দা ফ্রুট অব মাই ওমেন

  • হান ক্যাং
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ রাবেয়া রব্বানী

১.
মে মাস প্রায় শেষ, নীল লোহিত ফুলের বাগান থেকে বিক্ষিপ্ত জিহ্বার মতো ছড়িয়ে পড়া পাপড়িগুলো সরিয়ে নিচ্ছে বাগানের মালি। সিনিয়র সিটিজেন সেন্টারের প্রবেশ পথের রাস্তায় লাগানো সাদা ফুলগুলো পথচারীর পায়ের নিচে পিষ্ট হচ্ছে। এই প্রথম আমি আমার স্ত্রীর শরীরে কালশিটে দাগগুলো দেখতে পেলাম।

বিজ্ঞাপন

সূর্য ইতোমধ্যে বেশ উপরে উঠে গেছে। পাকা পীচ ফলের শরীরের মতো মোলায়েম  আলো শত শত ধুলো আর ফুলের রেণু অদৃশ্য করে দিয়ে আমাদের বসার ঘরে আলো ফেলছে। মারাত্মক রকম মিষ্টি, উষ্ণ সূর্যরশ্মি আমার সাদা জামার পেছন থেকে আমার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী রবিবারের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছি। এই সপ্তাহটা বেশ ক্লান্তিকর গেছে। সপ্তাহের শেষ দিন বলে বেশ কিছু সময় নিজেকে শুয়ে থাকার অনুমতি দিয়েছিলাম এবং এখন মাত্র কিছুক্ষণ হয় ঘুম থেকে উঠেছি। একই জায়গায় শুয়ে থেকে আমি আরো একটু আরাম পেতে হাত পা মেলে দিয়েছি এবং যতটা ধীরে সুস্থে পারা যায় চোখ বুলাচ্ছি পত্রিকায়। আমার স্ত্রী বলল, “একটু দেখো তো। আমি বুঝতে পারছি না কেন এই কালচে দাগগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে না?”

নীরবতার সুতোগুলো আমার মেজাজে এতক্ষণ ভালো লাগা বুনে দিচ্ছিল তা ছিঁড়ে ফেলার কারণে আমি আমার স্ত্রীর কথাগুলোকে বিরক্তি হিসাবে নিলাম।  তার কথার অর্থ আমার বুঝতে ইচ্ছে করল না। আমি অন্যমনস্কভাবে তার দিকে তাকালাম, সামনে সোজা হয়ে বসে এতক্ষণ যা পড়ছিলাম তা আঙ্গুল দিয়ে চিহ্নিত করলাম, হাতের তালু দিয়ে চোখ ঘষলাম। আমার স্ত্রী তার দাগগুলো দেখাতে তার পোশাক অন্তর্বাস পর্যন্ত তুলল। হ্যাঁ পিঠে এবং পেটে গাঢ়  দাগগুলো ছড়িয়ে আছে। একটু কোমর বাঁকানোতেই দেখতে পেলাম তার স্কার্টের শুরু থেকে কশেরুকা বরাবর উঠে গেছে সেগুলো। ছোট বাচ্চাদের হাতের তালুর সমান হালকা নীল দাগগুলো এমন যে দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো কালি দিয়ে আঁকা হয়েছে।

“এগুলো কিভাবে বাঁধালে?”

আমার তীক্ষ্ণ স্বর আঠারো স্কয়ার ফিটের ফ্লাটের সীমা অতিক্রম করল। স্ত্রী বলল, “আমি জানি না কেন যাচ্ছে না। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা লেগেছে হয়তো কিংবা আঘাত পেয়েছি যা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এবং এক সময় চলে যাবে। কিন্তু না যাচ্ছে না বরং উল্টো বড় হচ্ছে।”

অন্যায় করতে গিয়ে ধরা পরে যাওয়া বাচ্চার মতো আমার স্ত্রী আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। আমি তাকে এভাবে ধমকে ওঠার জন্য কিছুটা লজ্জিত হয়ে গলার স্বর নরম করে বললাম, “এগুলো কি ব্যথা করে বা জ্বলে?”

“না, একেবারেই না। এই দাগের জায়গাগুলোতে তেমন কোনো অনুভূতিই হয় না। কিন্তু জানো এটাই চিন্তার বিষয়।”

একটু আগের অপরাধী অভিব্যক্তির বদলে তার মধ্যে এখন নম্র এবং অসংগত হাসি দেখা যাচ্ছে। সে এই হাসি দিয়ে আসলে আমার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছে হাসপাতালে যাবে কিনা? পুরো পরিস্থিতি থেকে সরে আসতে আমি আমার স্ত্রীর মুখ আবেগহীনভাবে প্রত্যক্ষ করতে থাকি। এই মুখ আমার অপরিচিত। একেবারে অচেনা ও অবাস্তব। আমার একদম মনে হচ্ছে না আমরা একসাথে আছি  চার বছর হয়ে গেল। সে আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। এখন তার বয়স ঊনত্রিশ। আগে আমরা যখন  একসাথে বাইরে যেতাম তখন তার চেহারার জন্য তাকে খুবই কম বয়সী মনে হতো। বিয়ের আগে তাকে স্কুলের মেয়ে বলেই সবাই ভুল করত। কিন্তু এখন ক্লান্তি আর অবসাদ তার মুখে স্পষ্ট। এখন তাকে স্কুলে পড়া মেয়ে দূরে থাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া মেয়েও মনে হয় না। আসলেই তাকে বয়সের চেয়ে এখন বড়  লাগে। তার কচি আপেলের মতো লালচে গাল এখন কেমন ধূসর কিছু দিয়ে ঢাকা। তার কোমরের ভাঁজ আগে মিষ্টি আলুর নরম খোসার মতো কোমল ছিল। পেটে যে দুর্দান্ত বাঁক ছিল এখন তা একেবারেই শীর্ণ। আমি এখন কষ্ট করেও মনে করতে পারছি না শেষ কবে তাকে নগ্ন দেখেছিলাম। তবে এটা নিশ্চিত এ বছর তো নয়ই। এমনকি আগের বছরও দেখেছিলাম কিনা আমি নিশ্চিত মনে করতে পারছি না।

কিন্তু তার সাথে থাকা একমাত্র মানুষ হয়েও কিভাবে আমি তার শরীরে এমন গাঢ় দাগগুলো খেয়াল করিনি। আমি তার সকল কাপড় খুলে ফেলতে বললাম। তার গালের দিকে লালচে ঝলক দেখা গেল আর তা তার ওজন হ্রাস পাওয়াকে আরো স্পষ্ট করল। কাপড় খুলতে সে কিছুটা আপত্তি তুলল, “কেউ দেখে ফেললে?”

বাকি সকল ফ্লাটের মতো আমাদের ফ্লাট ও একটি বাগান ও গাড়ি বারান্দার দিকে মুখ করা। আমরা যখন কাছেই আর এক একটি মহল্লায় থাকতাম তখন তা বড় রাস্তা এবং চুংনানের হৈচৈ থেকে দূরে ছিল। কেউ শক্তিশালী দুরবিন ছাড়া ঘরের ভেতরে উঁকি দিতে পারত না। কিন্তু যত যাই হোক এখন  সার বাইরে দিয়ে যেতে থাকা চলন্ত গাড়ি থেকে বসার ঘরে উঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই তাই আমি আমার স্ত্রীর আপত্তিকে এই ক্ষেত্রে তার লজ্জা আর অস্বস্তি হিসাবে ধরে নিলাম। নতুন বিবাহিত অবস্থায় এমন সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনে, এমন বারান্দা বরাবর দুটো কাচের দরজা থাকা সত্ত্বেও, এমন ঘর্মাক্ত আগস্ট মাসে দুপুরবেলা জানালা খোলা সমেত আমরা অনেক মিলিত হয়েছি। তখন বিষয়টা আমাদের কাছে নতুন ছিল তাই হয়তো ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে আমরা একেবারে ক্লান্তির শেষ সীমা পর্যন্ত যেতাম। এক বছর পর ওভাবে ভালোবাসা-বাসিতে প্লাবিত হওয়া হতো না আর।

আমার স্ত্রী কিছুটা আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। অস্বাভাবিক রকম গভীর ঘুম তার। দেরি করে বাড়ি ফিরলে ধরেই নিই সে ঘুমিয়ে গেছে। তখন আমি দরজায় চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফ্লাটে ঢুকি। আমাকে স্বাগত জানাতে কেউ থাকে না। আমি নিজেকে পরিষ্কার করে সেই অন্ধকার শোবার ঘরে যাই। তখন তার নিঃশ্বাসের শব্দেও আমি আরো একাকীত্বে ডুবে যাই। যদি তাকে হালকাভাবে স্পর্শ করে জাগাতে চাই  তখন তার আধ খোলা চোখ দেখে বোঝার উপায় থাকে না সে কি আমার স্পর্শকে স্বাগত জানাচ্ছে নাকি তা প্রত্যাখ্যান করছে। আধো ঘুমে সে কেবল তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে আমার চুলে বিলি কাটে। যে পর্যন্ত আমার শরীরের নড়াচড়া বন্ধ না হয় তার আঙ্গুল চলে।

এখন আমার স্ত্রী আবার বলল, “সবকিছু খুলে ফেলব? তুমি কি বলছো আমি সবকিছু খুলে ফেলব?”

