যেভাবে কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি রুদ্ধ হচ্ছে তা আমরা আগে কখনো দেখিনি। ১৯২৯ এ মহামন্দা এক দশক ধরে বজায় ছিল। ২০০১ এর ৯/১১ এর আক্রমণও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ২০০৭- এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাব-প্রাইম বন্ধকী সংকট যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম মন্দার সূচনা করে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ধুকছে। আমেরিকার শ্রম বিভাগ গত দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের দাবি রেকর্ড করেছে- যা ১০ মিলিয়নের কিছু কম।
ভারতের দিকে দেখুন, যেখানে ১.৩ বিলিয়ন লোক লকডাউনে আছে। শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই যেখানে স্ব-কর্মসংস্থানযুক্ত বা একটি দৈনিক মজুরি উপার্জন করে। তাদের মাঝে ১২০ মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিক; যাদের অনেকে এখন চাকরি হারিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকাতে সৈন্যরা ৫৭ মিলিয়ন লোকের বাড়িতে থাকা নিশ্চিত করতে টহল দিচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিভিয়ে গোয়ারুবে মনে করেন বেকারত্বই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ইস্যু। প্রায় অর্ধেক দক্ষিণ আফ্রিকান জনগোষ্ঠীই দরিদ্র। বাস্তবতা হলো তারা যদি কাজে না যায় এবং কাজ না করে তবে তা হবে তাদের খাবার পাওয়া বা না পাওয়ার মাঝের ব্যবধান।'
তাহলে আমরা কীভাবে এই বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেতে পারি? আমরা হয়তোবা জোগান এবং চাহিদা আইনের সঙ্গে পরিচিত। করোনাভাইরাস দুটোকেই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, সরবরাহ খাত ধাক্কা খায় যেহেতু কারখানা, ব্যবসা এবং সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেছে এবং তা চাহিদা খাতের ধাক্কার দিকে ধাবিত করে কারণ শিল্প কারখানাগুলোর কাঁচামালের প্রয়োজন নেই যদি তারা উৎপাদনই না করে। লকডাউন মানে লোকজন জিনিসপত্র কিনছে না অথবা কেনার সামর্থ্য নেই কারণ তারা পয়সা উপার্জন করছে না।
সমস্যাটি চীনে শুরু হয় যেখানে রোগটি ডিসেম্বরে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় এবং জানুয়ারিতে এর বিশাল প্রভাব পড়ে। চীন হল বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের মূলভিত্তি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাই বিকল্প খোঁজা শুরু করে। চীন আন্তর্জাতিক বাজারের একটা বড় ক্রেতাও।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা অর্থনীতিবিদরা এখনো বোঝার চেষ্টা করছেন তা হলো এটা কি 'ভি' আকৃতির মন্দা নাকি 'ইউ' আকৃতির মন্দা অথবা ''এল'' আকৃতির মন্দা। 'ভি' আকৃতির মন্দাতে অর্থনীতির দ্রুত পতন ঘটে কিন্তু দীর্ঘ অর্থনৈতিক কাঠিন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী মন্দার বদলে অর্থনীতি তাড়াতাড়িই ঘুরে দাঁড়ায়। এখন, সবচেয়ে উৎসাহদায়ক খবর আপাতত আমরা যা পেয়েছি তা হলো, চীনের ক্ষেত্রে এটি একটি 'ভি' আকৃতির মন্দা। এখন, চীন যদি তা করতে পারে তাহলে আশা হল যে ইউরোপ আমেরিকাও তা পরে করতে পারবে। ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকানরা নজিরবিহীনভাবে সরকারি সাহায্য লাভ করছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে অস্থির অর্থনীতির জন্য ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে ৩৩০ বিলিয়ন পাউন্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
এই সকল স্বল্পমেয়াদী সুরক্ষা প্যাকেজ হয়তোবা অর্থনীতির ক্ষতি হ্রাস করতে পারে। কিন্তু এই মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ফলে, সরকারগুলোর জন্য কঠিন হিসাব হলো করোনাভাইরাসে মৃত্যু বনাম আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত ৭৫ বছরে বিশ্ব এমন কিছুর সাক্ষী হয়নি। সরকারও এ মাত্রায় কখনো সাড়া দেয়নি। তাই, যদিও এটা ভয়ানক একদিক দিয়ে, তবে এটা আমাদের মানবিক দিকটাও দেখায় যে আমরা আমাদের মৃত্যুর সংখ্যাটাও কমাতে চাই।
মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Sakhawat Hossain wants the responsibility of the ministries in the hands of the EC during election
Case for attack on Khaleda Zia's convoy in Feni, accused 451
'Stadium will be built in the name of Shaheed Asif of Satkhira'
Talk of state reform will not enter the mind in an empty stomach: Hasnat Abdullah
সমকালীন বিষয়াবলী নিয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার’র নিয়মিত আয়োজন ‘দ্য থার্ড ভিউ’-এ আজ প্রকাশিত হয়েছে সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিশেষ নিবন্ধ ‘দ্য ইনডিসক্রিমিনেট অ্যারেস্টস অ্যান্ড মার্ডার চার্জেস’। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য বাংলায় অনূদিত নিবন্ধটি প্রকাশিত হল:
