করোনাভাইরাস একটি প্রাণঘাতী মহামারি। যা পুরো পৃথিবীকে আতঙ্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কিছুই তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এক কথায়, করোনায় যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে আর যারা এখনও আক্রান্ত হয়নি- কেবল আশঙ্কা করছে; তারাও সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করছে। এসব বিবেচনায় সচেতনতা ও সতর্কতার দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। করোনা নিয়ে আমাদের সচেতনতা হতাশাব্যঞ্জক।
স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হলেও, যে উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন বা কার্যকারিতা এখনও তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। বিভিন্ন স্থানে গণজমায়েত বন্ধ হয়নি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে আমার অনেক পিছিয়ে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া।
বাংলাদেশের অনেকে মনে করছেন, আমরা করোনায় আক্রান্ত হবো না। হলেও বেশিদিন থাকবে না। অদৃশ্য কেউ যেন তাদের এই ছাড়পত্র দিয়ে গেছে। আবার অনেকেই দৃশ্যমান কোনো ধরনের সতর্কতা অবলম্বন না করে আল্লাহতায়ালার ওপর নির্ভরতার কথা বলছেন। বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করে রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে এভাবে আল্লাহর ওপর ভরসার শিক্ষা তারা কোথায় পেলেন- আল্লাহ মালুম।
একবার এক সাহাবি উটে সওয়ার হয়ে হুজুরে আকরাম (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে এলো। হুজুর (সা.) তখন মসজিদে ছিলেন। আগত সাহাবি মসজিদের সামনে নিজের উটটি রেখে ভেতরে গিয়ে হুজুর (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ পর যখন ফিরে যাওয়ার জন্য বাইরে এলেন, দেখতে পেলেন মসজিদের সামনে তার উটটি নেই। তখন সে অস্থির হয়ে গেল এবং নবী করিমকে (সা.) জিজ্ঞেস করলো, হুজুর! আমার উট কোথায়? নবী করিম (সা.) জানতে চাইলেন, তোমার উট কি তুমি বেঁধে রেখেছিলে? সাহাবি উত্তর দিলেন- না, তাতো রাখিনি। আমি আল্লাহতায়ালার ওপরে তাওয়াক্কুল করেছিলাম। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, উট আগে বেঁধে রাখবে। এরপর তাওয়াক্কুল করবে।
এ ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলামে উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ কিছু নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসবাব গ্রহণ করা জরুরি।
আবার অনেকে ভাবছেন, আমার এতো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। করোনা আমাকে স্পর্শ করবে না। কারণ- আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, জাকাত দেই। দেখুন, আপনি নামাজ-রোজা নিয়মতি করলেও আল্লাহতায়ালা চাইলে করোনা আপনাকেও আক্রান্ত করতে পারে। কথাটা কাউকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, সতর্কতার জন্য বলা। ইসলাম সব বিষয়ে মানুষকে হুঁশিয়ার থাকতে বলে, প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইসলাম কোনো অলৌকিক ধর্ম নয়, ইসলাম বাস্তবসম্মত ধর্ম।
নবী করিম (সা.)-এর যুগেও মহামারি এসেছে। ওই মহামারিতে রাসূলের অনেক সাহাবি শহীদ হয়েছেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে সিরিয়ায় একবার প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল। তখন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন হজরত আবু উবাইদা (রা.)। তিনি পত্র মারফত হজরত ওমর (রা.)কে এ ব্যাপারে অবহিত করলেন।হজরত ওমর (রা.) প্রবীণ সাহাবিদের পরামর্শের জন্য ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী করবো? সিরিয়ায় যাবো নাকি যাবো না? সাহাবিদের থেকে দু’ধরনের অভিমত এলো। কেউ বললেন, আপনি যে উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, সে উদ্দেশ্যে যান। কেউ বললেন, আপনার না যাওয়াই উচিত।
তারপর আনসার এবং মুহাজিরদের ডাকলেন। তারাও মতপার্থক্য করলেন। সবশেষে বয়স্ক কুরাইশদের ডাকলেন। তারা বললেন, আপনার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। দয়া করে আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দেবেন না।
হজরত ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত নিলেন, মদিনায় ফিরে যাবেন। খলিফাকে মদীনায় ফিরে যেতে দেখে সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রা.) বললেন, আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন?
উমর (রা.) বললেন, হে আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলতো! আর হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাককির থেকে আরেক তাকদিরের দিকে ফিরে যাচ্ছি।
এক তাকদির থেকে আরেক তাকদিরের দিকে ফিরে যাওয়ার কী অর্থ? এটাও তিনি আবু উবাউদাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।হজরত ওমর (রা.) বলেন, তুমি বলোতো, তোমার কিছু উটকে তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দু’টো মাঠ আছে। মাঠ দু’টোর মধ্যে একটি সবুজ শ্যামল, আরেকটি শুষ্ক ও ধূসর। এবার বলো ব্যাপারটি কি এমন নয়, যদি তুমি সবুজ মাঠে উট চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদির অনুযায়ী চরিয়েছো। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তা-ও আল্লাহর তাকদির অনুযায়ী চরিয়েছো?
বস্তুত কোনো বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন কিংবা উপায়-উপকরণ গ্রহণ এবং বাহ্যত ভালোটা গ্রহণ করা- এটা আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়!
অতএব, করোনার ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গোনাহের কাজ বন্ধ করতে হবে। কোনো গণজমায়েত করা যাবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহতায়ালার কাছে বিগত দিনের ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।
আরও পড়ুন:
মহামারি প্রসঙ্গে ইসলামের পরামর্শ ও দোয়া
বিপদে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করুন
করোনা থেকে বাঁচতে আল্লামা শফীর পাঁচ পরামর্শ
সাময়িকভাবে মসজিদ বন্ধ রাখা বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা
রোগ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
করোনা: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় স্বস্তি