বন্যপ্রাণীর অবাধ বাণিজ্য বন্ধে কতটা সক্ষম চীন

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

ফাতেমা তুজ জোহরা, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-08 17:01:03

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। শুরুতে ধীর গতিতে সংক্রমণ শুরু হলেও কিছুদিনের মাথায় মহামারি আকার ধারণ করে করোনাভাইরাস। এমন সংকটকালীন অবস্থায় এ ভাইরাসের উৎস খুঁজতে উহানের একটি বন্যপ্রাণী বিক্রয়ের মার্কেট থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে দাবি করেছে চীন কর্তৃপক্ষ।  

যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। মার্কিন গবেষকরা বলেছেন, ধারণা করা হচ্ছে কোনো প্রাণী থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। তবে গত তিন মাসেও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ মেলেনি। বাদুর, সাপ ও বনরুই থেকে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে বলেও জানান তারা।  

বন্যপ্রাণী খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ

চীনে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করার আড়াই মাস পর গত ৬ মার্চ বন্যপ্রাণী খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চীন কর্তৃপক্ষ। চীনে লাভজনক বন্যপ্রাণী বাণিজ্য বন্ধ হলেও সামনের দিনগুলোতে মহামারির প্রাদুর্ভাব থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে করে চীন কর্তৃপক্ষ।

তবে সাময়িক এ নিষেধাজ্ঞা পর পরিবেশ রক্ষায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটি আইন এ বছরের শেষ দিকে চীনের সংসদে পাস হতে পারে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। চীনের পক্ষে বন্যপ্রাণীর অবাধ বাণিজ্য বন্ধ করা এতটা সহজসাধ্য নয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে চীনের গোটা অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। শুধু বন্যপ্রাণী খাওয়া নয় চীনে ওষুধ থেকে শুরু করে কাপড়, অলংকার তৈরি হয় বন্যপ্রাণী থেকে।

তবে বন্যপ্রাণী বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা চীনে এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সাপ খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় চীন। সে সময় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও মামলা দেওয়ার রেকর্ডও ছিল। কিন্তু সে প্রেক্ষাপটের পর খুব বেশি দিন নয়, ২০১৯ সালে এসে আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। আর এখন গোটা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া জরুরি নয়। বরং চীনের বেইজিং শহরে বন্যপ্রাণী ব্যবহার করে চীনের আদিম ওষুধ বানানো বন্ধ ও  সংস্কৃতিবান্ধব মনোভব গড়ে তোলা জরুরি।

অবাধ বাণিজ্যের প্রসার

চীনের সামুদ্রিক প্রাণীর মার্কেটগুলোতে শুধুমাত্র মাছ নয় এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর কেনাবেচা চলে।

সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র এক প্রতিবেদনে ওইসব দোকানগুলোতে সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি খাঁচায় রেখে সাপ, শিয়াল, শজারু ও হরিণ বিক্রি করতে দেখানো হয়।

এখন প্রশ্ন আসে শুধু কি উহানের বন্যপ্রাণী কেনাবেচার মার্কেট দায়ী? চীনজুড়ে এমন হাজারও বন্যপ্রাণী কেনাবেচার দোকান রয়েছে। হুমকির প্রশ্ন তখনই আসে, যখন বিভিন্ন পরিবেশ থেকে বহু বন্যপ্রাণী মানুষের কাছাকাছি রেখে সংরক্ষণ করা হয়।    

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিও পুন বলেন, এসব বন্যপ্রাণীদের নিজস্ব ভাইরাস আছে। এসব ভাইরাস এক শরীর থেকে অন্য শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এমনকি এসব ভাইরাস বাজারে থাকা অন্য প্রাণীর শরীরেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যেখানে প্রতিদিন বড় সংখ্যক মানুষ চীনের এসব বাজারে যাচ্ছে, সেখানে এসব ভাইরাস খুব সহজেই মানুষের শরীরে আসতে পারে।

অধ্যাপক পুন একমাত্র ব্যক্তি যিনি ২০০৩ সালে মহামারি আকার ধারণ করা সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ডিকোড করেছিলেন। চীনের গুনজুয়াং প্রদেশের একটি বন্য বিড়ালের মাংস থেকে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছিল। তবে সার্স ভাইরাস এই বিড়ালের শরীরে ছিল না অর্থাৎ অন্যপ্রাণী থেকে কোনো ভাইরাস এই বিড়ালের শরীরে এসে তারপর সংক্রমিত হয়েছে। 

কেন এসব প্রাণী খাচ্ছে চীনের মানুষ

এসব বন্যপ্রাণী খাওয়ার পিছনে কারণ কী হতে পারে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশকিছু চীনা নাগরিক জানান,  এসব বন্য প্রাণী খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এছাড়া এসব বন্যপ্রাণী খুব ব্যয়বহুল। সুতরাং আপনি যদি কাউকে ট্রিট দিতে চান, এসব ব্যয়বহুল বন্যপ্রাণী খাওয়ানোর মাধ্যমে সেসব অতিথিদের এক ধরনের মূল্যায়ন/ শ্রদ্ধা করছেন বোঝায়। 

