ছোটগল্প

ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যায় মুখ

  • ফরিদুর রেজা সাগর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছোটবেলায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরার কথা অনেকের মনে আছে।

সেটা তো পুকুর-দীঘির মাছ। কখনও কখনও নদীর।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এবারে সমুদ্রের মাছ ধরা! যখন বাইরে গিয়ে জানা গেল বিষয়টা। গহীন সাগরে মাছ ধরার কাহিনি। উত্তাল সাগরের মধ্যিখানে গিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরা! ব্যাপারটি রোমাঞ্চকর। ভাবলেই রোমাঞ্চ কাঁটা দেয় যেন!

বিজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ আছে একটি কথা। লেখা আছে, মাছ বড়শিতে না উঠলে কোনোরকম অর্থ খরচ নেই। অর্থাৎ ছিপটিতে মাছ না উঠলে কোনো ব্যয় নেই। কোনো টাকা পয়সা দেয়া লাগবে না। একেবারে ফ্রি। ছিপ ফেলতে কোনো টাকা খরচ নেই।

গভীর সমুদ্রে ছিপ ফেলে মাছ ধরো। তবে অর্থ ব্যয় নেই কোনো। ব্যাপারটা আরও ইন্টারেস্টিং। মাছ ধরতে না পারলে এমন ‘ট্রিপ’-এর ভাড়া দিতে হবে না একটুও। মানে! এমন জায়গায় ছিপ ফেলো যেখানে মাছ অবশ্যই ধরা পড়বে।

এমন কি বিজ্ঞাপনে এই কথাও বলা আছে, যদি জীবনে কখনো কোনো মাছ ধরতে না পেরে থাকেন, এখানে তাও নিশ্চিন্তে পাবেন। মাছ উঠবেই আপনার ছিপে। এই সুযোগ কে ছাড়ে। বিজ্ঞাপনটি যার চোখে পড়বে তার চোখটি নির্ঘাৎ ছানাবড়া হয়ে যাবে।

একে তো সমুদ্রযাত্রা। সমুদ্রের মাঝপথে গিয়ে ছিপ ফেলো। তারপর সেই ছিপ-এ মাছ ধরার রোমাঞ্চ। কে না রাজি হবে এমন অফারে।
তবে জাহাজ নয়। বড় একটা নৌকা যোগাড় হলো। নৌকা নিয়ে মাঝ সমুদ্রে রওনা হওয়া। আর সেখানেই মাছ ধরা।
মাঝি এলো। প্যান্ট শার্ট পরা। মাথায় সুদৃশ্য ক্যাপ।

মাঝি হেসে বলল- চলুন। তিরিশ বছর নৌকা চালাই। কোনো চিন্তা নাই। আপনারাও যাবেন। আমার নৌকায় গিয়ে সাগরের মাঝে ঘুরে আসবেন। অনেকবার সাগরযাত্রা হয়েছে আমার।

এই সুযোগ কে ছাড়তে চায়। লোকটার অভিব্যক্তি দেখার মতো। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতায় সাফল্যের হাসি ঠোঁটে আর চোখে। পুরো চেহারায় সেই ছাপ ফুটে উঠেছে। সাফল্য তাঁর মুখাবয়ব থেকে ঝরে পড়ছে।

মাঝি বলে, আমার নৌকায় আপনারা দুজনই যাত্রী। চলুন এবার। আজ অন্য কোনো যাত্রী নেই।

আর কথা নেই। রওনা দেয়া হলো। ঠিক আছে চলুন এবার। কথা যখন দিয়েছি তখন তো যেতে হবে।

বিশাল সমুদ্র। নীল জলরাশি চারদিকে। ঢেউ ঠেলে আমরা যত ভেতরে যাচ্ছি, তত সবুজ অঞ্চল সরে সরে যাচ্ছে।

এক পর্যায়ে মনে উঁকি দেয়, চলছি তো আনন্দে। সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ব না তো! মুহূর্তে মলিন চেহারা হয়ে যায় আমার।
মাঝি হেসে উত্তর দেয়Ñ না। এদিকে ঝড়-টর বিশেষ হয় না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

যাচ্ছি তো যাচ্ছি। জাহাজগুলো পাশ কেটে যাচ্ছে। নৌকা সাগরে যেভাবে যায়, ঢেউ আছড়ে পড়ে দুদিকে। কিন্তু মাঝির মুখে কোনো অদল বদল নেই। অনড় মুখাবয়ব তার। একই রকম নির্বিকার, নির্লিপ্ত। তবে হাসি মুখে মাঝি বলল, ভয় পাবেন না। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ। এখানে দুবাইয়ের সমুদ্র।