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানতম একটি সমালোচনা ছিল আইনের নির্লজ্জ অপপ্রয়োগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচক ও মুক্তমতের গণমাধ্যমকর্মীদের কারাগারে পাঠানো, হয়রানি আর ভয়ভীতি প্রদর্শণ। রাজনৈতিক সুবিধাবাদী এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর একটি অংশের সাম্প্রতিক কার্যকলাপও এমন ধারণা জন্ম দিতে পারে যে, আমরা একই ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি দেখছি। এতে ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী’ তকমাটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্যক্তিগত শত্রু এবং গণমাধ্যমের একটি অংশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক পন্থায়, অগণতান্ত্রিকভাবে এবং আইনের কাঠামোগত অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতে পারে।
পেশায় সহযাত্রী হিসেবে আমি শুরুতেই বলবো সাংবাদিকদের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তার কথা। সাম্প্রতিক, অবশ্য সর্বশেষ নয়, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে অন্তত ১২৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ঢাকায় ৬০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা, খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা ও বেআইনি সমাবেশের অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রামে ৩৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে দুটি মামলা। বগুড়ায় ২২ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে আটটি মামলা হয়েছে এবং রাজশাহীতে ১৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, চাঁদাবাজি ও লাঞ্ছনার অভিযোগে মামলা হয়েছে তিনটি।
উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করলে দাঁড়ায় আমরা এমন একটি দেশ যেখানে গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক খুনের সন্দেহভাজন আসামি সাংবাদিকরা! কি একটি ভাবমূর্তি! আইনের কী অমোঘ ব্যবহার! গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি কী এক সম্মান প্রদর্শন! এ পর্যন্ত মাত্র চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে বাকিরা সকলেই গ্রেপ্তার বা হয়রানির আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা তাদের কর্মস্থলে যাচ্ছেন না বা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে পারছেন না। তারা লুকিয়ে আছেন বা এমনভাবে বসবাস করছেন যেন তারা ‘গৃহবন্দী’। কেন? তাদের অপরাধটি কি?
আমি প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে, আমার পেশা, যার জন্য আমি ৫২ বছর (মার্চ ১৯৭২ থেকে শুরু করে) উৎসর্গ করেছি, সেটি বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই আত্মঘাতী রাজনীতিকরণের কারণে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং বস্তুনিষ্ঠতার নিরীখে তা সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেখ হাসিনার শাসনামলে। সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে সাংবাদিকদেরই একাংশ নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক কর্মী বনে যায়। তাদের ছদ্মবেশ, নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব নৈতিক সাংবাদিকতাকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। অবশ্য কেউ কেউ তাদের অবস্থানে অনড় থাকতে পেরেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং সাংবাদিকদের একটি অংশ ক্ষমতার নৈকট্য ব্যবহার করে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিজেই একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় স্বীকার করেছেন যে তার পিয়ন, যাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু শাস্তি দেননি, যিনি ৪০০ কোটি টাকার মালিক এবং তিনি তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সাংবাদিকরা কী করেছেন এবং তারা যে সম্পদ গড়েছেন এবং এর ফলস্বরূপ তারা যে জনবিদ্বেষ সঞ্চয় করেছেন তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
আমাদের আবেদন হল, তারা যা করেছে-দুর্নীতি, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রেস অফিস ব্যবহার করা, আমলাতন্ত্রকে চাপ দেওয়া ইত্যাদি, তার জন্য তাদের অভিযুক্ত করুন। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনবেন না। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। তাহলে এটা হচ্ছে কেন?
অন্য সব পেশাজীবী—ডাক্তার, আইনজীবীদের মতো আমরাও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী হিসেবে বিভক্ত। প্রতিটি পক্ষই নির্দ্বিধায় তাদের নিজ নিজ দল ক্ষমতায় থাকার সময় ক্ষমতার নৈকট্যের সুফল ভোগ করেছে। হাসিনা টানা ১৫ বছর সরকারে থাকায় আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের মধ্যে দায়মুক্তি আর সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগের প্রবণতা দেখা দেয়। এতে তারা দুর্নীতিতেও আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে যায়।
তাই এখন যা ঘটছে তা হল ‘অন্য পক্ষ’ যারা আওয়ামী শাসনামলে সম্পূর্ণভাবে নিপীড়িত ছিল, তাদের দিন কাটছে আলোক আভায়। আওয়ামী লীগ নন-এমন সাংবাদিকরা এখন ভালো সাংবাদিকতার প্রতীক এবং তাদের বিরোধীরা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ! সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ! (বিষয়টি এখন যেভাবে ঘটছে তেমনটা আগে কোন পক্ষ কখনোই একে অন্যের প্রতি করেনি।)
