।


তাঁর প্রথম অনুরাগ অভিনয়, তারপর খেলাধুলো। রােভার্স কাপে ফুটবল খেলেছেন। ছাত্রজীবনে কলেজে দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। আজও সকালে ব্যাডমিন্টন খেলেন, বিকেলে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ান নিয়মিত ভাবে।

জাতে পাঠান, কিন্তু অভিনয়ের ধারা ছিল বাঙালি মেজাজের। কারণ প্রথম জীবনে নীতিন বসু, অমিয় চক্রবর্তী, পরে বিমল রায়ের সুদীর্ঘ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত। কত যে কবিতা আর গজল ওঁর মুখে শুনে সন্ধ্যা কেটেছে তা বলে শেষ করা যায় না। যে কোনাে বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উর্দু এবং ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারেন। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দিল্লিতে একই সঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছেন। নেহরুর কাছে অনেক স্নেহ পেয়েছেন।


একটাই বদনাম, সবারই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। শুটিংয়ের দিন কখন যে তিনি আসবেন এ কথা কেউ জানে না। আর যদি সিন পছন্দসই না হয় তাহলে কোনােরকম টালবাহানা করে বিদায় নেবেন, শুটিং আর হবে না। এই ধরনের কথাবার্তা ওঁর সম্বন্ধে বম্বের সিনেমা মহলে প্রচলিত ছিল।

সুতরাং 'সাগিনা মাহাতাে' করার আগে মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম। কার্শিয়াং আউটডােরে প্রথম দিনেই সকালে চার পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার পর যখন শুনলেন, বিকেলেও আবার কাজ করতে হবে, তখন বলাইকে ডেকে চুপি চুপি বললেন, 'আমাকে দিয়ে যদি এত কাজ করাও আমি কিন্তু কালই বম্বে পালাব।'

বলাই তার স্বভাবসুলভ মােটা গলায় সবাইকে যেমন জ্ঞান দিয়ে থাকে, তেমনি দিলীপ কুমারকে সে বলল, 'পরিশ্রম করতে হবে দাদা, নইলে জীবনে কিছু পাওয়া যায়?' উত্তরে বলাই একটা চপেটাঘাত খেয়েছিল।


আস্তে আস্তে কাজের মধ্যে দিয়ে আমাদের ইউনিটের সঙ্গে মিশে গেলেন। তারপর তর তর করে কাজ এগিয়ে চলতে লাগল। অভিনেতা হিসেবে এবং অভিনয় বা শিল্প বা পারফরমিং আর্ট নিয়ে কাজ করতে এমন একটা জিনিস ওঁর মধ্যে দেখেছি যা সত্যিই বিরল। কোনাে একটা শট নেওয়া হচ্ছে। আমার নির্দেশমতাে একটা শট দিলেন। তারপর বিনীত ভাবে বললেন, 'আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আরও দুরকম ভাবে এই অভিনয় করি, এডিট করার সময় যেটা ইচ্ছে লাগাতে পারেন।'

আমি সানন্দে রাজি হই। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি যে, তিন চার বার একই শটে অভিনয় করলেন, তার একটি আর একটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও সংলাপ সেই একই। এ যেন এক খেয়ালি শিল্পী চরম উৎকর্য খুঁজে ফিরছেন। এই যে খোঁজার ব্যাপারটা অর্থাৎ এক্সপ্লোরেশন, খুব কম দেখা যায়।


আগে সহজ সরল স্বাভাবিক ভাবে নীচু সুরে অভিনয় করতেন। কিন্তু ইদানীং বম্বের চলতি প্রথানুযায়ী উঁচু সুরে অভিনয় করছেন। যদি বলি, 'হঠাৎ পেশােয়ারি কুস্তি শুরু করলে কেন?' সােজা উত্তর, ‘টু আর্ন মাই লিভিং।'

এই কথাটি অরসন ওয়েসের মুখেও শুনেছি। বাংলা সাহিত্য, বাঙালি চিত্র পরিচালকদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা তার। প্রায় বলেন, 'আচ্ছা এত জাত থাকতে বাঙালিরা এত ভালাে চিত্র পরিচালনা শিখল কী করে?'

আমি ঠাট্টা করে বলি, 'তােমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। পাঠানরাই তাে মুঘলদের বহু আগে থেকে বাংলাদেশে রাজত্ব করেছে।'

দিলীপ কুমার জাতে পাঠান। আসল নাম ইউসুফ খান। যেদিন কাজ করার ইচ্ছে না থাকে সেদিন ওঁকে দিয়ে কাজ করানাে মুশকিল।