মসজিদে শিশুদের প্রবেশ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মসজিদে শিশুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইসলাম সমর্থন করে না, ছবি: সংগৃহীত

মসজিদে শিশুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইসলাম সমর্থন করে না, ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি রাজধানী উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে লাল ব্যানারে শিশু কিংবা বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে লাগিয়ে রাখা এ নোটিশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ লোকজনই এ সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত প্রকাশের পূর্বে ‘মসজিদে বাচ্চাদের প্রবেশ বা বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের বিধান’ সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত ছিলো বলে মতামত দিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদ ড. আফম খালিদ হোসাইন সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফর করে এসেছেন। মালয়েশিয়া সফরে তিনি দেশটির বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন। মালয়েশিয়া সফরের টুকরো অভিজ্ঞতা তিনি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।

সে প্রেক্ষিতে তিনি মালয়েশিয়ার মসজিদে শিশু-বাচ্চাদের প্রবেশ বিষয়ে সেখানকার মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গী শেয়ার করেছেন ফেসবুকে।

তিনি লিখেছেন, ‘মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্বিবদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো আছে। যেখানে লেখা আছে, সম্মানিত মা-বাবা ও অভিভাবকবৃন্দ! মসজিদের জামাতে শরিক করানোর ক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করুন। ইসলাম এটাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। নামাজের ওয়াক্ত ও অন্যান্য সময় একে অপরকে সম্মান করার এবং সৌজন্য বজায় রাখার শিক্ষা ইসলাম আমাদের প্রদান করে। অতএব আমাদের প্রত্যাশা মসজিদে আপনার শিশুর আচরণ পর্যবেক্ষণে আপনি সচেতন থাকবেন। একান্ত সহযোগিতার জন্য আমরা শোকরিয়া আদায় করি।’

এবার আলোচনা করা যাক মসজিদে শিশুদের প্রবেশ প্রসঙ্গে। মুসনাদে আহমাদের হাদিস। একবার হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাতের একটা সিজদা খুব দীর্ঘায়িত করলেন। এতোই দীর্ঘায়িত করলেন যে, সাহাবারা (রা.) ভাবলেন হয়তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সমস্যা হয়েছে, অথবা তার উপর অহি নাজিল হচ্ছে। তাই তিনি সিজদা থেকে উঠতে পারছেন না।

নামাজ শেষে সাহাবারা দীর্ঘ নামাজের বিষযে প্রশ্ন করতে লাগলেন। কেউ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কি তখন কোনো সমস্যা হচ্ছিল?”

আবার কেউ বললো, 'জিবরাঈল কি তখন আপনার ওপর অহি নিয়ে এসেছিলো?’

মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্বিবদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো আছে
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্বিবদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো আছে, ছবি: সংগৃহীত

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এরকম কিছুই হয়নি আমার। আসলে, আমি যখন সিজদায় ছিলাম তখন আমার নাতী হাসান আমার কাঁধে চেপে বসেছিলো। ওর মনের আশা পূরণ হওয়ার আগে ওকে ঘাঁড় থেকে নামাতে মন চাইছিলো না আমার।’

নবী করিম (সা.) যখন নামাজ পড়ছিলেন, তখন তার দৌহিত্র হাসান গিয়ে ঘাঁড়ে চেপে বসলো। এতে করে কিন্তু নবী করিম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোটেও বিরক্ত হননি। নামাজ শেষ করে হাসানকে ধমক দেননি। হাসানের পিতা হজরত আলী (রা.) কে শাসিয়ে দেননি তাকে মসজিদে আনার জন্য। এমনকি, হাসান ঘাঁড়ে চেপে বসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাজেও মনোযোগে বিঘ্ন ঘটেনি। তিনি পরেরদিন মসজিদের লিখে দেননি, ‘মসজিদে বাচ্চা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।’

অধুনা আমাদের দেশে একদল মুরব্বি মুসল্লির আবির্ভাব ঘটেছে। তারা মসজিদে বাচ্চাদের একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। মসজিদে বাচ্চা দেখলেই তারা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। এই যে, উত্তরার মসজিদে তো ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে বলা হলো, মসজিদে বাচ্চা নিয়ে আসবেন না।

মসজিদে বাচ্চা এলে তাদের নামাজের ডিস্টার্ব হয়। এরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাইতেও বড় নামাজি কিনা!!