আগে যা বলেছি আবারও বলছি: যে কাজের জন্য তারা দোষী তার জন্যই তাদের অভিযুক্ত করুন। কিন্তু বেপরোয়াভাবে, আইনের অযাচিত ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনার মতো প্রহসন করবেন না। এটি দেশে ও সারা বিশ্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সুনামকেই টেনে নামাচ্ছে। কারণ এমন কাজ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের আপোষহীন রক্ষক হিসাবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত যে খ্যাতি তারই বিরুদ্ধে যায়।
বৃহত্তর চিত্রটি আরও মন্দ। গত ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশের ৯২,৪৮৬ জন নাগরিককে জড়িত করে অন্তত ১৪৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়, যার বেশিরভাগই করা হয় খুনের পাশাপাশি অন্যান্য কিছু অপরাধের অভিযোগ এনে। মোট ১১৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ৩৯০ জন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত ৫৯ জন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে মোট গ্রেফতার করা হয় ৭৭৯ জনকে। কিন্তু অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গ্রেপ্তারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৭০১৪ জন (জুলাই-আগস্ট সহিংসতা এবং অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পর্কিত) জনে দাঁড়ায়। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৫০০ টিরও বেশি । দ্য ডেইলি স্টারের একটি খবরে প্রকাশিত তথ্যের হিসাবে গ্রেপ্তারের এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
কতিপয় সুনির্দিষ্ট মামলার বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়ে, যাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কিভাবে এক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ও রাজনীতিকিকরণ করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত আমাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সাকিব হাসান (২২) এবং জাহাঙ্গীর আলম (৫০) -কে হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্টের (এফআইআর) তথ্য অভিন্ন, শুধুমাত্র নিহতদের নাম ও ঠিকানা ভিন্ন। অভিযোগকারী হলেন আবু বকর ( ৫৫), যিনি দাবি করেন যে তিনি বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সদস্য; তিনি ২ সেপ্টেম্বর একই ৪৪২ জনকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করেন। তিনি কে, সে সম্পর্কে নিহতদের পরিবারের কোনো ধারণাই ছিল না। মামলার বিষয়টি জানালে তারা বিস্মিত হন। ‘আমরা আমাদের বাবাকে হারিয়েছি, আমাদেরই মামলা করা উচিত ছিল। অথচ এই ব্যক্তি আমাদেরই প্রতিবেশীদের মধ্যে কয়েক শ' মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছেন। এখন এই মানুষগুলো বিনা কারণে আমাদের ঘৃণা করে,’ এমনটাই ছিলো মামলা দায়েরকারী আবু বকরের বিষয়ে নিহত জাহাঙ্গীরের মেয়ের বয়ান। তিনি আরও বলেন, “আমি আমার বাবার বিচার চাই। যে ব্যক্তি আমাদের না জানিয়ে মামলা করেছে আমরা তারও শাস্তি চাই”। নিহত সাকিবের বাবা মোর্তোজা আলমও বলেন, মামলার কথা শুনে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু অভিযোগ হয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।’
পত্রিকার অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে ২০ ও ২১ আগস্ট সুমন সিকদার (৩১), হাফিজুল সিকদার (২৮) এবং সোহাগ মিয়া (৩০) হত্যার ঘটনায় বাড্ডা থানায় দায়ের করা তিনটি মামলার বৃত্তান্ত। তিনটি মামলার এফআইআর ছিলো একই রকম। এবং সবগুলোতেই ১৭৮ জনকে আসামি করা হয়। অথচ ঘটনা তিনটি ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ।
লাভলু মিয়া (৪১)-কে ৫ আগস্ট ঢাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এক মাস পর, তার চাচাতো ভাই রিকশাচালক দুখু মিয়া উত্তরা পূর্ব থানায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যাদের মধ্যে ২১০ জন তাদের নিজ শহর রংপুরের বাসিন্দা। অভিযুক্তরা বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা।
দ্য ডেইলি স্টার ঢাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত আরও পাঁচটি মামলার তথ্য খুঁজে পেয়েছে যার আসামি কয়েক শত- যারা নিহতদের নিজ নিজ জেলার বাসিন্দা এবং সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মী।
২০ জুলাই, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সদস্যরা গুলি চালালে মুহাম্মদ হাবিব (৪৫) নিহত হন। তার স্ত্রী, চার সন্তানের জননী আয়েশা ২৮ আগস্ট ৫৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন যাদের মধ্যে ৫০ জনই কুমিল্লার চান্দিনার বাসিন্দা। যোগাযোগ করা হলে আয়েশা বলেন, ‘আমি শুধু অভিযোগে স্বাক্ষর করেছি। কাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তা আমার জানা ছিল না... আমি শুধু আমার স্বামীর বিচার চাই।’ গত ৫ আগস্ট জামালপুরের বকশীগঞ্জের আনোয়ার হোসেন আয়নাল তার ভাই ফজলুল করিমের মৃত্যুর ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেন। আসামি ৩৯ জন, যাদের মধ্যে ২৪ জন তার নিজ গ্রামের।