ব্যয়বহুল সব বন্যপ্রাণি কেনাবেচা এতটাই প্রসার লাভ করেছে যে, এ নিষেধাজ্ঞা বেশিতে দুই-তিন মাস টিকে থাকবে ব্লে মনে করেন চীনা নাগরিকরা।  

নিষেধাজ্ঞায় কোন কোন প্রাণী খাওয়া যাবে না তার লিস্ট প্রকাশ না করলেও আপাতত বন্যসম্পদ রক্ষার্থে নেকড়ে, বন্য বিড়াল, কবুতর খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

মহামারি বন্ধ করতে গিয়ে হাজার কোটি টাকার এ বন্য প্রাণীর অবাধ বাণিজ্য বন্ধে চীন কতোটা কঠোর হবে এটাও ভাবার বিষয়।

২০০৭ সালের এক পরিসংখ্যান মোতাবেক, বন্যপ্রাণী বাণিজ্যে চীনের বাৎসরিক আয় ৭৩ বিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয় এ থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আড়াই মাসের মধ্যে চীনে প্রায় ২০ হাজার বন্যপ্রাণী কেনাবেচার মার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

চীনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, ২০১২ সালের পরিসংখ্যান মোতাবেক, চীনের এক তৃতীয়াংশ মানুষ সারাজীবন বন্যপ্রাণী খাওয়া থেকে শুরু করে এর পোশাক ও অলংকার ব্যবহার করে থাকে। অর্থাৎ তারা সম্পূর্ণভাবে বন্যপ্রাণীর উপর নির্ভরশীল। আর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ চীনের ৫২ শতাংশ মানুষ সঠিক বলে মনে করেন। অপরদিকে বেইজিং প্রদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ এর বিরুদ্ধে।  

চীনের চিরায়িত চিকিৎসা সেবা

চীনের এসব বন্য প্রাণী থেকে তৈরি ওষুধের বৈশ্বিক বাজার এখন ১৩০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সুতরাং বন্যপ্রাণী বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা চীনের চিকিৎসা বাজারে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

অনেক প্রাণীর অংশবিশেষ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। হরিণের মাংস খেলেও এর রক্ত এবং ভাল্লুক ও সাপ ওষুধ দিয়ে তৈরি হয় এসব ওষুধ। তবে ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান মতে, এসব প্রাণী দিয়ে ওষুধ তৈরি করা হলেও সাপ ও ভাল্লুকের মাংস চীনা নাগরিকরা খেয়ে থাকেন।

এমনকি চীনের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, এসব প্রাণী খেলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাদুড় ক্যান্সার প্রতিরোধ করে বলে বিশ্বাস করেন চীনের নাগরিকরা।

সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক চীনা নাগরিক বলেন, একদিন কোমর ব্যথায় আমি নড়তে পারছিলাম না। এমন সময় আমার এক বন্ধু আমাকে সাপের স্যুপ খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে খাওয়ার কিছুদিনের মাথায় আমার কোমর ব্যথা ঠিক হয়ে যায়।

সাংস্কৃতিক মনোভাবের পরিবর্তন

অধ্যাপক লিও পুন বলেন, বন্য প্রাণী খাওয়া চীনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি অংশ। এর ধারাবাহিকতায় তারা যদি নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে তাহলে ঠিক আছে।

কিন্তু এর নিশ্চয়তা দেবে কে? অবশ্যই চীনকে এমন নীতিমালা নিয়ে আসতে হবে যেখানে তারা এসব প্রাণীর পরিষ্কার মাংস সরবরাহ করবে। একইসঙ্গে বায়োসিকিউরিটি ও চেকিং সংক্রান্ত বিষয়গুলোও আমাদের ভাবতে হবে।

একটি  নিষেধাজ্ঞা আরোপ অনেক প্রশ্ন ও ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বাণিজ্যটি যদি দ্রুত অবৈধ ঘোষণা করা হয় তাহলে শহর থেকে এসব বন্য প্রাণীর মার্কেটগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হবে। এসব মার্কেটের বিস্তার তখন গ্রামের দিকে হবে। কর্তৃপক্ষের নজর সরাতে আর তাদের বাণিজ্য সুবিধাজনক করতে তারা ব্ল্যাকমার্কেটের মাধ্যমে প্রসার লাভ করবে। 

এখন আমরা দেখছি শহরের দোকানগুলো থেকে এসব ভাইরাস ছড়াচ্ছে। কিন্তু তখন দেখা যাবে এসব ভাইরাস গ্রাম থেকে ছড়াচ্ছে।

বন্য প্রাণীর অবাধ বাণিজ্য বন্ধ করতে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা আর আইনের সঠিক প্রয়োগ। অবশেষে মূল বিষয়বস্তু হলো- ‘রাতারাতি সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সময়।’

সূত্র: সিএনএন

এ সম্পর্কিত আরও খবর