কান্না চাপাতে সে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করল তারপর আন্ডারপ্যানটা বলের মতো মুড়িয়ে নিজের নিম্নাঙ্গ ঢেকে দাঁড়াল। তার নগ্ন দেহ বসন্তের আলোতে স্পষ্ট। আসলেই বহুদিন হয়ে গেছে আমরা মিলিত হয়েছি তবুও আমার বিন্দুমাত্র কামনা জাগছে না। আমি তার শরীরের হলদে সবুজ দাগগুলো দেখছি। সেগুলো কেবল তার পশ্চাতভাগেই নয় এমনকি উরুর সাদা অংশের ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড রাগ হলো আমার। তারপর রাগটা জবুথবু হয়ে অনুশোচনায় দাঁড়াল। একটি অদ্ভুত দুঃখবোধ মনে জাগ্রত হলো। আমার স্ত্রী এমন একজন মহিলা যার মন খুব সহজেই এলোমেলো হয়ে যায়। এমনকি এক সন্ধ্যায় ঘুমের ঘোরে হাঁটার ইতিহাসও আছে তার। ঘুমের দেশে যেতে যেতে যেন ইতোমধ্যে তার অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেছে। এভাবে চললে সে সহজেই কোনো একদিন গাড়ির নিচে পড়ে যাবে কিংবা জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি দিয়ে পা ফসকে পড়বে।

আমার স্ত্রীর শরীর এখন নগ্ন। সে তার নিম্নাঙ্গ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে আর পড়ন্ত বসন্তের সূর্যরশ্মি তার পিঠ ছাপিয়ে যাচ্ছে। সে অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করছে তার কি হাসপাতালে যাওয়া উচিত কিনা? কথাটা এমন দুঃখ, হতাশা ও বিষাদে ভরা যে বহুদিন পর আমাকে একটা অন্যরকম বিষণ্ণতা গ্রাস করল। তার হাড্ডিসার শরীরটা ধরে রাখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই!

হঠাৎ আমার মনে হলো সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই এমন বসন্তের দিনে আমি আমার বাহুতে আমার স্ত্রীর কংকালসার শরীরটাকে নিয়ে বললাম, “যদি ব্যথা না হয়ে থাকে তবে নিশ্চিত সেগুলো মিলিয়ে যাবে। তুমি হাসপাতালের ঝামেলায় কখনোই যেতে চাওনি। আর এখন কি পারবে?” আমি অট্টহাসি দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইলাম।

২.
গ্রীষ্মের প্রথম দিক। লম্বা সাইকামারসের পাতায় গরম বাতাস তার শক্ত গাল ঘষতে চাইছে এবং রক্তাভ গোধূলির আলোয় ধুয়ে মুছে রাস্তায় রাত নেমে এসেছে। আমার স্ত্রী আমার অপর পাশে বসে রাতের খাবার শেষ করে তার চামচ শব্দ করে প্লেটে রাখল। আমি তার শরীরের দাগের কথাগুলো একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন সে তার ছোট হাতের জামার ফাঁক দিয়ে কিছু পরীক্ষা করে বলল, “দেখো তো আবার। ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত মনে হচ্ছে।”

সে দ্রুত তার জামা আর অন্তর্বাস খুলে ফেলল। একটি বিশাল গোঙানি গিলে ফেলার আগেই আমার মুখ থেকে বের হয়ে এলো। বসন্তের সময় দেখা সেই নতুন শিশুর হাতের থাবার সমান দাগগুলো এখন বড় পাতার আকৃতি নিয়েছে। আরো গাঢ় হয়েছে। অনেকটা বৃষ্টি ভেজা উইলো গাছের শাখার মতো কালচে। আমি কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দিয়ে আমার স্ত্রীর ঘাড় স্পর্শ করলাম। মনে হচ্ছে কোনো অচেনা শরীরকে আমি স্পর্শ করছি। এমন কালো দাগ থাকা নিশ্চয়ই বেশ কষ্টকর। ভালোভাবে ভেবে আমি আমার স্ত্রীর মুখের দিকেও তাকালাম এবং সেখানেও নীল রঙের প্রলেপ দেখতে পেলাম। যেন সীসার পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে দিয়েছে কেউ। তার আগের চকচকে মসৃণ চুলগুলো কেমন শুকনো মূলা গাছের মতো ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। চোখের সাদা অংশেও হালকা বেগুনী রং ধরে গেছে, চোখ অশ্রুসিক্ত দেখাচ্ছে।

“আমার কেন এসব হচ্ছে বলো তো? আমি বাইরে যেতে চাই কিন্তু  সূর্যের আলো গায়ে লাগলেই আমার জামা কাপড় খুলে ফেলতে ইচ্ছা হয়। যেন আমার শরীর কাপড়গুলো রাখতে চায় না।”

আমার স্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে তার শুষ্ক ও নগ্ন শরীরের একেবারে সমান্তরাল প্রদর্শনী করল। সে আবার বলল, “গতদিনের আগের দিন আমি কোনো কিছু গায়ে না দিয়ে জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং ওয়াশার ড্রাইয়ারের কাছে গিয়েও দাঁড়িয়েছিলাম। খেয়াল করতে ইচ্ছা করেনি আমাকে কেউ দেখছে কিনা... নিজেকে লুকানোর কোনো ইচ্ছা হয়নি আমার। যেন আমি একজন পাগল মহিলা।”

বসে বসে আমার স্ত্রীর কৃশ শরীরের উপরিভাগ দেখা ছাড়া তার কথার পিঠে কোন রা করলাম না আমি। কিছুটা ভয় পেয়ে আমি আমার চপস্টিকের উপরিভাগে হাত চালালাম। আমার ক্ষুধাও চলে গেল। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি খেলাম আমি। আর যেহেতু আমি কিছু খেতে পারছি না আমার মনে হলো যে আমার পেটে থেকে প্রয়োজনীয় এসিড ঠিকঠাক নিঃসরিত হচ্ছে না। তাই আমি যদি জোর করেও খাই তা ভালোভাবে হজম হবে না। আমি কেবল নাড়তে লাগলাম। সে পাপেট শো’র সুতো ছেড়া পুতুলের মতো আমার হাঁটুতে তার মুখ গুঁজল। এ কি! সে  কাঁদছে! আমার ট্রাক সুটের মাঝে একটি উষ্ণ এবং ভ্যাপসা দাগ বসে গেল।

সে বলল, “তুমি কি জানো সারাদিনে কয়েকবার আমার কেমন অনুভূতি হয়। শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় বমি বমি লাগছে, মাথা ঘুরছে। মনে হয় কুঁজো হয়ে থাকি। সোজা হতে কষ্ট হয়। মাথায় এমন ব্যথা লাগে যে মনে হয় ডান চোখটা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।”

মৃদু জ্বলা বাতিটার ধার থেকে আসা একটা পোকার ভনভন শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই ঘন আলোর নিচে আমার স্ত্রী ঘাড়ের মধ্যে কালচে দাগ নিয়ে সেই ভনভনে শব্দ তৈরিকারী পোকাটাকে মারতে চাইল। আমি তাকে বললাম, “হাসপাতালে যাও। কাল সোজা ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে চলে যাও।”

তার দাগযুক্ত মুখ, দেখতে কুশ্রী লাগছে। তবু আমি আমার বিচ্ছিন্ন আঙুলগুলো দিয়ে তার চুলে বিলি কেটে দাঁত বের করে হাসলাম। বললাম, “যাওয়ার সময় বুঝেশুনে যেও। ব্যথা পেও না। তুমি কোনো বাচ্চা না যে কোনো জিনিসের ওপর পড়ে যাবে বা ধাক্কা খাবে।”

আমার স্ত্রীর ভেজা মুখে একটু হাসি দেখা গেল। এক ফোটা অশ্রু এতক্ষণ তার ঠোঁটে ঝুলছিল তাও কেমন দুলে দুলে পড়ে গেল।

৩.
আমার স্ত্রী কি আগে এমন কথায় কথায় কাঁদত? অবশ্যই না। আমি তাকে প্রথমবার কাঁদতে দেখি যখন তার বয়স ছাব্বিশ। যুবতী বলে বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারত না সে। খুব সহজেই হেসে ফেলত। তার কণ্ঠ সবসময় খুব তাজা শোনাত এবং ঝর্নার মতো ছিল তার হাসির শব্দ। কিন্তু একবার তার তরুণ চেহারার সাথে তার পরিণত কণ্ঠের মিল পাইনি আমি। যেদিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বলেছিল, “আমি এমন উঁচু দালানওয়ালা শহরে থাকতে পছন্দ করি না। সাত হাজার লোক সবাই একসাথে গাদাগাদি করে থাকে। আমার মনে হয় শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাব। আমি এই শত শত হাজার হাজার অভিন্ন দালান, অভিন্ন রান্নাঘর, অভিন্ন ছাদ, অভিন্ন টয়লেট, বাথটাব, ব্যালকনি এবং লিফটগুলোকে ঘৃণা করি। পার্কগুলো, বিশ্রামাগার, দোকানপাট এবং জেব্রাক্রসিং সব ঘৃণা করি।”

আমি বলেছিলাম, “এসব কথা বলছো কেন?”

তার কথা ভালোভাবে বোঝার চেয়ে তার কোমল কণ্ঠস্বরের দিকেই আমার মনোযোগ ছিল বেশি। আমি বলেছিলাম, “অনেক মানুষ একে অপরের কাছে থাকে তা অপছন্দের কী আছে?” আমি আমার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা কঠিন অভিব্যক্তি ধরে রেখেছিলাম। তার চোখ ছিল প্রাণবন্ত আর উজ্জ্বল।

তার কথায় আমি বর্তমানে ফিরে এলাম। সে এখন বলছে, “এমন গাদাগাদি ফ্লাটে থাকতে না চাইলেও আমি সবসময় খেয়াল রেখেছি যাতে যে কামরায় আমি ভাড়া থাকব তা যেন বিনোদন মুখর জেলায় হয়। আমি কেবল সেখানেই গিয়েছি যেখানে মানুষজনে ভর্তি। যেখানে গানের শব্দ রাস্তা ছাপিয়ে যায় এবং গাড়ি দিয়ে রাস্তা জ্যাম হয়ে থাকে। তাছাড়া আমার ভালো লাগেনি। আমি একা থাকতে পারি নি।”

যদিও এখন আমার স্ত্রী তার হাতের পিঠ দিয়ে তার কান্না মুছছে তবু সেখানে অনবরত আরো পানি এসে পূর্ণ হচ্ছে। সে আরো বলল, “আর এখন মনে হচ্ছে আমি কোনো দীর্ঘমেয়াদী অসুখে ভুগে মরে যাচ্ছি। যেন আমি আর এই তেরো তলা থেকে আর নামতে পারব না। যেন আমি আর কখনো বাইরে যেতে পারব না। মনে হয় যেন এই শোরগোল আওয়াজ সব কিছুই বেশি বেশি।”

আমাদের বিয়ের প্রথম বছর উঁচু দালানে থেকে থেকে আমার স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। বিয়ের আগে সে সিউলের হিলার জেলার একটি কামরায় ভাড়া থাকত। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে সে অভ্যস্ত ছিল। হয়তো তাই তার শরীর এখানকার গরম এবং আবদ্ধ ফ্লাটে মানিয়ে নিতে পারেনি। বিয়ের পর তার প্রাণশক্তি এতই কমে এসেছিল যে, সে যে ছোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করত সেখানে দিনে একবার হেলেদুলে হেঁটে যাবার শক্তি ছিল না তার। আমাদের এই বিয়ের কারণেই সে তার চাকরি ছেড়ে দেয়নি। সে চাকরি ছেড়ে দেবার পরই আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। বিয়ের আগে সে তার সমস্ত জমানো টাকা এক করে, মানে  চাকরি থেকে বা পেনশন থেকে, সপ্তাহ শেষের বাজেট থেকে জমানো টাকা এক করে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা ভাবছিল। তারপর এক সন্ধ্যায় তার ঊর্ধ্বতন কর্মচারী আবেদনপত্র দিয়েছিল যে, সে তার চাকরি করবে না। সে আমাকে তখন  বলেছিল সে তার শরীরে পুরনো রক্ত ফেলে দিয়ে নতুন রক্ত ঢুকাতে চায়। পুরনো রক্তগুলো নাকি তার রগে রগে জমে গেছে। সে নতুন রক্ত ঢুকিয়ে তার ফুসফুসকে শুদ্ধ বাতাস দিতে চায়। ছোট থেকেই স্বাধীনভাবে বাঁচা মরার স্বপ্ন দেখে এসেছে সে। কিন্তু সময় সুযোগ হয়নি। তখন তার মনে হচ্ছিল তার স্বপ্ন পূরণ করতে যথেষ্ট টাকা জমেছে। সে একটি দেশ বেছে নিয়ে সেখানে ছয় মাস থাকতে চেয়েছিল তারপর সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবার ইচ্ছা ছিল। সে মৃদু হেসে বলেছিল, “মরে যাবার আগে আমি এটা করতে চাই”। কিন্তু শেষমেশ সে তার জমানো সব টাকা ঢেলে দিয়েছিল এই ফ্লাটে এবং আমাদের বিয়েতে। কেন সে তার সিদ্ধান্ত বদলেছে সেই ব্যাপারটা একটি ছোট বাক্য দিয়ে বুঝিয়েছিল সে। বলেছিল, “স্বাধীনতা মানে এই না যে আমি তোমাকে ছেড়ে দিব।”
আমি ভেবেছিলাম তার এই স্বাধীন থাকার ইচ্ছা কতটাই বা সত্য। এত সহজে যে ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করতে পেরেছে তাকে আমার খুব বেশি প্রখর কিছু মনে হয়নি। পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা অবাস্তব ও রোমান্টিক ভ্রান্তি। আর যেরকম পরিকল্পনা সে করেছে সেটা বাচ্চা মেয়ের চাঁদে যেতে চাওয়ার মতো কিছুই ছিল। আসলে একসময় সে নিজেই তা বুঝতে পারবে আমি গর্বিত বোধ করেছিলাম এইজন্য যে আমিই  ব্যাপারটা প্রথমে ধরতে পেরেছি।

হয়তো তার ক্রমাগত ব্যথা আর কষ্টের কারণে এখন যখন সে বারান্দায় নিচু হয়ে ঝুঁকে চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে তখন তাকে একেবারে বাসী বাঁধাকপির মতো দেখায়। সে এখন এতই স্থির হয়ে থাকে যে একেবারে  ক্ষীণ শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দেই নিশ্চিত করা যায় যে সে বেঁচে আছে। দেখে মনে হয় যেন একটি অদৃশ্য হাত তার কাঁধ চেপে ধরে থাকে, যেন একটি চেন লাগানো বিশাল লোহার বল দিয়ে তার শরীর বাঁধা তাই সে তার কোনো মাংসপেশি নাড়াতে পারছে না।
বিয়ের কিছুদিন পর থেকে রাতের গভীরে বা খুব ভোরে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙা শুরু হয়। হঠাৎ আকস্মিক কোনো গাড়ি বা মোটরবাইকের শব্দে বিরক্ত হয়ে বলত, “মনে হয় গাড়ির চেয়ে রাস্তাই দ্রুত ছুটছে, যেন রাস্তার সাথে এই ফ্লাটটাও টেনে নিচ্ছে।” শব্দগুলো দূরে মিলিয়ে গেলেও বা তার ঘুম তাকে পুনরায় শান্ত করে দিলেও আমার স্ত্রীর সুন্দর চেহারা মলিন দেখাত। এক রাতে আমার স্ত্রী ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে উঠেছিল, এই সবকিছু কোথা থেকে আসছে আর কোথায় যাচ্ছে?”

৪.
এখন সন্ধ্যা। আমি সামনের দরজা খুলে আমার ফ্লাটে প্রবেশ করি দেখতে পেলাম আমার স্ত্রী দরজায় আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছে। খুব সম্ভবত করিডরে আমার পায়ের শব্দ শুনেই সে এসেছে। খালি পা এবং বরাবরের মতো না কাঁটা নখগুলো সাদাটে দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হাসপাতাল থেকে কী বলল?”
কোনো উত্তর পেলাম না। আমি জুতো খুলতে আমাকে নীরবে লক্ষ করে সে ঘুরে গেল। সেই মুখ। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম। মনে করতে লাগলাম কখন কিভাবে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের দুজনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী এক বয়োজ্যেষ্ঠ কিছুক্ষণ আমাদের সাথে বসে থেকে আমাদের একলা রেখে চলে যায়। আমি আমার ভবিষ্যত স্ত্রীর মুখ দেখে  কী বিভ্রান্তিতেই না পড়ে যাই! দেখে মনে হয় তার মন দূরের কোনো গোপন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথম দর্শনেই যে মুখ উজ্জ্বল এবং লাবণ্যময়ী লেগেছিল। আমি এমন একেবারে অচেনা মানুষের বেখেয়ালি চাউনিকেও বুঝতে পারি কারণ আমি নিজেও নিঃসঙ্গ। তার চেহারার সেই অভিব্যক্তিতেই আমার ক্ষণস্থায়ী ধারণা হয়েছিল যে সেও আমাকে বুঝতে পারছে। আর এই বোঝাটা এবং যতটা এলকোহল আমি খেয়েছি তা আমাকে আমার মনের কথা স্বীকার করিয়ে ছাড়ল যে আমি সারাজীবনভর একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হিসাবেই থেকেছি। কথাটা শুনে  সেই ছাব্বিশ বছরের মেয়েটা কোন দূরের দিগন্ত থেকে মুখ ফিরিয়েছিল, আর তাতে ছিল ঠিক এখনকার মতো ঠান্ডা এবং নিঃসঙ্গ একটা অভিব্যক্তি।
আমি এখন আবার প্রশ্ন করলাম, “তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে?”
আমার স্ত্রী ক্ষীণ  মাথা নেড়ে তা অস্বীকার করল। সে কি তার চামড়ার দাগগুলোর জন্য অন্য দিকে মুখ  ঘুরিয়ে আছে নাকি আমি কিছু করেছি? বুঝতে পারছি না।
“দয়া করে কথা বলো। সব ঠিক আছে? ডাক্তার কী বলেছে?”
“ঠিক আছে?”
যেন একটা বাক্য নয় একটা নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। তার স্বর ভয়াবহরকম ভোতা শোনাল। আর প্রাথমিক সাক্ষাতে তার কণ্ঠই কিনা আমার বেশি ভালো লেগেছিল। যদিও তুলনাটা একটু অন্যরকম তবে বলতেই হয় তার কণ্ঠটা শুনে আমার ঝকঝকে রঙিন লিকারের চা সুদ্ধ একটি চকচকে টেবিলের কথা মনে হয়েছিল। এমন একটা অভিজাত আসবাবপত্র যা আমরা কেবল বিশেষ মেহমান আসলেই বের করি এবং যে টেবিলে সবচেয়ে ভালো চা, সবচেয়ে ভালো পেয়ালাই পরিবেশন করা যেতে পারে।
সেই প্রথম দেখার রাতে তাকে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা বলে আমি কম এলোমেলো বোধ করিনি। আমার স্ত্রী ছিল একেবারে নির্লিপ্ত। সে তার সহজাত কণ্ঠে এবং সহজাত ভঙ্গিতে বলেছিল, “আমার স্বপ্ন হচ্ছে কোথাও না থেমে ঘুরে বেড়ানো।”
এরপর আমি গাছ নিয়ে বলেছিলাম, আমি তাকে বলেছিলাম আমি এমন একটা বারান্দার স্বপ্ন দেখি যেখানে বড় বড় ফুলের টব থাকবে। প্রতিটাতে সবুজ লেটুস আর পেরিলা থাকবে। গ্রীষ্মকালে ছোট ছোট ফুলগুলো বরফের কণার মতো পেরিলা গাছে পড়বে। আমি আরো বলেছিলাম রান্নাঘরে অঙ্কুরিত শিম গাছ থাকবে। শেষমেশ আমার স্ত্রীর মুখ থেকে হাসির হালকা শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। যার মানে ছিল তার স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্ন একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। সেই ঝনঝনে শিশুর মতো হাসির মধ্যে আমি শেষ পর্যন্ত এঁটে থাকতে চেয়েছিলাম। এরপর আমি আবার আগের কথাটার পুনরুক্তি করেছিলাম, আমি সারা জীবনভর একাই থেকেছি।

বিয়ের পর সেই আলোচনা মতো আমি বারান্দায় ফুলের গাছ এনেছিলাম কিন্তু আমাদের দুজনের কেউই সবুজের যত্নে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম গাছের জন্য পানি দেয়াই মূল কাজ। আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে কোনো ফলন না দিয়ে সবগুলো গাছ মরে গিয়েছিল। কেউ বলেছিল, এত উঁচু ভবন সয়েল এনার্জি পায় না তাই মরে গেছে। কেউ বলেছিল, আমাদের গাছ মারা যায় কারণ মাটি ও পানি দুটাই খারাপ। কেউ এও বলেছিল সে জীবন্ত জিনিস বাঁচিয়ে রাখার মতো তীব্র বিশ্বাস আমাদের নেই। কিন্তু তা সত্যি না। পুরো হৃদয় দিয়ে গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার যে চেষ্টা আমার স্ত্রী করেছিল তার তুলনা নেই। যদি একটা লেটুস বা পেরিলা পাতাও মরে যেত তবে আমার স্ত্রী বিষণ্ণতায় ডুবে যেত। আর যদি একটা মাত্র সজীব হয়ে উঠত তবে তা সে জোরে তা প্রচার করত।
যে কোনো কারণেই এই বারান্দার  টবগুলোতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোথায় গেল সব? কোথায় গেল সেই বৃষ্টির দিন যখন জোর বৃষ্টির জন্য আমি জানলার কার্নিশে টবগুলো উঠিয়ে রাখতাম। সেই তাজা দিনগুলো কোথায় গেল? তেমন এক বৃষ্টির দিনে আমার স্ত্রী আমার দিকে ঘুরে বলেছিল, “চল আমরা দুজন এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাই।” গাছগুলোর মতোই তীব্র বৃষ্টিতে বিদ্ধ হয়ে বিষণ্ণ মৃতপ্রায় কণ্ঠে আমার স্ত্রী কথাটা বলেছিল। বলেছিল, “এই আবদ্ধ স্থানে থাকা সম্ভব না।” হাত দিয়ে লেটুস গাছগুলোকে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচিয়ে তা থেকে পানি ঝরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সম্মতি খুঁজেছিল সে।
আমি বলেছিলাম, “বৃষ্টিটা জোরালো।”
সে বলেছিল, “একে বেঁচে থাকা বলে না। কেবল বাঁচার মতো দেখায়।”
তার কণ্ঠ থেকেও আকুতি ঝরছিল। যেভাবে একজন মাতাল তার ক্ষোভ ঝাড়ে সেভাবে সে বলেছিল, “এখানে কোনো কিছুই হবে না। দেখতে পাচ্ছো না? এখানে কোনো প্রাণ নেই। এই আবদ্ধ জায়গায়, কানে তালা লাগানো কোলাহলে কিছুই সম্ভব না।”
আমি আর নিতে পারছিলাম না। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “কিসের  আবদ্ধতা, কী সমস্যা?”
আমার নতুন সুখের গায়ে তার সেই আঁচড় কাটাকে আমি নিতে পারিনি কিংবা তার শরীরের দীর্ঘদিনের অবদমিত যে রক্ত সে তার শব্দ দিয়ে বের করতে চাইছিল তাতে আমার আপত্তি হয়েছিল। আমি আমার হাত পেয়ালার মতো করে যে পানিটুকু জমিয়েছিলাম তা তার কাঁধে ঢেলে দিয়েছিলাম। আবার বলেছিলাম, “কী আবদ্ধতা? কী তোমার কানে তালা লাগিয়ে দেয় শুনি?”
একটি নিচু স্বরের বিলাপ আমার স্ত্রীর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তার হতবুদ্ধি হাত তার মুখের ওপর গিয়ে পড়েছিল। আর তাতে ধাক্কা লেগে জানালার কার্নিশে রাখা ফুলের টব মাটিতে পড়ার আগে আমার স্ত্রীর পায়ের নখের ওপর পড়েছিল। নোংরা টব এবং মাটি আমার স্ত্রীর কাপড়ে, তার খালি পায়ে পড়ে। সে নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে তার আহত পায়ের পাতা ধরে নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল।
এভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরা তার অনেক আগের স্বভাব। এমনকি বিয়ের আগে যখনি আমি রেগে যেতাম বা স্বর উঁচু করতাম সে এটা করত। ঠোঁটকে ব্যথা দিয়েই যেন সে যুক্তিসম্মতভাবে ভাবতে পারে এবং কিছুক্ষণ পর আমার প্রতিক্রিয়ার উত্তর দিত যুক্তি সহকারে, শান্তভাবে। কিন্তু বারান্দার সেই ঘটনায় কেবল ঠোঁট কামড়ে ধরাই তার একমাত্র সাড়া ছিল। সেইদিনের পর থেকে সে তর্ক করা ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন এই মুহূর্তে আমি খুব শ্রান্ত ও একা বোধ করছি। আমি  আমার স্যুট খোলার পর আমার স্ত্রী তা আমার কাছ থেকে নেয়নি। আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ডাক্তার কি বলেছে কোনো সমস্যা নেই?”
সে নিশ্চিত করল। বলল, “হ্যাঁ সে বলেছে তেমন খারাপ কিছু পায় নি।”
এখনো তার মুখ অন্যদিকে ঘুরানো।