মামলাগুলির এমন দুর্বল ভিত্তি, প্রতিটিতে গড়ে ২০ থেকে ২০০ জন আসামি রয়েছে- অনেক ক্ষেত্রে, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই সেই এলাকার বাসিন্দা যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ফিরে আসার পরিকল্পনা করছে- যা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যকেই নির্দেশ করে। ভুক্তভোগীদের পরিবারের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও এমনটি ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের হয় চাপ দেওয়া হয় বা ক্ষতিগ্রস্তদের বলা হয় যে তারা মামলাটি করলে ন্যায়বিচার পাবেন।
১০অক্টোবর প্রকাশিত আমাদের প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নজরদারি বাড়াতে এবং গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সদর দফতর এই মাসের শুরুতে এসপি এবং মেট্রোপলিটন কমিশনারদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। খুলনা রেঞ্জ পুলিশের একজন পরিদর্শক বলেন, “আমাদের গ্রেপ্তার বাড়ানোর এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের আ.লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।" অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, "নির্দেশনায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সমর্থক ও নেতাদেরসহ লোকজনকে গ্রেপ্তারের জন্য বলা হয়েছে।"
যাকে তাকে গ্রেফতারের এমন অস্পষ্ট আদেশ আইনের অপপ্রয়োগের এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে না হয়ে থাকলেও শিগগিরই এই প্রক্রিয়া চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং সাধারণ মানুষের হয়রাণির উৎসবে পরিণত হবে। হাসিনার শাসনামলেও পুলিশ এই কাজটি করেছে।
আমরা জোর দিয়ে আবার বলছি যে, বিগত শাসনামলের প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকেও যেনো হয়রানি করা না হয়। মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার হল জুলাই-আগস্টের গণজাগরণের স্তম্ভ। অনুগ্রহ করে এমন অবস্থা তৈরি করবেন না যেখানে তার লঙ্ঘনটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানবাধিকারের সমর্থক হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের খ্যাতি ‘দরিদ্রদের ব্যাংকার’ হওয়ার জন্য তার খ্যাতির মতোই শক্তিশালী এবং এটা তিনি অর্জন করেছেন। তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দূরতম অভিযোগটিও ওঠা উচিত নয়।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ভাষান্তর: মাহমুদ মেনন, এডিটর-অ্যাট্-লার্জ, বার্তা২৪.কম
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো বললেন, ‘পঞ্চাশজনের মধ্যে আটচল্লিশ জনই তদ্বির নিয়ে আসেন’ (ইত্তেফাক ১৬.০৯.২০২৪)। অর্থাৎ, তার কাছে বা দফতরে যারা দেখা করতে আসেন তাদের ছিয়ানব্বই ভাগই আসেন কোনো না কোনো কাজ উদ্ধারে অবৈধ ‘তদ্বির’ নিয়ে। এটা সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং কল্যাণরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা ভয়ংকর অসুখ।
কথা হলো তদ্বিরকারীরা আগের মতো সচল হয়ে উঠলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? তোয়াজ-তোষণ তদ্বিরের দ্বারা অপরের ‘হক’ কেড়ে নেয়া হয়। তদ্বিরের মাধ্যমে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতিকে প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। এতে প্রকৃত মেধাকে চরম অবমূল্যায়ন ও অপমান করা হয়। এর ফলে অফিস-আদালত, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্ণারে বৈষম্য মাধা চাড়া দিয়ে উঠে। এর ফলে অরাজকতা তৈরি হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভাঙন ধরে। যেটা কিছুদিন আগে আমাদের দেশে প্রকট নামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করে সামাজিক বিপ্লব সূচিত করেছিল।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়কদের কাছে যদি শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগ মানুষ তদ্বির নাম ভয়ংকর অসুখের বার্তা নিয়ে হাজির হবার সাহস পায় তাহলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে কি অরাজকতা চলছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষায় নেই। তা হলে পরিবর্তন হলো কোথায়?
পদোন্নতি নিয়ে সচিবালয়ে আমলাদের মধ্যে মারামারি করার চিত্র মাত্র কয়েকদিন আগের। আগে যারা তোয়াজ-তোষণ তদ্বিরের দ্বারা লাইম লাইটে থাকতো তারা এখন অবস্থা বেগতিক আঁচ করতে পেরে বঞ্চিত, নিরীহ সহকর্মীদের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করছেন না। আগে সরবে, গোপনে ঘুষ, পুকুরের ইলিশ, ভেটকি, খামারের খাসি-গরু উপহার দিয়ে তদ্বির করে কাজ উদ্ধারে তৎপর ছিলেন তারা এখন সরাসরি মারামারি করতে দ্বিধা করছেন না। জাতি এখন এসব দৃশ্য আর দেখতে চায় না।
তাই পুরনো সব নিয়মকানুন, অন্যায়ের তালিকা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে নতুনভাবে সবকিছু ঢেলে সাজাবার সময় এসেছে। একটি ন্যায়ানূগ নীতিমালা অনুসরণ করতে অপারগ হলে জাতি আবার আপনাদেরকে ধিক্কার দেবে অথবা ধাক্কা দিতেও দ্বিধা করবে না!
