মৃত্যু ও কনসার্ট!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের, বেদনার। মৃত্যুর বেদনা ও দুঃখ সীমাহীন হয় কখনো কখনো। যখন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় অপরিণত বয়সে কারো জীবন প্রদীপ নিভে যায়। কিশোর নাজমুলের মৃত্যু তেমনি এক বেদনাদীর্ণ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত ঘটনা।

আরও পড়ুন: কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
 
নাজমুলের মৃত্যুকে কেউ সহজে মেনে নিতে পারছে না। সহপাঠী বন্ধুরা নাজমুলের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে রাজপথে নেমেছে। চার দফা দাবিতে তারা সোচ্চার।  
 
 
শুধু নাজমুলের পরিবার, বন্ধুরাই নয়, সারা দেশেই এই মৃত্যুর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মানুষ বিভিন্নভাবে এবং সামাজিক মাধ্যমে তাদের সংক্ষোভ প্রকাশ করছেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার ও সংশ্লিষ্টদের আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন।
 
নাজমুল দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং একটি শীর্ষস্থানীয় মিডিয়ার অনুষ্ঠানে গিয়ে সে বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। তার এই অপমৃত্যুর দায় কার? সকলেই এই প্রশ্নের উত্তর চায় এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করে।
 
নাজমুলের মৃত্যুর কারণ তদন্তের জন্য একটি কমিটি হয়েছে। আশা করা যায় যে, এই কমিটি সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবে এবং দোষীদের শনাক্ত ও শাস্তির আওতায় আনতে সক্ষম হবে।
 
কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ঘটনার সময় যে অমানবিক আচরণ ও আত্মস্বার্থের নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করা হয়েছে, তার দায় কে নেবে? নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে নাজমুলের মৃত্যুর সময়।
 
অনুষ্ঠানের একজন সদস্য দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যুর মুখোমুখি, তখন কেমন করে অনুষ্ঠান চলতে পারে? চলতে পারে কনসার্ট? মৃত্যুকে আড়াল করে যারা কনসার্ট করেছে তাদের বিবেক নাজমুলকে মুখ দেখাবে কেমন করে? জাতির সামনে তারা দাঁড়াবে কেমন করে?
 
বিবেকের কথা বলা, আলোর কথা বলা যাদের কাজ, তারা নাজমুলের মৃত্যুকালীন সময়ে এ কেমন আচরণ করলেন? তাদের আচরণ তাদের অবস্থান ও নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
 
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে, অন্যায় ও অবিচারের বিরূদ্ধে কথা বলে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানসমূহের আচরণ ও কার্যকলাপ যদি অমানবিক হয়, মৃত্যু ও কনসার্টের মধ্যে পার্থক্য করার মতো নৈতিক শক্তি যদি তাদের না থাকে এবং এতো বড় একটা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে চাপা দিয়ে আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয়, তাহলে তা হবে চরম নিন্দনীয়। মানুষের ক্ষোভের কারণ এখানেই নিহিত।
 
বাংলায় একটি কথা আছে, 'আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাইও'।  কেমন শিক্ষা তারা দেবেন, যারা মৃত্যুর সামনে স্বার্থপরতার শিক্ষা তুলে ধরেছেন? নৈতিকতার নামাবলী শরীরে চাপিয়ে তারা যে নাজমুলের মৃত্যুর সময় চরম অসততা, অনৈতিকতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তার জবাব দেবেন কোন মুখে? মানুষ কেন তাদেরকে বিশ্বাস করবে এবং আস্থায় নেবে?
 
প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মানুষের গুড উইল ও আত্মমর্যাদা হলো সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সস্তা জনপ্রিয়তা ও বাজারি প্রচারের জন্য তা নষ্ট করা যায় না। নাজমুলের মৃত্যুর সময় তারা তাৎক্ষণিক স্বার্থের জন্য তাদের সব কিছু বিসর্জন দিলেন। তাদের স্বার্থান্ধ কাজ দিয়ে তাদের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবোধক করলেন। 
 
হয়ত নাজমুলের মৃত্যু জন্য দায়ীদের চিহ্নিত ও বিচার করা সম্ভব হবে। কিন্তু নাজমুলের মৃত্যুর কঠিন পরিস্থিতিতে যারা অনুষ্ঠান চালিয়ে কনসার্টকে বেছে নিয়েছেন, তারা তাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আসা ও এসে অবহেলায় লাশ হয়ে ফিরে যাওয়া নাজমুলের বিদেহী আত্মার কাছে কি জবাব দেবেন? নাজমুলের শোকাহত পরিবার ও বন্ধুদের মুখ দেখাবেন কেমন করে?          
 
ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর ও অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিজ্ঞাপন