ভাবতে অবাক লাগে, কোন মানসিকতা নিয়ে তারা মসজিদ কমিটির সদস্য হয়? যারা মসজিদের আবেদন সম্পর্কে কিছুই জানে না। যারা মসজিদের কাউকে প্রবেশে বাঁধা দেয় তাদের সম্পর্কে কোরআনে কঠোর হুমকি এসেছে। সেই প্রেক্ষাপট আর এই প্রেক্ষাপট হয়তো এক না, কিন্তু বিষয়টা কোনোভাবেই ইসলাম সম্মত নয়।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম এমনিতেই রসাতলে যাচ্ছে দিন দিন। চারদিকের ফেতনার জালে বন্দী হয়ে তারা দূরে সরে যাচ্ছে দ্বীন থেকে। সেখানে ভষিব্যৎ প্রজন্মকে মসজিদে আনা নিষেধ করা নিতান্তই বোকামি, মূর্খতা।

আমদের সমাজের অনেকেই শিশুদের মসজিদে নিয়ে যাই। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের এটি একটি চোখ জুড়ানো দৃশ্য। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে শিশুদের আল্লাহর ঘরের সঙ্গে পরিচয় করানো ও নামাজের জন্য অভ্যস্ত বানানো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা শিশুকালে যে জিনিসে অভ্যাস হয়, পরে তা করা সহজ হয়, নচেৎ তা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের সাত বছর বয়স থেকেই নামাজের নির্দেশ দাও। আর যখন ১০ বছর বয়সে উপনীত হবে, তখন তাদের নামাজে অবহেলায় শাস্তি প্রদান করো।’ -আবু দাউদ: ৪৯৫

তবে শিশুদের মসজিদে নেওয়ার বিষয়ে শরিয়ত কর্তৃক কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে, সেগুলো রক্ষার মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু অনিয়ম থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। যেমন একেবারে অবুঝ শিশুকে মসজিদে আনা নিষেধ। যারা মসজিদের সম্মান ও নামাজের গুরুত্বের জ্ঞান রাখে না, তাদের মসজিদে আনার অনুমতি নেই। কেননা এতে সাধারণত মুসল্লিদের নামাজে বিঘ্ন ঘটে।

বুঝ হয়েছে, এমন নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে বিধান হলো, যদি শিশু একজন হয়, তাহলে তাকে বড়দের কাতারেই সমানভাবে দাঁড় করাবে। এ ক্ষেত্রে বড়দের নামাজের কোনো অসুবিধা হবে না। একাধিক শিশু হলে সাবালকদের পেছনে পৃথক কাতারে দাঁড় করানো সুন্নত। তবে হারিয়ে যাওয়া বা দুষ্টুমি করার আশঙ্কা হলে, বড়দের কাতারেও দাঁড়াতে পারবে।

অনেকের এ ধারণা রয়েছে যে নাবালেগ শিশুদের বড়দের কাতারের মধ্যে দাঁড় করালে পেছনের মুসল্লিদের নামাজ হয় না বা নামাজ ত্রুটিযুক্ত হয়, আসলে ব্যাপারটি সে ধরনের নয়। বরং যদিও জামাতের কাতারের সাধারণ নিয়ম ও সুন্নত হলো- প্রাপ্তবয়স্করা সামনে দাঁড়াবে ও অপ্রাপ্তবয়স্করা পেছনে থাকবে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে নামাজ অশুদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ জন্য শিশু একা হলে বা পেছনে দুষ্টুমির শঙ্কা হলে বড়দের কাতারে সমানভাবে দাঁড় করানোই উত্তম।