অনেক শান্ত। আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। গ্যারান্টি দিচ্ছি।

তারপর মাঝি যা বলল, তা শুনে মুখ আমার শুকিয়ে গেল।

শুনেছি বাংলাদেশে নৌকা ডুবে গেলে উদ্ধার করার মানুষ আছে। চারদিক থেকে সবাই ছুটে আসে। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নেই। কেউ ছুটে আসবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

দম আটকে যায় আমার। এতকিছুর পর ধাতস্ত হলাম কিছুটা। বুঝতে পারলাম আমরা নিরাপদে আছি। ঠিকঠাক আছি। এই মাঝির কাছে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ। নৌকাতেও জীবন রক্ষা সরঞ্জাম বিদ্যমান। মাঝিও তার অভ্যস্ত হাত নৌকা বাইছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক চলার পর মাঝি এক জায়গায় নৌকা থামালো। এবারে আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

শুধুই নীল জলরাশি। দূর দিয়ে একটা জাহাজ যাচ্ছে। শাদা রঙের জাহাজ। জাহাজের ঢেউ হয়তো একটু পরে নৌকায় এসে আছড়ে পড়বে। এতক্ষণে আমরা মোটামুটি আস্বস্ত হয়ে গেছি। বুঝতে পারছি আমরা ঠিকঠাক আছি।

সিনেমায় যেমন দেখি, তেমন ধরনের ছিপ। ছিপটা ফেলা হলো। প্রথম দুবার কোনো মাছ নেই। হায়! হায়। মাছ কি শেষ পর্যন্ত ছিপে ধরা পড়বে না? ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে আমাদের? এটা কেমন কথা।

ওদিকে মাঝি মজা করে যাচ্ছে। আপনারা তো মাছের দেশের মানুষ। সেজন্য কি মাছ আপনাদের কাছে আসছে না? অপেক্ষা করেন। আশা করি চলে আসবে। সবুরে মেওয়া ফলে। তাছাড়া বলা আছে মাছ ধরতে না পারলে কোনো ফি নাই।

সময় গড়িয়ে যায়। খবর নেই। খবর নেই। হঠাৎ টান পড়লো। ঢেউয়ের মধ্যে একটা মাছ ঝিলিক দিয়ে ডুবে যায়। নীল রঙের মাছটি। সূর্যের আলোতে নীলই মনে হলো। মাঝি শুভ্র দাঁতগুলো বের করলো। খুব সুস্বাদু মাছ এটা। এই সাগরের বিশেষত্ব এই। এটা এই সমুদ্রেই পাওয়া যায়। আমার সতীর্থ আরেকটা মাছ ধরল। তারপর কয়েক ঘণ্টা চলে গেল। ভালোই লাগলো। মাছটা ছেড়ে দিতে হবে। সমুদ্রের মাছ। সমুদ্রে থাকুক।

মাঝি বলল, ছাড়বেন কেন? সাগরে তো মাছের অভাব নেই। ছেড়ে দিতে চাইলে ছেড়ে দিতে পারেন।
আমরা ছেড়ে দেয়ার জন্য রেডি হই।

আপনারা তো বাঙালি, মাছ খেতে পছন্দ করেন তাই না?
মাথা নাড়ি। হ্যাঁ করি।

যদি আপনারা মাছ খেতে পছন্দই করেন তাহলে অসুবিধা কোথায়?
আমি হাসি।

মাঝি বলল- আপনাদের মাছটা এখানেই ভেজে খাওয়াতে পারি।

অবাক হয়ে বলি-কি বলছ তুমি? এই মাঝ সমুদ্রে ভেজে খাওয়াবে?

সে তো আমার ব্যাপার!
বিস্ময় কাটছিল না আমার।

মাঝি হাসলো। তবে তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে।
সেটা কি?

মাঝি হাসে। আমাকে তো নৌকা ভাড়া বাবদ দুইশ দিরহাম দিয়েছেন। এখন এই মাছ ভাজা বাবদ কত দেবেন?
কত চাও বলো। মাছ ভেজে দেবে। নিশ্চয়ই সেই ভাজার জন্য টাকা দেব।
মাঝি হাসে।

আরেকটু টাকাটা বাড়াতে হবে। যদি না দিতে চান তাও কোনো সমস্যা নাই। কষ্ট হবে আপনাদের?
আমাদের আবার কিসের কষ্ট। কত দিতে হবে সেটা জানা দরকার।

একটা দাম হাঁকল মাঝি। দুইশ দিরহামের সঙ্গে মাছ ভাজার জন্য টাকা।

সে কি কথা! এই মাছ তো আমরা ধরেছি। এখন মাছ ভাজার জন্য আরো কত দেব?

