মধ্যবিত্তের পেঁয়াজ কাহন!

  • মানসুরা চামেলী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মানসুরা চামেলী, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

মানসুরা চামেলী, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আব্দুর রশিদের নিম্নমধ্যবিত্তের সংসার। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ আর সংসারের ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে মাস শেষে ধারকর্জের জন্য হাত পাততে হয় সহকর্মী বা বন্ধু মহলে। এভাবেই টেনেটুনে চলছিল তার সংসার।

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দৌড়ে ইদানীং একবারেই হাঁপিয়ে উঠেছেন আব্দুর রশিদ। এই চড়া মূল্যের বাজারে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পেঁয়াজ’!

একদিনের ঘটনা—অফিসে কর্মব্যস্ত দিন শেষে রাতে বাসায় ফিরলেন আব্দুর রশিদ। স্ত্রী জানালেন, ঘরে পেঁয়াজ শেষ! আব্দুর রশিদ বললেন, কয়দিন আগেই না এক কেজি পেঁয়াজ আনলাম, তুমি এরমধ্যেই শেষ করে দিলে! প্রত্যুত্তরে স্ত্রী একবারে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘এক কেজি পেঁয়াজে কতদিন যায়! তরকারিতে পেঁয়াজ না হলে তোমার ছেলে-মেয়েদের রুচিই হয় না।’

চুপ করে গেলেন আব্দুর রশিদ। জামা-কাপড় ছাড়িয়ে খেতে বসলেন। তরকারি পেঁয়াজ দিয়ে ‘মাছভুনা’- দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুললেন। স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে? জানো পেঁয়াজের কেজি কত? মাছ কি সবজি দিয়ে রান্না করা যেত না।’ বিবাদে স্ত্রীও থেমে নেই, শুরু অশান্তি।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রহমান সাহেব। যা মাইনে পান তা দিয়ে কোনো রকমে চলে সংসার। সময় পান না বলে স্ত্রীকে দিয়ে বাজারটা সেরে নেন। তবে প্রতিদিন খবর দেখে বাজার মূল্যটাও জেনে নেন। ‘সেঞ্চুরি মারল পেঁয়াজ; দেড়শ পেরিয়ে পেঁয়াজ’—এমন খবর যত পড়েন আর ততই আঁতকে ওঠেন। এই বেতনে এত দাম দিয়ে যদি পেঁয়াজ কিনে খেতে হয়, তাহলে তো ‘মাঠে মারা যাবেন’!

বিজ্ঞাপন

তাই সকালে অফিসে রওনা হওয়ার সময় স্ত্রীকে একটা কথা বলতে মোটেও ভুলেন না রহমান সাহেব। ‘শোনো, বাজারে পেঁয়াজের আগুন দাম, অল্প কিনবা, তরকারিতেও বেশি দিবা না’! স্ত্রী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি জানিয়ে দেন। মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রীর বলা ‘পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্না’ এই উপদেশও কপচান রহমান সাহেব।

তবে এক ছুটির দিনে ঘটল বিপত্তি! রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বললেন, দুপুরে গরুর মাংসভুনা আর খিঁচুরি খাবেন। ছুটির দিন দুপুরে তার চাহিদা মতো রান্নাও কমপ্লিট।

খেতে বসে রহমান সাহেবের চোখ চরকগাছ। টলটলে ঝোলে ভাসছে গরুর মাংস! মেজাজ উঠে গেল ৩৬০ ডিগ্রিতে! দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী রানছো, মুখে দেওয়া যায় না’। এরপর আর রক্ষে! স্ত্রীও ‘পেঁয়াজ-বেগুনে’ জ্বলে উঠলেন। ছুটির দিনে শখের খিচুরি খাওয়া তো হলোই না, তা ওপর স্ত্রীর মান ভাঙাতে দিন পার!

বেলা ১১টা। খওয়াব উল্লাহ সহকর্মীকে নিয়ে অফিস থেকে বের হলেন পাশের হোটেলে সিঙ্গারা খাবেন বলে। কাঁচা মরিচ, কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে সিঙ্গারা মুখে দিলে কেমন জানি অমৃতের স্বাদ পান তিনি। যাই হোক, হোটেল বয়ের কাছে সিঙ্গারা অর্ডার দিলেন। কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ ছাড়া খটখটে সিঙ্গারা নিয়ে হাজির হোটেল বয়। সিঙ্গারার দিকে চেয়ে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ চাইলে, ভ্রু কুচকে চাইল হোটেল বয়। একটু পর বলে উঠল, ‘অ! কী কন, যা দাম, পেঁয়াজ আইবো কোত্থেকে, কাঁচামরিচ চাইলে একটা দিবার পারি!’ অগত্যা পেঁয়াজ ছাড়া খটখটে সিঙ্গারাই খেতে হলো বেচারা খওয়াব উল্লাহকে।

প্রচলিত আছে, পেঁয়াজ যৌবনকে সতেজ রাখে। নানা রোগেরও উপশম হয়। সর্দি, ঠান্ডা, উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে পেঁয়াজ। নারীরা রূপচর্চায়ও ব্যবহার করেন পেঁয়াজ।

সৌন্দর্য সচেতন নারী আলতা বেগম। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করলেন, তার চুল কেমন খসখসে হয়ে গেছে। একদিন চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখেন চিরুনিতে উঠে এসেছে চুল! সেই মুহূর্তে স্বামীকে গিয়ে বললেন, শোন আমার চুল উঠে যাচ্ছে, বেশি করে পেঁয়াজ নিয়ে এসো। চুলে একটু পেঁয়াজ বাটা দেব।

পেঁয়াজ বাটা চুলে! স্ত্রীর কথা শুনে আঁতকে উঠলেন স্বামী। শ্যাম্পু-সাবান এনে দিতেও প্রস্তুত, কিন্তু কোনোভাবেই পেঁয়াজ আনতে রাজি হলেন না তিনি।

ভোজন বিলাসী বাঙালির সঙ্গে পেঁয়াজের কেমন জানি প্রেমের সম্পর্ক। প্রতিবছরই এই সম্পর্কের মধ্যে বাদসাধে মূল্যবৃদ্ধি। পেঁয়াজও জানিয়ে দেয় তার কদর। তবে এবার যেন দাম বৃদ্ধির অব্যাহত এ ধারা অতীতের সব সীমা লঙ্ঘন করেছে।

ওপরের চিত্রগুলো কাল্পনিক!

রাজধানীসহ সারা দেশের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম উঠেছে প্রতি কেজি ১৪০-১৬০ টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর এ সময়ে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকার মধ্যে ছিল। আর এ বছর কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানে দেশি পেঁয়াজ ১৫০ টাকা এবং আমদানির পেঁয়াজ ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মূল্য বৃদ্ধির এমন উল্লম্ফনে পেঁয়়াজের ঝাঁজে চোখে জল বেরোনোর জোগাড় মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-নিম্নআয়ের মানুষের। তাই কেউ যদি ঘটনাগুলোকে তার বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেন তবে ভুল ধরার একবারেই অবকাশ নেই।

মানসুরা চামেলী: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম