সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের কিছু গল্প

  • বৃষ্টি শেখ খাদিজা, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি অভিনেতা। ৮৫ বছর বয়সে চলে গেলেন পরলোকে। কোনও পুরস্কারই তাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি। খ্যাতি বা অর্থের হাতছানিতে বলিউডের দিকে কখনও মেতে যাননি বড়মাপের এই শিল্পী। বরং বাংলা ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক ও কবিতা অনুসরণ করেছেন তিনি। চলুন জেনে নিই সদ্যপ্রয়াত এই তারকার জীবনের কিছু গল্প।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্রের ম্যাগাজিনের নাম রেখেছিলেন সত্যজিৎ
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের অন্যরকম সখ্য ছিল। সৌমিত্র ও লেখক নির্মল্যা আচার্য ১৯৬১ সালে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন। সত্যজিৎকে এর নামকরণের দায়িত্ব দেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ ম্যাগাজিনের নাম ‘এক্ষণ’ রাখার পাশাপাশি উদ্বোধনী সংখ্যার প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন। সৌমিত্র ম্যাগাজিনটির সম্পাদনা বন্ধ করে দেওয়ার পরও নিয়মিত প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাগুলোর জন্য ছাপচিত্র তৈরি করতেন। সত্যজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি স্ক্রিপ্ট এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

বাতিল হয়ে শুরু
জানেন কি, কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বাংলা ছবি ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’র (১৯৫৭) জন্য ২০ বছর বয়সে স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তখন তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। পঞ্চদশ শতকের রহস্যময় চৈতন্য মহাপ্রভুর বায়োপিক ছিল এটি। পরে এই চরিত্রে অভিনয় করেন অসীম কুমার।

সৌমিত্র-সত্যজিৎ

সৌমিত্রের পরামর্শদাতা
একসময় সত্যজিৎ রায়‌ কিংবা শিশির ভাদুড়ি ছাড়া একটা দিনও কাটতো না সৌমিত্রের। কলেজে শেষ বর্ষে বাংলা নাট্যজগতের প্রবাদ পুরুষ শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক দেখেন সৌমিত্র। তখনই অভিনেতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। শিশির ভাদুড়ির ক্যারিয়ারের শেষের দিকে তার সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হন সৌমিত্র। ১৯৫৯ সালে শিশির ভাদুড়ির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকেই মেন্টর ভাবতেন সৌমিত্র। শিশির ভাদুড়ির একটি মঞ্চ প্রযোজনায় স্বল্প উপস্থিতির একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।

‘অহল্যা’র দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
মঞ্চনাটক ও বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সুজয় ঘোষ পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অহল্যা’য় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন রাধিকা আপ্তে ও টোটা রায় চৌধুরী।রামায়ণে বর্ণিত অহল্যার পৌরাণিক কাহিনীতে অনুপ্রাণিত ছবিটি। তার অভিনীত ছোট দৈর্ঘ্যের ছবির তালিকায় আরও আছে নীলাবজা দাশ পরিচালিত ‘বালির নিচে জলের শব্দ’ এবং সপ্তস্বা বসুর ‘দ্য ফোরলর্ন’।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত মঞ্চ নাটকের দৃশ্য

মঞ্চনাটকে ফেরা
বাংলা ছবিতে টানা ২০ বছর কাজ করার পর ১৯৭৮ সালে নিজের প্রযোজিত ‘নাম জীবন’-এর মধ্য দিয়ে থিয়েটারে ফিরেছিলেন সৌমিত্র। ২০১০ সাল থেকে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ অবলম্বনে জনপ্রিয় নাটক ‘রাজা লিয়ার’-এ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। নাটকটির জন্য সমালোচক ও দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা পান গুণী এই শিল্পী। শুধু অভিনয়ই নয়, তিনি বেশ কয়েকটি নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন এবং কয়েকটি অনুবাদ করেছেন।

ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ফেলুদা ও সৌমিত্র অবিচ্ছেদ্য
সৌমিত্রের চেহারা ও দেহভঙ্গিমা মাথায় রেখে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় চরিত্র লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তার পরিচালিত ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ছবি দুটিতে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেন সৌমিত্র। ফেলুদা ছিল কলকাতার একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। এমনকি সৌমিত্রের দেহাকৃতির ওপর ভিত্তি করে ফেলুদার কিছু ইলাস্ট্রেশন তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাখান
২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ২০১১ সালে দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফ্রান্স সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘লিজিয়ন অব অনার’ পেয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কখনও ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি সৌমিত্র। এর প্রতিবাদে ২০০১ সালে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘দেখা’র জন্য বিশেষ জুরি অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শুধুই সত্যজিতের ছবির অভিনেতা নন
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ৩৪টি  ছবির ১৪টিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের আরও দুই খ্যাতিমান নির্মাতা মৃণাল সেন ও তপন সিনহার পরিচালনায় জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫) ছবিতে প্রতারক চরিত্রে তার অভিনয় ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়। তপন সিনহার ‘ঝিণ্ডের বন্দি’তে (১৯৬১) চালবাজ অশ্বারোহী খলচরিত্রে অনবদ্য নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যুগলবন্দি
সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘অশনি সংকেত’, ‘দেবী’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘গণশত্রু’ ও ‘অপুর সংসার’। ‘অপুর সংসার’-এর পর সত্যজিতের একাধিক ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে দেখা গেছে তাকে।

‘অপুর সংসার’ ছরিব দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

অভিষেকেই বাজিমাত
১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’ ছবির মধ্য দিয়ে অভিষেক হয় সৌমিত্রের। জানেন কি- ‘জলসাঘর’ (১৯৫৮) ছবির সেটে সত্যজিতের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময় তিনি জানতেন না, ‘অপুর সংসার’-এ র জন্য নির্বাচন করা হয়ে গেছে তাকে!