মাছ খাবেন মাঝ সমুদ্রে! একটা ব্যাপার আছে না!

তারপর একটা টাকার কথা জানালো।

একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? এত টাকা? তরপর দফারফা হলো।
যত টাকা চাইলো মাঝি তার অর্ধেক টাকায় রাজি হলো।

আর দর কষকষি না করে মাঝি নৌকার পাটতন থেকে মাছ ভাজার চুলা বের করল। লুকানো ছিল। চুলা মুছে তাতে আগুন ধরাল মাঝি। সমুদ্রে মাছ ধরার নিয়ম আছে। কিন্তু চুলা ধরানোর নিয়ম নেই।
বার বি-কিউ করে দেব মাছের। খেতে মজা পাবেন।

আরও দিরহাম পেলো মাঝি। সেটা পাওয়ার পর যে মুখের পরিবর্তনটা দেখলাম আমরা- দেখার মতো ছিল হাসি।
মানুষের মুখে সুখের অনভূতি, বেদনার অনুভূতি ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। তার উজ্জ্বল প্রমাণ মাঝির মুখটি। মাছের বার বি-কিউ করল মাঝি।
কিভাবে খাবেন? নুন তো আনা হয়নি।

সমুদ্রের জল নোনা। অথচ সেটা স্পর্শ করার সুযোগ নেই। লবন ছাড়া বার বি-কিউ ভক্ষণ?

যত্নে মাছ ভাজা। খেতে হবে নুন ছাড়া? আমরা সেটাই পরম আনন্দে খেলাম সমুদ্রে বসে।

মাঝি কাচুমাচু হয়ে বলল, একটু টাকা কমিয়ে দিবেন।

মাথা নাড়লাম। না, টাকা কমাবো না। লবন ছাড়াই ফ্রেশ মাছ ভাজা খাবো। ভালো লাগবে আশা করি। ভুলেই তো গেছ, টাকা কমানোর দরকার নেই।

মাঝি বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কাজ করব। রুট বদলে যাবো। পয়সা উশুল হয়ে যাবে।

সেটা কেমন?
সমুদ্রের মাঝ দিয়ে ফিরবো না আমরা।
তাহলে?

পাশে একটা লেক পাড়। সেই লেক ধরে আমরা ফিরবো।

সেটার মধ্য দিয়ে রওনা দিলো মাঝি। আপনাদের এই পথে যেতে ভালো লাগবে।

অনেকটা ঠিক যেন প্যারিসের লেক ধরে যাচ্ছ?

ভ্যানিস। প্যারিস না।

সেটা মাঝি জানে না। প্যারিসের নাম জানে।

সেই লেক ধরে খেতে খেতে যাচ্ছেন ধরে নিন।

বাহ! খুব ভালো কথা।

আমরা লেক ধরে যাচ্ছি আর ভাজা মাছ খাচ্ছি।
সেটা দেখে মাঝির মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। আরেক রকম মুখ। একই যাত্রায় নানান রকম মুখ।

একবার ঝড়ের কথা ভেবে আমাদের মুখের রূপ বদলে গিয়েছিল। নুন ছাড়া মাছ ভাজা খেতে হবে ভেবে আবারও রূপ পাল্টে গেল আমাদের।

টাকা পেয়ে মাঝির সে কি আনন্দ। জনমানব শূন্য একই যাত্রায় পাল্টে যাওয়া সব মুখ। বিচিত্র মানুষের মুখের এইসব পাল্টে যাওয়া অভিব্যক্তি। কোনো ধারণাই ছিল না আমার।

নৌকা থেকে নামলাম। মাঝি মিষ্টি হেসে বলল, আমাকে কোনো টিপস দেবেন না?

মাঝির এই কথায় আমরা অখুশি হলাম না। ভালো অংকের টাকার টিপস দিলাম মাঝিকে।

পুরো কান পর্যন্ত মাঝির হাসিটা খেয়াল করলাম।

মাঝি বলল- আপনাকে ছোট মাছ খাওয়াবো। ফেরার পথে এই টিপসের টাকায় বড় স্যামন মাছ কিনে ফিরবো। ম্যালা দিন বড় স্যামন মাছ খাই না। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। মাঝির কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি। বদলে যাওয়া চেহারা।

মনে হলো এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বলছিলাম সেই মুখটি এই মুখ না। এই মাঝি অন্য কেউ। যার মুখে অনাবিল হাসি। সমুদ্রেই কেটে যায় যার সময়। আজকের ট্রিপ শেষে সমুদ্রে থাকে মানুষটি। অনেকদিন পরে একটা বড় স্যামন ফিশ খাবেন মাঝি।