৫.
ধীরে ধীরে আমার স্ত্রী তার অল্প কিছু শব্দও হারিয়ে ফেলেছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাকে কথা না বলালে সে আর কথা বলে না। এমনকি মাঝে মাঝে কথার উত্তর মুখে না দিয়ে কেবল মাথা নাড়ে বা ঝাঁকায়। যদি আমি দাবি করে বলি যে আমার সাথে কথা বলতেই হবে তবে সে দূর থেকে আমার দিকে চতুর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার অসুস্থ চামড়ার অবস্থা এখন একেবারে স্পষ্ট। হালকা আলোর বাতির নিচেও তা দেখা যায়। যদিও ডাক্তাররা বলেছে তারা তেমন খারাপ কিছু পায় নি। পেট এবং পরিপাকতন্ত্রের কিছু ট্রটি আছে কেবল। তারা নাকি বলেছে এটা কোনো কিছুর অভাব বোধের স্বাভাবিক লক্ষণ। কিন্তু কিসের অভাব থাকতে পারে তার? গত তিন বছর আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো এবং শান্তিময় সময় যাওয়ার কথা। আমার বেতনে তেমন কর আরোপিত হয় না। আমি বেশ ভাগ্যবান যে এমন একটি বাড়িওয়ালা পেয়েছি যে আমাকে ফ্লাটের টাকা নেওয়ার জন্য আমাকে চরম চাপ দেয়নি। আমি ইতোমধ্যে আমার নতুন ফ্লাটের জামানতের টাকা পরিশোধ করেছি এবং আমার একটা স্ত্রীও আছে এখন। যদিও সে খুব আকর্ষণীয় না কিন্তু একজন সঙ্গীর কাছে আমি যা চাই তার তা আছে। অন্তত প্রথম প্রথম আমার সুখ অনেকটা উষ্ণ পানি পূর্ণ বাথটাবের কিনার থেকে পানি চুইয়ে পড়ার মতো ছিল। যা আমার শ্রান্ত শরীরটাকে সোহাগের ছোঁয়া দিয়েছে। তাহলে আমার স্ত্রীর সমস্যাটা কী ছিল? যদি তার কোনো কিছুর প্রতি অতিরিক্ত বাসনা থেকেও থাকে তবুও আমি ভেবে পাই না তা কিভাবে তীব্র হতে পারে যে তা থেকে এমন মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। এখন সবসময় আমি ভাবি যে, আমাকে এমন নিঃসঙ্গ করে রাখার কোনো অধিকার কি এই মহিলার আছে? মনে হয় আমার পুরো সত্তাকে কেউ ধিক্কার দিতে থাকে। যেন পুরনো ধুলোর মতো আমাকে কেউ ঝেড়ে পুছে নিচ্ছে।
আগামী রবিবার ব্যবসায়িক কাজে আমাকে বেশ কিছু দিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে। আমার স্ত্রী বারান্দার বাইরে ধোঁয়া কাপড় নাড়ছে। এখন কালো দাগগুলো এতই বেড়ে গেছে যে চামড়ার নীলচে দাগের মধ্যে  সাদা অংশকেই বরং দাগ মনে হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে শূন্য ঝুড়িটা বসার ঘরে ফিরিয়ে রাখতে গেলেই আমি তার পথ রোধ করে তার কাপড় খুলে ফেলতে বললাম। সে বাধা দিলেও আমি জোর করে তার শার্ট খুলে ফেললাম। সৈনিকের পোশাকের মতো তার পুরো শরীর নীল কালির ছোপ ছোপ দাগে ভরে গেছে। আমি পিছু হটে তার দিকে তাকালাম। তার বগলের পশম আগে ঘন ছিল। কিন্তু এখন তার অর্ধেকই চলে গেছে। তার স্তনের বাদামী বোটাতেও নীল রং হানা দিয়েছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম, “নাহ এভাবে চলতে পারে না। আমি তোমার মাকে ফোন করব।”
“না করো না। আমি করব।”
আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠল। তার উচ্চারণ পেঁচিয়ে গেল যেন সে সে তার জিহ্বা দিয়ে কিছু চিবুচ্ছে। আমি আবার চেঁচালাম, “হাসপাতালে যাও। বুঝেছো? একজন ত্বক বিশেষজ্ঞ দেখাও। না জেনারেল হাসপাতালে যাও।”
সে নীরবে মাথা নাড়ল। আমি বলে চললাম, “তুমি জানো আমার তোমার সাথে যাবার সময় নেই। তুমি তোমার শরীর সম্পর্কে জানো। তাই তা ঠিক করার দায়িত্ব তোমার। ঠিক কি না?”
সে আবারও মাথা নাড়ল।
“আমার কথা শুনো। তোমার মাকে ফোন করো।”
আমার স্ত্রী মাথা নেড়েই যাচ্ছে।
তার মাথা নাড়া মানেই কি সে আমার কথা শুনছে! বেশিরভাগ সময়ই আমার কথাগুলো তার এক কান দিয়ে ঢোকে আর এক কান দিয়ে বের হয়ে যায়। আমি সেগুলো সস্তা বিস্কুটের মতো টুকরো টুকরো হয়ে বসার ঘরে পড়ে যাবার শব্দ পাই।

৬.
ঘড়ঘড় করে লিফটের দরজা খুলে গেল। আমি আমার ভারী সুটকেস নিয়ে অন্ধকার করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে বেল বাজালাম। কোনো সাড়া পেলাম না। আমি আমার কান দরজার ঠান্ডা স্টিলে রাখলাম। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার বেল বাজাতেই থাকলাম। পরীক্ষা করে দেখলাম ঠিক আছে কিনা। হ্যাঁ  আমি ফ্লাটের ভেতরে তা বেজে ওঠার শব্দ পেলাম। দরজার মাফলিং এফেক্টের কারণে মনে হলো শব্দটা আরো অনেক দূর থেকে আসছে। দরজায় আমার সুটকেস ঠেশ দিয়ে রেখে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত আটটা বাজে। মানছি আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়াটা এটা একটু বেশি রকমই মনে হলো। আমি  ক্লান্ত, পেটে  খাবার নেই। কেবল এই একবারের জন্য আমার সুটকেস থেকে চাবি বের করার মতো ঝক্কি নিতে মন চাইল না। হতে পারে আমার স্ত্রী আমার কথামতো তার মাকে খবর দিয়ে এনে হাসপাতালে গেছে নয়তো গ্রামের দিকে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে গেছে। আমাকে বাধ্য হয়ে চাবি খুঁজে নিতে হলো।

আমি আমার জুতো খুলে, চপ্পল পায়ে দিলাম। কয়েক কদম যেতেই দুর্গন্ধ পেলাম। ফ্রিজ খুললাম। শসাসহ কিছু সালাদ পঁচে গেছে। রাইস কুকারে প্রায় আধা গামলা ভাত পড়ে আছে। বাইরে থেকেও বোঝা যাচ্ছে রান্নাটা আজকের না। ভাত শুকিয়ে ভেতরের বাটিতে লেগে আছে। ঢাকনা খুলতেই পুরনো পঁচা ভাতের গন্ধ আমার নাকে আঘাত করল। রান্নাঘরের বেসিন বোঝাই নোংরা থালা প্লেট। ওয়াশিং মেশিনের ওপরেও গামলাসহ নোংরা কাপড়ের রাখা।
আমার স্ত্রী শোবার ঘরে নেই, বাথরুম কিংবা স্টোর রুমেও না। আমি তার নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। বসার ঘরে সকালের কাগজ পেলাম যা আমি এক সপ্তাহ আগে আমি রেখে গিয়েছিলাম। একটি ৫০০ এম এল দুধের খালি বাক্স দেখলাম। একটি কাপে জমাট দুধ। আমার স্ত্রীর একটি সাদা মোজা একটি লাল চামড়ার ব্যাগ। সব এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো। হঠাৎ ফ্লাটের ভেতরের তৈরি হওয়া জমাট নিস্তব্ধতাকে রাস্তার ছুটন্ত গাড়ির শব্দ খান খান করে ভেঙে দিয়ে গেল।
যেহেতু আমি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত  এবং যেহেতু সকল বাসন কোসন এবং আমার নিজের খাবার জন্য একটা চামচও পরিষ্কার নেই, আমি ক্লান্ত বোধ করলাম। যেহেতু আমি অনেক দূর থেকে একটি শূন্য ফ্লাটে এসেছি সেহেতু সেই ভ্রমণ সম্পর্কে আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই। বলতে চাই এত দূরের প্লেন ভ্রমণে যে বিপত্তিগুলো আসে তা সম্পর্কে, বলতে চাই বিদেশি ট্রেনে চড়ার সময় পেছনে ছুটতে থাকা প্রাকৃতিক নিসর্গ কেমন ছিল। কেউ আমাকে প্রশ্ন করার নেই, তুমি কি ক্লান্ত? নির্লিপ্ত ভাব করে “ঠিক আছি” বলার সুযোগটাও আমি পেলাম না।
আমি একা বোধ করলাম এবং এই একাকীত্বের জন্য আমার রাগ হলো। যেহেতু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না তাই পৃথিবীর সাথে আমি একাত্ম বোধ করতে পারলাম না। আমার সারাজীবনের যে ভাবনাগুলোতে নিজেকে সফল মনে হয়েছে তা যেন কৌতুকে পরিণত হলো। যে বিষয়ে আমি প্রশংসা পেয়েছি তা ফাঁকা বুলিতে পরিণত হলো। আমার রাগ হলো। হ্যাঁ আমি একা,  কেউ নেই আমাকে ভালোবাসার।
আমার অস্তিত্ব যেন ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। হঠাৎ আমি একটা শব্দ শুনতে পেলাম। আমি শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার স্ত্রীর ক্ষীণ কণ্ঠ বারান্দা থেকে ক্ষীণ ভেসে আসছে যা প্রায় অবোধ্য। মুহূর্তেই সীমাহীন একাকীত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি পেলাম আমি। বারান্দার দিকে এগুতেই কিছু বলার জন্য আমার জিহ্বা সুড়সুড় করতে লাগল। বলতে চাইলাম, “এতক্ষণ ধরে এসেছি জেনেও কেন তুমি সাড়া দাও নি?”
আমি বারান্দার দরজা ঝট করে খুলে ফেললাম। বলতে চাইলাম “এভাবে কেউ সংসার চালায়? তুমি এভাবে বেঁচে আছো?”
কিন্তু আমি আমার স্ত্রীর নগ্ন শরীর দেখে থেমে গেলাম। আমার স্ত্রী হাঁটু গেড়ে বারান্দার জানালার গ্রিল বরাবর ঘুরে আছে। তার দুই হাত এভাবে উপরে তোলা যেন সে আনন্দ প্রকাশ করছে। তার পুরো শরীর কালচে সবুজ। তার আগের মলিন ছায়াময় মুখ এখন চির সবুজ গাছের পাতার মতো চকচক করছে। তার রুক্ষ মূলা শাকের মতো চুলগুলো কোনো বন্য লতার কাণ্ডের মতো হয়ে গেছে। তার সবুজ মুখ জ্বলজ্বল করছে। আমি নিচু হতেই সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উপরে উঠতে চাইল কিন্তু পারল না। তার নরম পা ব্যর্থ চেষ্টা করল। তাকে দেখে মনে হলো সে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারবে না। তার নরম কোমর বাঁকা হয়ে আছে। তার অবসন্ন জিহ্বা তার কালচে নীল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে জলজ গাছের মতো বের হয়ে ঝুলছে। ইতোমধ্যে তার দাঁত নেই মনে হচ্ছে। একটি হালকা কান্না বা একটি বিলাপ ওই নীল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে এসেও হারিয়ে গেল। আমি দৌড়ে বেসিনে গেলাম এবং কল ছেড়ে দিলাম। কাপড় ধোয়ার বোল পূর্ণ করলাম। আমার দ্রুত পদক্ষেপের কারণে দুই দিক থেকেই পানি ছলকে পড়ল বসার ঘরে পড়ে। যখনি আমি আমার স্ত্রীর বুকে পানির ছিটা দিলাম। বড় গাছের পাতার মতো তার পুরো শরীর পুনর্জীবিত হলো। আমি আবার ফিরে এসে গামলাটা পানি দ্বারা পূর্ণ করে আমার স্ত্রীর মাথায় ঢাললাম। তার চুল যেন লাফিয়ে উঠে সজীব, পুষ্ট হয়ে গেল। যেন অদৃশ্য কিছু তাকে আলগা ওজন দিয়ে দিলো। আমি দেখতে পেলাম আমার চেষ্টায় তার সবুজ শরীর পরিস্ফুটিত হয়ে আছে। বিহ্বল হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী এত সুন্দর কখনোই ছিল না!

৭.
মা আমি এখন আর তোমাকে চিঠি লিখতে পারছি না। তুমি যে সোয়েটার রেখে গেছো সেটাও পরতে পারছি না। অই যে কমলা ওলের সোয়েটারটা গত শীতে ভুল করে রেখে গিয়েছিলে সেটা আমি আমার স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই গায়ে দিচ্ছি। তুমি জানো আমার শীত বেশি। এটা ধোয়া হয়নি বলে বাসি গন্ধের পাশাপাশি এতে তোমার শরীরের গন্ধও ছিল। আমি তোমার শরীরের গন্ধ পেতে চেয়েছিলাম মা, তাই এটা গায়ে দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে একদিন আমি এটা ধুয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু অনেক ঠান্ডা পড়ায় এবং তোমার শরীরের গন্ধ নিতে চাওয়ায় আমি আবারও এটা গায়ে দিয়েছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালেও ঠান্ডা তার থাবা সরায়নি জানো? জানালা দিয়ে  যখন সকালের আলো এসে পড়ল তখন আমি খুব শীতার্ত এবং তৃষ্ণার্ত। তখন আমার ভেতর থেকে একটা কান্না বেড়িয়ে এলো, “মা...।” নিজেকে সূর্যের  উষ্ণ আলোয় মুড়ে নিতে আমি বারান্দায় বেড়িয়ে এসে জামা কাপড় খুলে ফেললাম। সূর্যের আলো আমাকে তোমার শরীরের গন্ধের মতো আদর দিলো। আমি সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে মা মা বলে ডাকতে লাগলাম। আর কোনো শব্দ না। জানি না কতটা সময় বয়ে গেছে। দিন,সপ্তাহ, মাস? খেয়াল করলাম বাতাস ঠিকঠাক উষ্ণ না। তাপমাত্রা যেন কিছুটা বেড়ে আবার নিচে নেমে যায়। যেমন চুং গ্যাংয়ের দূরের ফ্লাটগুলোতে এখন সূর্যের কমলা আলো চকচক করছে। কোনো বাসিন্দা কি আমাকে দেখে ফেলছে? বড় রাস্তা বরাবর চলতে থাকা গাড়িগুলো থেকে কি আমাকে দেখা যাচ্ছে? তাদের হেড লাইট থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমাকে তাতে কেমন দেখাচ্ছে?
                                                *
সে খুবই দয়ালু। সে একটা বড় ফুলের টব কিনে আমাকে সেখানে লাগিয়ে দিয়েছে। রবিবার সে সারাদিন আমার শরীরে বসতে চাওয়া কীট ধরতে ধরতে কাটিয়ে দিয়েছে। যে কিনা সবসময় ক্লান্ত হয়ে থাকত সেই এখন আমাদের মহল্লার পেছনের পাহাড়ে রোজ সকালে যায় এবং বালতি ভরে মিনারেল পানি নিয়ে এসে আমার পায়ে ঢালে। তার মনে আছে আমি কলের পানি পছন্দ করতাম না। কিছুক্ষণ আগে সে আমার টবের সব মাটি ফেলে দিয়ে নতুন উর্বর মাটি দিয়েছে। গতরাতে বৃষ্টি যখন শহরের দূষিত বাতাসকে ধৌত করেছে তখন সে সামনের দরজা আর জানালা খুলে রেখেছে যারে বিশুদ্ধ বাতাস  চলাচল করতে পারে।                                          
                               *
খুব অদ্ভুত মা। কিছু না দেখে, না শুনে, বা গন্ধ শুকে, না স্বাদ নিয়ে সবকিছু আরো সতেজ লাগে আরো জীবন্ত লাগে নিজেকে। যখন গাড়ির চাকা রাস্তার অমসৃণ উপরিভাগ পিষ্ট করে আমি তা অনুভব করতে পারি মা। যখনি সে ফ্লাটে ঢোকে আমি বুঝতে পারি, বৃষ্টি ভেজা বাতাস যখন তার স্বপ্নকে উর্বর করে কিংবা ভোরের আধো আলো ছায়া সব আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি ফুলের কুড়ি পরিস্ফুট হওয়া এবং কাছে ও দূরের পাপড়ি খোলার ব্যাপারটা অনুভব করতে পারি। গুটিপোকার লার্ভা থেকে বের হওয়া, কুকুর ও বেড়ালের বাচ্চা প্রসব করা, পাশের দালানের বৃদ্ধ লোকটার নাড়ি থেমে যাওয়া বা সচল হওয়া, কোনো রান্নাঘরে পুইশাক সেদ্ধ হওয়া, নিচের ফ্লাটে গ্রামোফোনের পাশেই  ফুলদানীতে একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকা রাখা, দিন হোক কি রাত আকাশের পথ ধরে তারাগুলোর অধিবৃত্ত রচনা করে যাওয়া, প্রতিদিন পূর্ব দিকের ডুমুর গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য উদিত হওয়া, এইসব যেভাবে হয় আমার শরীরও সেভাবে সারা দেয়।
তুমি কি বুঝতে পারছো মা? আমি জানি খুব দ্রুত আমি ভাবতেও ভুলে যাব। কিন্তু আমি ঠিক আছি। বহুদিন ধরে আমি এরকম স্বপ্নই দেখে এসেছি। বাতাস ছাড়া অন্য কোনো কিছুর সাহায্য না নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকা।
                        *  
আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখন রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে তোমার কোলে মুখ ডুবাতাম। সেই সুস্বাদু গন্ধ! তিলের তেল এবং তিল ভাজার গন্ধ! আমি তো সবসময় মাটি নাড়াচাড়া করতাম তাই আমার হাতের মাটি কাদা তোমার জামা কাপড় নষ্ট করে ফেলত।
কত বয়স হবে তখন? সেই আনন্দময় বসন্তে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সৈকতে। বৃষ্টির পানিতে বড়দের হাসির শব্দ, ভেজা চুলে কপাল ঢেকে যাওয়া বাচ্চাগুলো, দড়ি লাফ খেলতে থাকা, হাত নাড়তে থাকা খুশিতে তাদের মুখ ঝলমল করছিল।
সাগরের পাড়ের সেই দরিদ্র গ্রামই তোমার সব ছিল। সেখানে জন্মেছো, বেড়ে উঠেছো, কাজ করেছো, সন্তান জন্ম দিয়েছো, বুড়ো হয়েছো। এবং বুঝাই যায় তোমার কবরও আমার বাবার পাশে আমাদের পারিবারিক কবরে হবে।
তোমার মতো জীবনটা শেষ হওয়া আমার জন্য ভীতিকর ছিল আর তাই পরিবার এবং বাড়ি থেকে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তাই সতের বছর বয়সে বাসা ছেড়ে দিয়ে বুসানের শহুরে এলাকা, দাইগু, গ্যাংনিইউং এসব জায়গায় একমাস ঘুরে বেরিয়েছি। আমার এখনো মনে আছে, আমার সেই বয়সে আমি জাপানের এক রেস্টুরেন্টে থেকেছি। একা একা খবরের কাগজ বিলি করে সন্ধ্যায় বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে থেকেছি। সেই জায়গাটা আমার ভালো লাগত। ভালো লাগত শহরের উজ্জ্বল চাকচিক্য।
জানি না কখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম অচেনা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমি পুরনো সবকিছু শেষ করে দিয়েছি। হারিয়ে ফেলেছি। আমি বাড়িতে যেমন অসুখী ছিলাম, যে কোনো জায়গায়ই আমি একইরকম অসুখী। তাহলে বলো আমি কোথায় যেতাম?
আমি কখনোই খুশি ছিলাম না। আমার পিঠে কি আমি সবসময় অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে ঘুরি যে কিনা আমার মুখের হাসি ছো মেরে ধরে, আমার পা টেনে ধরে? আমি সবসময় কেবল পালাতে চেয়েছি। একেবারে চরম অস্থিরতায় ভুগেছি। এমন একটা ব্যথা যা আমাকে কাঁদিয়েছে, এমন একটি চিমটি যা আমাকে আর্তনাদ করিয়েছে। বাসে বসে বসে এভাবে চারদিক দেখতাম যেন আমি একটা মাছিকেও আঘাত করতে পারি না। কিন্তু সারাটাক্ষণ জানালাটা ঘুষি দিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতাম। আমার হাত বেয়ে যে রক্ত বের হবে তা দেখতে  আমার খুব লোভ হতো। আমি বেড়ালের মতো তা দুধ মনে করে চুষে নিতে চাইতাম। আমি আসলে কী থেকে পালাতে চাইতাম। কী আমাকে এভাবে তাড়া করত যার কারণে আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পালাতে চাইতাম? কী আমাকে চেপে ধরে রাখে, আমাকে বাধা দেয়? কোন শেকল আমাকে এভাবে নামিয়ে রাখে এবং এই দূষিত রক্ত পরিশুদ্ধ হতে দেয় না।                                             
                            *
বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তারটি ক্রমাগত আঙুল দিয়ে ক্রমাগত তার স্থেথিস্কোপকে ধর্ষণ করল আর বিড়বিড় করে বলল আমার ভেতরটা নাকি কবরের মতো নিস্তব্ধ। সে টেবিলে স্থেথিস্কোপটা নামিয়ে রাখল এবং আলট্রাসাউন্ড মনিটরটা ঘুরাল। আমি শুয়ে থাকলাম যে পর্যন্ত না একটি পিচ্ছিল জেলি একটি লাঠির মতো যন্ত্র দিয়ে আমার পেটে ঘষে দেওয়া হলো। পদ্ধতিগতভাবে যন্ত্রটা আমার পেটের উপরিভাগ থেকে নিচে নেমে যেতে লাগল। সেই যন্ত্রটার মাধ্যমে আমার পেটের ভেতরের কিছু ছবি রূপান্তরিত হয়ে সাদা কালো মনিটরে ভাসতে লাগল। ডাক্তার বলল, “সব কিছু ঠিক আছে। এখন আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে তোমার পরিপাকতন্ত্র। এখানে কোনো সমস্যাই নেই। সবকিছুই ভালো আছে, পরিপাকতন্ত্র, লিভার, জরায়ু, কিডনি।”
আশ্চর্য তিনি কেন দেখতে পাচ্ছেন না যে এইসব অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, খুব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমি এক মুঠো টিস্যু নিয়ে বেশিরভাগ জেলি মুছে ফেললাম। কিন্তু যখন  উঠতে গেলাম তিনি আমাকে আবার শুইয়ে দিলেন। তিনি আমার পেটের কিছু ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চাপ দিলেন। আলাদাভাবে আমি তেমন ব্যথা পেলাম না। আমি তার চশমা পড়া মুখের দিকে তাকালাম যখন তিনি আমায় বললেন, “সব ঠিক আছে? ব্যথা হয়?” আমি আমার মাথা নাড়তে লাগলাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে ব্যথা হয়? এখানে লাগে?”
আমি বললাম, “না।”
আমাকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হলো  এবং বাড়ি ফেরার পথে  সাবওয়ে স্টেশনে নিচু হয়ে দেয়ালের পেছনে বমি করলাম। ব্যথা কমার জন্য গুনতে শুরু করতে লাগলাম। ডাক্তার আমাকে বলেছেন, “এত ভাববেন না। ভাবনামুক্ত থাকেন। শান্ত হোন, সব কিছু মনের ওপর নির্ভর করে।” তিনি কথাগুলো অনেকটা বৌদ্ধ গুরুর মতো বলেছেন। তিনি বলেছেন, “চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করব, মনকে আরাম দিব এক, দুই , তিন, চার, এভাবে গুনতেই থাকবেন। গোনা বন্ধ করা যাবে না।”
কিন্তু ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। আক্ষেপ ঘিরে ধরল যখন আমার পেটের এসিড বের হতে লাগল। বারবার যতক্ষণ না সব বের হয়ে যায় যতক্ষণ না আমি মেঝেতে বমিতে ডুবে যাই ততক্ষণ ততবার আমার বমি হলো। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম মেঝে কাঁপা বন্ধ হবার, সব কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যাবার।
*
দিন দিন শীত বাড়ছে। আজও এই পৃথিবী দেখবে অনেক পাতা মাটিতে ঝরে পড়ে আছে। অনেক সাপ তাদের চামড়া বদলে নিয়েছে। অনেক পোকা মাকড় মরে গেছে, অনেক ব্যাঙ তার শীত নিদ্রা শুরু করে দিয়েছে। সময়ের কিছুটা আগেই মনে হচ্ছে এবার শীত নামছে। আমি তোমার সোয়েটার নিয়ে ভাবছি। তোমার গায়ের গন্ধ এখন আর আমার কাছে স্পষ্ট না মা। আমি আমার স্বামীকে বলতে চাই যাতে সেটা আমার গায়ে দিয়ে দেয় সে কিন্তু এখন আর কথা বলতে পারি না। আমি কী করব বলো মা? আমাকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখে দেখে সে কাঁদে। সে রেগেও যায়। পরিবার বলতে আমিই তার একমাত্র একজন জানো তো? আমার পায়ে পানি ঢালার সময় আমি তার উষ্ণ অশ্রু মিনারেল যুক্ত পানির মধ্যেও আলাদাভাবে অনুভব করতে পারি। আমি বাতাসের অণুগুলোর এলোমেলো হয়ে যাওয়া বুঝতে পারি। তার দৃঢ় মুষ্টি কোনো লক্ষ্য ছাড়াই আঘাত করে বাতাসে।

৮.
সেদিন ব্যবসায়িক ভ্রমণ থেকে এসে আমার স্ত্রীকে তিন গামলা পানি দিয়ে স্নান করানোর পর সে কিছু পেটের এসিড বের করে বমি করেছিল। আমি তার ঠোঁট দুটো কুঁচকে যেতে আবার তা প্রসারিত হতে দেখেছিলাম। কিছু বলতে চেয়েছিল সে। আমার অপটু আঙুল তার মলিন ঠোঁট হাতড়েছিল। তারপর আমি অস্পষ্ট কিছু কথা শুনতে পেয়েছিলাম কিন্তু তা এত আস্তে যে, আমি তার অর্থ বুঝে উঠতে পারি নি। সেটাই শেষবার যখন আমি আমার স্ত্রীর কণ্ঠ শুনেছিলাম, এরপর গোঙানি ছাড়া তেমন কিছু শুনতে পাইনি। সেদিন তার উরুর অভ্যন্তর থেকে সাদা শিকড় গজিয়েছিল। তার বুক থেকে গাঢ় লাল ফুল গজিয়েছিল। গজিয়েছিল তার স্তনের বোঁটা ছিদ্র হয়ে যমজ পুংকেশর যার গোঁড়াটা সাদা আর আগাটা ঘন আর হলদেটে। তার হাতে অল্প কিছু শক্তি অবশিষ্ট যা ছিল তা দিয়ে সে তখন আমাকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল। অল্প কিছু আলো অবশিষ্ট থাকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার ক্যামেলিয়ার পাপড়ির মতো হাতে হাত রেখে বলেছিলাম, “ঠিক আছো?” তার চোখ যেন এক জোড়া পাকা আঙ্গুরের মতো তরলতা দেখিয়েছিল। তাতে ছিল হাসির ক্ষীণ আভাস, বোঝা যায়।

কিন্তু এরপর শরত আসতেই আমি আমার স্ত্রীর শরীরে একটি কমলা আলোর খেলে বেড়ানোর সাক্ষী হয়ে থাকি। আমি জানালা খুললেই তার উপরের দিকে তুলে ধরা হাত বাতাসে হালকা দুলে উঠত। শরত চলে যেতেই তার পাতা পড়ে যেতে লাগল। তার গায়ের রং কমলা থেকে ঘাঢ় বাদামী হয়ে গেল। তা দেখে দেখে আমি ভাবতে থাকতাম শেষ কবে আমি আমার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছিলাম।

শরীরের নিজস্ব টক টক গন্ধ ছাড়াও আমার স্ত্রীর শরীরের নিচের অংশ থেকে সবসময় হালকা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। তখন আমি ভাবতাম হয়তো সে তার সাবান বদলেছে বা ইচ্ছে করেই নিম্নাঙ্গে কিছুটা সুগন্ধি মেখে নিয়েছে। কত আগে হবে ব্যাপারটা? এখন তার অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই একসময় সে দ্বিপদী প্রাণী ছিল। গাছ হয়ে যাবার পর তার চোখের তারা যা একসময় জ্বলজ্বলে আঙ্গুরে রূপান্তরিত হয়েছিল তা এখন বাদামী কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। কিন্ত যখনি আমি বারান্দায় আসি আমি এক অব্যক্ত উত্তেজনা অনুভব করি। মনে হয় যেন তার শরীর থেকে আমার শরীরে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। একসময় যা আমার স্ত্রীর হাত ছিল এবং যেগুলো চুল ছিল তা ঝরে গেছে। তার ঠোঁটের স্থান ফুঁড়ে এক মুঠ ফলের গুচ্ছ বের হয়েছে। সেগুলো ধীরে ধীরে ডালিমের আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। আমি সেগুলো ছিঁড়ে নিয়ে জড়ো করে বসার ঘর আর বারান্দার সংযোগস্থলে বসি। প্রথমবারের মতো দেখা এই ফলগুলো অনেকটা হলদে সবুজ। বিয়ারের সাথে দেওয়া পপকর্নের পাশে যেরকম শক্ত সূর্যমুখীর বীজ দেওয়া হয় ফলগুলোর খোসা তেমন শক্ত। আমি একটা  মুখে দেই। উপর থেকে মসৃণ ফলের ত্বকটা কোনোরকম স্বাদ আর গন্ধ ছাড়া। আমি কড়কড় শব্দ করে তা ভাঙ্গি। হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র মহিলার ফল। প্রথমেই আমার মুখে টক একটা স্বাদ লাগে একেবারে ঝাল একটা স্বাদ তারপর আমার জিহ্বায় শেষ মাথায় সে স্বাদটা লেগে থাকে তা কেবলমাত্র তিতকুটে কিছু।

আজ আমি এক ডজন টব কিনে এনে ফলগুলো লাগিয়েছি। এরপর আমি তা আমার শুকিয়ে যাওয়া স্ত্রীর টবের পাশে সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রেখেছি।
এখন রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট টান দিয়েছি। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে আমি আমার স্ত্রীর নিচের অংশ থেকে গজিয়ে ওঠা ঘাসের গন্ধ পাচ্ছি। শরতের শেষের ঠান্ডা বাতাস আমার সিগারেটের ধোঁয়াকে আর আমার লম্বা হয়ে যাওয়া চুলকে কাবু করে ফেলছে।
আচ্ছা? বসন্ত এলে কি আমার স্ত্রী আবার অঙ্কুরিত হবে? তার ফুলের রঙ কি লাল হবে? আমি ঠিক জানি না।

/uploads/files/Jr1ZK3OaJxunUA60qlbnbXokv0liTK2cEm6YT3uq.jpeg
হান ক্যাং ।।
১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনসেইয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে কোরিয়ান সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। পারিবারিকভাবেই সাহিত্য পরিমণ্ডলে বড় হওয়া এই লেখকের প্রথম বই ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। জাতীয়ভাবে তার লেখা বইয়ের কদর থাকলেও এবং নানান পুরস্কার পেলেও আন্তর্জাতিকভাবে হান সাড়া ফেলেন “দা ভেজেটেরিয়ান” উপন্যাস প্রকাশিত হবার পর। ছাত্র জীবনে তিনি একটি কবিতার লাইন দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন আর তা হচ্ছে—“আই বিলিভ দ্যাট হিউমেন শুড বি প্ল্যান্টস।” এই কথার ভাবকে তার লেখায় ব্যবহার করে হান ক্যাং ঔপনিবেশিক সময়ের সন্ত্রাসের বিপক্ষে ব্যবহার করেন এবং তৈরি হয় তার সবচেয়ে সফল কাজ “দা ভেজেটেরিয়ান”। বইটি ইংরেজিতে অনুবাদের পর তিনি ২০১৬ সালে কোরিয়ান লেখকদের মধ্যে প্রথম ম্যানবুকার প্রাইজ পান এবং নিউইউর্ক টাইমস ২০১৬ সালের সেরা দশ বইয়ের তালিকায় বইটিকে ঘোষণা করে। এরপর তার অন্যান্য লেখাগুলোও আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে। দা ভেজেটেরিয়ান উপন্যাসের মূল ভিত্তি মূলত এই ছোটগল্পটি... “দা ফ্রুট অব মাই ওমেন” এই ছোটগল্প লেখার পর থেকেই “দা ভেজেটেরিয়ান” লেখকের মনে নতুন করে ডাল-পালা মেলে। মেটাফরের সার্থক প্রয়োগ করতে পারায় তাকে এশিয়ান কাফকাও বলা হয়ে থাকে। তার আত্মজীবনীমূলক নতুন বই “দা হোয়াইট বুক”ও এই বছর ম্যানবুকার পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে।