কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস তুমি কার?

  • নাহিদ হাসান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

এক
২০১৩ সাল থেকে দাবিটি উঠেছে। লাখ লাখ লিফলেট বিতরণ হয়েছে একেকটি কর্মসূচিতে। প্রতিটি উপজেলা বৈচিত্র্যময় কর্মসূচিতে ভরপুর ছিল। জেলার জনসংখ্যা ২৫ লাখ। গণস্বাক্ষর ও টিপসই সংগ্রহ হয়েছিল ২ লাখ। প্রায় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, চেয়ারম্যান-মেম্বার, মসজিদের ইমাম, ধর্মসভার পুরোহিতসহ অজস্র মানুষ রেজিস্ট্রি ডাকে প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। কুড়িগ্রাম অচলের ডাক, গণসমাবেশসহ ইউনিয়নে ইউনিয়নে মানববন্ধন হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে যুক্ত করার কাজে অজস্র তরুণ কঠোর শ্রম দিয়েছেন। সবাই মিলে আবার প্রমাণ করেছেন, ‘সংগঠিত জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা!’

কেন? দুই দুইবার বিবিএস জরিপে কুড়িগ্রাম দারিদ্র্যের শীর্ষে থেকে গেছে। কলকারখানা না থাকায় দেশের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক শ্রমিক দেশের নানান প্রান্তে যান। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় বিনিয়োগ হয় না। সবচেয়ে নিম্নমানের বাসগুলো কুড়িগ্রামে চলাচল করে। বেশি ভাড়া দিতে না পারাই এর কারণ। এরাই গরু-ছাগলের মতো করে গাড়ি চড়তে বাধ্য হয়। সারাদেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ৩০ ভাগ থেকে ২৪ ভাগে নেমেছে, সেখানে কুড়িগ্রামে তা ৬৩.৬৭ ভাগ থেকে ৭০.৮৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। চিলমারীতে তা ৭৭ ভাগ। এ এক নিদারুণ বৈপরীত্য!

বিজ্ঞাপন

দুই
গত ১৬ অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চলাচল শুরু হয়েছে। ট্রেনটির নাম কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেনটি চিলমারী বন্দরসহ রৌমারী-রাজীবপুরকে যুক্ত করবে না, থামবে না রাজারহাটে। কিন্তু রংপুরের ২টি স্টেশন, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, জয়পুরহাট, সান্তাহার, মাধবনগর ও বিমানবন্দরে থামবে। মানে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কুড়িগ্রাম থেকে রওনা করবে মাত্র। কুড়িগ্রামের শ্রমিকদের জন্য দরকারি জয়দেবপুর স্টেশনেও থামবে না। কুড়িগ্রামের জন্য আসন বরাদ্দ ২২৫টি, আর রংপুরের জন্য ২১৮টি।

সময়ের হিসাবটাও এরকম- কুড়িগ্রাম থেকে ছাড়বে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে আর রংপুর থেকে ৮টা ৩৭ মিনিটে, বদরগঞ্জ ৯টা ৩ মিনিটে। একটি ট্রেনকে লাভজনক করতে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানে কুড়িগ্রামের জনগণ ট্রেনে উঠবেন সাত সকালে আর রংপুরের লোকরা সকালের নাস্তা করে। মানে নামে পদ্মলোচন আসলে কানা।

টিকিট মূল্য হচ্ছে শোভন চেয়ার ৫১০ টাকা, স্নিগ্ধা ৯৭২ টাকা, এসি সিট ১১৬৮ টাকা আর এসি বার্থ ১৮০৪ টাকা। মানে সুলভ আসন নাই। শ্রমিকরা বাসেই ঢাকা যান ৩০০-৩৫০ টাকায়। ঢাকাসহ সর্বত্র ট্রেনের দাবিতে আন্দোলনে ছিলেন এই শ্রমিক ও ছাত্ররাই। এত দামি টিকিটে যাতায়াত করবেন কারা—যারা ট্রেনের লাইন তুলে রেলের জমি দখল করেছেন? যারা বাস মালিকদের স্বার্থে ট্রেনের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন? যারা পুরাতন স্টেশনের জমি দখল করে রেখেছেন?