বছর খানেক পূর্বে একটি এক্সট্রা-একাডেমিক সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেটি একটি নামকরা সভা ঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। অতিথিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সভা ঘরটি। তবে বক্তার সংখ্যাও ছিল অনেক। মঞ্চের সীমিত আসনে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আরো কিছু নতুন আসন পেতে বক্তাদের বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছিল। বক্তাদের ভীড়ে উপস্থাপকের ডেস্ক পর্দার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল। উপস্থাপকের হাতে থাকা পূর্বনির্ধারিত বক্তাদের চেয়ে আরো অনেক নতুন বক্তা আসায় তিনি বার বার নাম ভুল করে উপস্থাপন করছিলেন এবং নেতাদের ধমক খাচ্ছিলেন।
আমিও সেখানে একজন বক্তা ছিলাম। আমার সেখানে মাত্র একঘণ্টা থাকার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ আসনে বসে অপেক্ষা করার পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হলো। সময় পেরিয়ে যাবার পর একেকজন রাজনৈতিক নেতা গোছের কেউ এলে তাকে তোয়াজ করে উচ্চস্বরে স্লোগান দিয়ে মঞ্চে তুলে নতুন চেয়ার পেতে ঠেলেঠুলে বসিয়ে দেয়া হচ্ছিল। একজনের ফুলের তোড়া ছিনিয়ে নিয়ে অনির্ধারিত আরেকজনকে প্রদান, একজনের গলার উত্তরীয় টেনে খুলে নিয়ে আরেকজনকে দেয়া- ইত্যাদি করে সে এক বিশ্রি পরিবেশ ও বিরক্তিকর অবস্থা দেখার অভিজ্ঞতা সেদিন হয়েছিল।
এরপর যা ঘটতে থাকলো তা হলো- অনাহুত বক্তাদের হাতে সময় নেই। তাদেরকে আগে বক্তব্য দিতে সময় দিতে হবে! সেটাই করতে হলো।
কিন্তু তারা বক্তব্য শুরু করার পর আর থামার নাম-গন্ধ নেই। একাডেমিক বিষয়ের বক্তব্য না দিয়ে তারা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সময় ক্ষেপণ করে ফেললেন। তাদের কথা শেষ করেই একে একে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যেতে থাকলেন। ইতোমধ্যে বিরক্ত হয়ে দর্শক-শ্রোতাদের অনেকেই সভাস্থল ত্যাগ করে চলে গেছেন। ফলে সভার মূল বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত সেদিন তাদের কানে পৌঁছানোর সুযোগ হয়নি।
আরেকদিনের ঘটনা কিছুটা শেয়ার করি। সেখানে বক্তারা মঞ্চের প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথিদেরকে বার বার একই সুরে এত বেশি সম্বোধন করে বক্তব্য শুরু করেছিলেন যে, বরাদ্দকৃত সময়ের উপর তাদের কারো কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় সব বক্তা বার বার একই বিশেষণ ব্যবহার করে শুরুট অতি লম্বা করে ফেলায় এক চরম বিরক্তির অধ্যায় সূচিত হয়েছিল সেদিন। শ্রুতিকটু, দৃষ্টিকটু, অসহ্যকর বিষয় ছাড়াও তোয়াজ-তোষণের মাত্রা এত বেশি সীমা ছাড়িয়ে গেছে যে অনেক অতিথি তাদের জবাবে সেটাকে ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ বলতে দ্বিধা করেননি।
কথা হলো, কোনো সভায় বার বার কাউকে এই ভাষায় সম্বোধন করে বিরক্তি সৃষ্টির কালচার কেন? জাতি হিসেবে আমরা তোয়াজ-তোষণকে পছন্দ করি বলে কি এই বদভ্যাস চালু রাখতে হবে?
এর মূল কারণ অন্য জায়গায়। আমরা এমন কিছু বদঅভ্যাসকে আত্মস্থ করে ফেলেছি যেগুলো নিয়ে সমাজে অনেক ঘৃণিত প্রবাদ প্রবচন চালু রয়েছে।
যেমন বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে উষ্মা ও তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আমাদের মজ্জাগত। ‘ন’ টার ট্রেন ক’টায় ছাড়ে’ প্রবাদটি অতি আধুনিক যুগেও আমাদেরকে তাচ্ছিল্য করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এই অপবাদ বিদূরিত করার উপায়ও আমাদের নেই। কারণ এখনও আমাদের দেশের সচল নার্ভাস সিস্টেম বা অবিচ্ছন্ন বিদ্দুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সময়জ্ঞান ট্রাফিককে খেয়ে ফেলেছে।
সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু করতেই হিমশিম খাচ্ছি। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারাটা এখনও আমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়েই গেছে!
তোয়াজ-তোষণের মাত্রা প্রতিটি সেক্টরে দুর্গন্ধ ছড়ায় আর সময়জ্ঞানের উদাসীনতা সেই দুর্গন্ধকে আরো ঘণীভূত করে তোলে। তাই এই বিষয়টি আজকাল অতি গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে।
এই অতিথিকে বার বার তোষণের মাধ্যমে অযথা সময় ক্ষেপণ করা পরিহার করার সময় এসেছে। এআই যুগে কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না?
কোনো কিছুতে তোয়াজ-তোষণের মাত্রা বেশি হলে সময়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে। তবে এআই যুগ এসও অনেকের কাছে তোয়াজ-তোষণ করাটা ভাল লাগে। তাই অপরের কাজের ক্ষতি করে তাদের জন্য সময় বাড়ানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় চারদিকে ক্ষতির মাত্রা বেড়ে গিয়ে মূল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠে।
আরও একটি অনাচার আমাদের মজ্জাগত হয়ে উঠেছে। অনেক বিচিত্রানুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা, কনসার্ট, ইত্যাদি কোরআন তেলাওয়াত ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’বলে শুরু করা হয়। এরপর ভেতরে শুরু হয়ে যায় গান-বাজনা, অশ্লীল উদ্দাম নৃত্য। এই বৈপরীত্য কি কোন অনুষ্ঠানে বরকত নিয়ে আসে? তা আমার বোধগম্য নয়। যেটা যে চরিত্রের অনুষ্ঠান, সেটা সেই বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু ও শেষ করা উচিত। যে কোন জায়গায় মুসলিমদের কাজে কর্মে মনগড়া চিন্তার বাস্তবায়ন ও মোনাফেকী প্রদর্শন করা অনুচিত।
মূল কথা হলো- যে কোন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্সে একই ব্যক্তিকে সব বক্তা বার বার একই কায়দায় সমম্বোধন ও তোষণ না করে বরং সময়ের অপচয় রোধ করা উচিত।
সময়মতো অনুষ্ঠান শেষ হওয়া উচিত। অনুষ্ঠানের আউটপুট নিয়ে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। যথার্থ আউটপুট ছাড়া সভা অনুষ্ঠানের দরকার কি তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে, সাজ সজ্জা করে বাহারি স্লোগান দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দিনকে বিদায় জানানো উচিত।
কোটি কোটি টাকার অপচয় করে কনভোকেশন করার দিন শেষ ঘোষণা করা উচিত। এখনো অক্সফোর্ডের বারান্দায় টেবিল সাজিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কনভোকেশনের সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। আমাদের দেশে ৫-৬ কোটি টাকা ছাড়া কনভোকেশনের মঞ্চ তৈরি ও ডামাডোল শেষ করা যায় না। অথচ, শিক্ষার্থীদের ক্লাশরুম নেই, বই নেই, পড়ার টেবিল নেই, কম্পিউটার নেই, শোবার ঘর নেই, ডাইনিংয়ে মানসম্মত খাবারে ব্যবস্থা নেই, মেডিক্যাল সেন্টারে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। প্রতিবছর কনভোকেশনের এই পরিমাণ টাকা দিয়ে একেকটি নতুন আবাসিক হল নির্মাণ বা পরিবহণের জন্য নতুন এসি যানবাহন কেনা সম্ভব। মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা এবং গবেষণার কাজে সেই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ই নয় দেশের সকল পেশাদারী, সেবাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে সময় অপচয়ের কৃষ্টি অচিরেই নি:শেষ করার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবী রাখে।
তাই একজনকে অতি সম্বোধন-তোষণ কৃষ্টি আর নয়। বার বার অতি সম্বোধন করে বিরক্তি সৃষ্টি নয়, সময় ক্ষেপণ করে অপচয়ের কালচার জিইয়ে রাখা আর নয়। মূল কাজে দ্রুতগতি ফেরানোর সময় এখন। দেশ গড়ার সময় এখন এআই-এর তালে সামঞ্জস্য রেখে। তা-না হলে আমরা বার বার হোঁচট খেতেই থাকবো।
সবাই মাত্র একদিনের জন্য বা নিদেনপক্ষে একবারের জন্য হলেও অতি সম্বোধন- তোয়াজ-তোষণ, তদ্বির কৃষ্টির বিরুদ্ধে কথা বলি, অপরের ন্যায্য ‘হক’ নষ্ট করে স্বার্থপর না হই। এছাড়া যে কোন একাডেমিক প্রোগ্রামে, সেমিনারে, সভায়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অর্থের অপচয় রোধ ও কাজের সময় বাঁচানোর জন্য এটা হতে পারে একটি যুগান্তকারী উদাহরণ।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা হলেও তাদেরকে সেদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাদের নিজস্ব রাজ্য আরাকানের নামও বদলে রাখা হয়েছে রাখাইন রাজ্য। রোহিঙ্গাদের গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতাড়িত করা পর মিয়ানমার এখন জোরোসোরে প্রচার করছে যে, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিকই নয়। তারা অবৈধ ভারতীয়/মুসলিম/বাঙালি অভিবাসী। এখন বলা হচ্ছে তাদের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখান থেকে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল।
ভারতীয় গবেষক শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি ৫ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে ‘রোড ফর রাখাইন: আনসার্টেইন ফেট অব রোহিঙ্গা‘ শিরোনামে এক লেখায় জানাচ্ছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দ্বারা "অবৈধ বাঙালি অভিবাসী" হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ তারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়।
দিল্লির অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি রোহিঙ্গা বিষয়ে একাধিক লেখার রচয়িতা এবং মিয়ানমার সরকারের নানা ভাষ্য ও তথ্যাবলি তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে, তাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে দেয়। ফলে তারা শিক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা, পেশা, এমনকি বিবাহের মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তারা সময়ে সময়ে এলোপাতাড়ি গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক শ্রম এবং সম্পত্তি দখলের সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক গণহত্যার শিকার হয়ে দেশত্যাগেও বাধ্য হয়।
রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও দেশ থেকে বিতাড়নের বিষয়গুলোকে জায়েজ করতে মিয়ানমার গোড়া থেকেই তাদেরকে অবৈধ ভারতীয়/মুসলিম/বাঙালি অভিবাসী বলছে। যদিও সাবেক বার্মা ও মিয়ানমারের ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইতিহাসে দেখা যায়, বার্মার রাজনৈতিক ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। ব্রিটিশের কবল থেকে বার্মাকে মুক্ত করতেও রোহিঙ্গারা বীরোচিত ভূমিকা পালন করেছে ও সে দেশের শাসনতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। তবে পরবর্তীতে এই সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠী বার্মার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রধান জাতিগুলোর দ্বারা বৈষম্য ও নির্যাতন কবলিত হয় এবং নানা সময়ে আক্রান্ত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে আসতেও বাধ্য হয়, যাদের সিংহভাগই বাস করছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে।
বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বার বার বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রাষ্ট্রহীন ও নাগরিকতাহীন উদ্বাস্তু হিসাবে কমপক্ষে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে। এদের কারণে বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট নানামুখী সমস্যা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে জটিল আকার ধারণ করছে। এরই মাঝে এখন বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখান থেকে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল।
কেন রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলা হচ্ছে? এই বিষয়টি নতুনভাবে ধীর লয়ে বলা হলেও বাংলাদেশের নীতি নির্ধারক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের তরফে তা মোটেও উপেক্ষা করার বিষয় নয়। কারণ, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে থেকেই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও তীব্র ও সংঘাতময় হয়েছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের মতো আরেকটি তৃতীয় পক্ষকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার মতলব খুবই মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এতে:
১) মিয়ানমারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বদলে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলে সেখানে পাঠানোর ব্যাপারে চাপ দেওয়ার সুযোগ বাড়বে।
২) পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত উত্তেজনা রোহিঙ্গাদের কারণে আরও অগ্নিগর্ভ হতে পারে।
৩) এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যন্ত প্রসারিত বাংলাদেশের কৌশলপূর্ণ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চরম নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
এসব কারণে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের নানা পদক্ষেপ, বক্তব্য ও কৌশল বাংলাদেশের তরফে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করে কার্যকরী প্রতি-ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে:
১) রোহিঙ্গারা যে অনাদীকাল থেকে মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের ভূমিপুত্র বা আদিবাসী, তার ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত হাতে রাখতে হবে।
২) রোহিঙ্গা জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি যে মিয়ানমারের মূল জাতিসত্তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার দালিলিক প্রমাণগুলোকে তুলে ধরতে হবে।
৩) নির্যাতিত হয়ে নিছক আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ ও ভূখণ্ডের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যে আদৌ কোনও সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই, এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করতে হবে।
৪) আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিজ দেশের রোহিঙ্গা নাগরিকদের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।
৫) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এরই সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশকে পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে, যাতে সেখানকার সশস্ত্র ঘটনার প্রভাব রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে না পারে। যদিও এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলে মিয়ানমারের সরকার বিরোধী আরাকান আর্মি-এর কর্তৃত্ব ও প্রভাব যতই বাড়ছে রোহিঙ্গারা ততই বিপদে পড়ছে। কারণ, আরাকান আর্মি কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, মিয়ানমারে তথা রাখাইনে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, সেখানকার সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে প্রতিদিনই অল্প অল্প করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানকার গোলা-বারুদ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূমিতে এসে জান-মালের ক্ষতি সাধন করছে। উপরন্তু কক্সবাজার টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকারকালে বাংলাদেশের জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক জলসীমানা লংঘন করার মতো ঘটনাও আকসার ঘটছে মিয়ানমারের তরফে।
ফলে পুরো পরিস্থিতিকে মিয়ানমার নাজুক করছে এবং অমীমাংসিত রেখে নানা ধরনের জাতীয় ও আঞ্চলিক বিপদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমতাবস্থায়, ভবিষ্যতহীন রোহিঙ্গা নাগরিকদের যে বিপুল অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে, তাদের পদক্ষেপ ও মনোভাব নজরে রাখা আবশ্যক। অনিশ্চয়তার কারণে তারা কোনও হটকারি পথে অগ্রসর হলে কিংবা কোনও সুযোগ সন্ধানী পক্ষ তাদেরকে বিপথগামী করে উত্তেজনা ও সংকট বাড়িয়ে তুললে তার দায় কে নেবে? স্বদেশে ফেরার কোনও আশা না দেখে মিয়ানমারের কথা মেনে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে নজর দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
আশার কথা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক ফোরামে সরব আছে। এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিপদ আরও বাড়লে আশার জায়গা দখল করবে হতাশা ও অনিশ্চয়তা। ফলে সরকারের তরফে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা বিষয়ে অধিকতর মনোযোগ দেওয়ার দরকার আছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘...কার নিন্দা কর তুমি/...এ আমার এ তোমার পাপ’ । বিংশ শতাব্দির সমাজ বাস্তবতায় লেখা সেই কবিতার পঙতিতে সমকালীন বাস্তবতাও যে অতি স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গতকাল বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বর্তমান সমাজের এক চরম সত্যকে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি ৪০০-৫০০ শিক্ষক; যারা সবাই উপাচার্য হতে চান! কেউ পড়াতে চান না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই প্রবৃত্তি যে আমাদের অজানা ছিল তা নয়। তবে সরকারের দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি যখন শিক্ষকদের সেই প্রবণতা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন ক্ষোভের সঙ্গে, যিনি নিজেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন-তখন বিষয়টি আরও একবার আমাদের ভাবিয়ে তুলে।
ঐতিহ্যিক পরম্পরায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বনাগরিক গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সেই ‘ঐতিহ্যে’ চিড় ধরেছে। চিড় ধরেছে তখনি যখন থেকে শিক্ষকরা বিষয়বুদ্ধিতে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেন, বলা যায় বৈষয়িক আকাঙ্খায় নীতিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষা ও গবেষণা থেকে দূরে সরে যাওয়ার এই অভিযোগ উঠতে দেখেছি আমরা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এই অভিযোগের তীর ছোড়া হলেও এর দায় কি কেবল শিক্ষকদেরই ঘাড়েই বর্তায়-এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর উত্তরও দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের ‘রাজ’ নীতি কিংবা তাদের যে শিক্ষা ভাবনা, সেখানেই কি বড় ব্যত্যয় রয়ে যায়নি? হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত কি কারও অজানা?
রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া শিক্ষকদের মাঝে ‘রাজনৈতিক অভিলাষ’ সৃষ্টি হওয়া যে অসম্ভব কিছু নয় তা বোধহয় কারও মানতে কষ্ট হবে না। কিন্তু এ কথাও তো বলা যায় যে, পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এক সময় গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র মতো প্রাতঃস্মরণীয় গবেষকরা ঔপনিবেশিক যুগে অপ্রতুল গবেষণা বৃত্তি ও সীমিত সুবিধার গবেষণাগারে গবেষণা করেও আমাদের জন্য রেখে গেছেন অমূল্য সব গবেষণা সম্পদ।
এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সেই পরাম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন, আলোকিত করতে পারতেন বিদ্যাপীঠগুলোকে। আগামীর জন্য রেখে যেতে পারতেন অগণিত গবেষককে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের অনেককেই (সবাই নন, কেননা এখনও অনেক শিক্ষক আছেন যারা স্রোতের বিপেরীতে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন) পেয়ে বসেছে প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার মোহ। এই মোহ তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমনি অবজ্ঞার আসনে, যেখানে তাঁরা কেবল নিজেরাই ডুবছেন না আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ডুবাচ্ছেন।
গতকাল একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের একজন শিক্ষক ও গবেষক। নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতায় তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠে আক্ষেপের সুর! তিনি বলছিলেন, একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহের মাঝেও যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষপদে নিযুক্ত হলেন তারা কিভাবে কোন বিবেচনায় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের মতো পদগুলোতে আসীন হয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
তিনি বিস্মিত, কারণ এসব পদে পদায়নের জন্য যে নীতিমালা রয়েছে কিংবা বিশ্বজুড়ে যে মানদণ্ড রয়েছে তা লঙ্ঘিত হয়েছে! তিনি স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি যে এইসব নিয়োগেও মেধা কিংবা গবেষণা সাফল্য নিয়োগের মানদণ্ড হয়নি। এমন শিক্ষকরাও উপ-উপাচার্য হয়ে গেছেন যারা আরও ১৫ বছর শিক্ষকতা করবেন।
উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ওই শিক্ষকের দাবির সঙ্গে পূর্বের পেশাগত অভিজ্ঞতাও মিলে যায়। বছর তিন আগে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে অনিয়ম অনুসন্ধানে জানা গেল, পুলিশের একজন উচ্চ পদস্থ কর্তাব্যক্তি সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে।
এও জানা গেল যে, কোষাধ্যক্ষ পদপ্রত্যাশী একজনের আপন ভাই তিনি। আরও জানতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান বেশ কয়েটি প্রকল্পের ঠিকাদাররা অন্যায় সুবিধা নিয়ে সেই সময়ের দায়িত্বপালনরত উপাচার্যকেই স্বপদে টিকিয়ে রাখতে অন্ততঃ ৪-৫ কোটি টাকার তহবিল গড়েছেন, যা ইউজিসি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্তাদের দেওয়ার হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকই এ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য জানিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন যখন গণমাধ্যমে আসে তখন প্রতিবেদককে একজন সংসদ সদস্য ফোন করে ওই উপাচার্যের সঙ্গে সমঝোতার অনুরোধও করেছিলেন।
পূর্বাপর এমন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে করা মন্তব্যকে সত্য ও সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি হওয়া এই অচলায়তন ভাঙবে কে? জাতির অন্ধকার দূর করে আলোর পথে আনবেন যে শিক্ষকরা তাদের মনের অন্ধকার প্রবণতা দূর করবে কে?
আমরা জানি, এ প্রশ্নের উত্তর বেশ কঠিন। তবে আপাতদৃষ্টিতে, আমরা ধারণা করতে পারি-রাষ্ট্রপরিচালনায় ভূমিকায় অবতীর্ণ রাজনৈতিক শক্তিকে শিক্ষকদের হাতিরয়ার করার প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ইনস্টিটিউশনগুলো পরিচালনায় ডাইভার্সিটিকে (বৈচিত্র্য) যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো উন্নতির যে শিখরে পৌছেছে তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বৈচিত্র্যকে ধারণ করার প্রবৃত্তি। সমমতের না হলেও যোগ্য ও কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষাবিদদের যখন আমরা বেছে নিতে পারব তখন আমাদের বিদ্যাপীঠের নেতৃত্বে; তখনি হয়ত শিক্ষা ও গবেষণা ঐতিহ্যিক পরম্পরা ফিরবে তার আপন মহিমায়।