তিন
এ কেমন বৈপরীত্য! সারাদেশে দারিদ্র্যের হার কমে আর কুড়িগ্রামে বাড়ে। ট্রেনের নাম কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কিন্তু কুড়িগ্রামের একটি মাত্র স্টেশনে ট্রেন থামবে। কুড়িগ্রামের শ্রমিকরা যে ঢাকা বলতে জয়দেবপুর স্টেশন চেনে, সেখানে ট্রেনটি থামবে না। একটি শ্রমিক পরিবার গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার পথে কয়েক কেজি চাল, কয়টা ডিম, এক জোড়া মুরগি, বাড়ির আনাজ নিয়ে যান। তারা ভদ্রলোকের মতো শুধু মানিব্যাগ নিয়ে চলেন না। তাই বিমানবন্দরে নেমে আবার গাজীপুর ফেরা তাদের পক্ষে সহজ কিছু কী?

ভাড়াও শ্রমিকদের আয়ত্বের বাইরে। কুড়িগ্রামের ৭১-৭৭ ভাগ গরিব মানুষ আন্তঃনগর ট্রেনে যদি না চড়েন, তাহলে এই ট্রেনের যাত্রী কারা? বাস মালিক নেতারাই? আন্তঃনগরটি লোকসানের মুখে পড়লে দায় কার? কুড়িগ্রামবাসীর, না নীতিনির্ধারকদের? রাষ্ট্রীয় সম্পদ কীভাবে লাভজনক হবে, তা নিয়ে যে কোনো গবেষণা হয়নি, এ থেকে তা পরিষ্কার।

কোচের ভাড়া একেকটি কোচ কতজন যাত্রী বহন করে তার ওপর নির্ভর করে। তাছাড়া ধারণ ক্ষমতার কত শতাংশ যাত্রী বহন করা হচ্ছে, এটাও একটা ফ্যাক্টর। সিট খালি যাওয়ার ওপর লোকসান নির্ভর করে। সিট খালি যাওয়া নির্ভর করে এলাকা ও মৌসুমের ওপর।

এছাড়া একটি ট্রেনে কোন ধরনের কোচ থাকবে, তার ওপরও আয় নির্ভর করে। সুলভ কোচগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়িয়েও আয় বৃদ্ধি করা যায়। যেমন ৬৪ সিটের জায়গায় ৮০ সিটের ব্যবস্থা করে। আরেকটি হলো ট্রেনের কোচের সংখ্যা বাড়ানো, এতে আয় যেভাবে বাড়ে খরচ সেভাবে বাড়ে না। কারণ এতে রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্লাটফরম ইত্যাদির খরচ বাড়ে না। অর্থাৎ ট্রেন প্রতি যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, বিভিন্ন ধরনের যাত্রীবাহী কোচের কম্বিনেশন, ধারণক্ষমতা ও সিটের ব্যবহারের হার ইত্যাদির ওপর ট্রেনের লাভ নির্ভর করে। এভাবে ভাড়া না বাড়িয়ে ট্রেনকে লাভজনক করা হয়। বৃটিশ আমল ও ভারতীয় উভয় অভিজ্ঞতাই বলে, শ্রমজীবীদের বগির সংখ্যা ও বগির অভ্যন্তরে আসন ক্যাপাসিটি বাড়িয়েই তা করেছেন।

যে কৃষকদের সন্তানরা গণকমিটির ব্যানারে টানা আন্দোলন করে ট্রেনটি আনলেন, তারা কি পূর্বপুরুষদের মতোই প্রতারিত হবেন? যে পূর্বপুরুষরা কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত লড়েছিলেন?

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি