গুড্ডু

  • গুলজার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ ফজল হাসান

কখনো সে আপনমনে ভাবে, বয়সের তুলনায় বড় হয়ে গেছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করার সময় সে দশম শ্রেণীর ছাত্রীর মতো কথা বলতো। নবম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভাবতে শুরু করে, সে কলেজের ছাত্রীর মতো বড় হয়েছে, যেমন তার বদি দিদি। সে ডায়েরি লেখা শুরু করেছে এবং দিদির মতোই মেজাজী হয়ে উঠেছে। দিদির মতো আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে নিজের আত্মগর্ব জাহির করার পেছনে সময় নষ্ট করত। মায়ের আপত্তি শোনার পর তার মন ভীষণ খারাপ হতো।

বিজ্ঞাপন

‘তিনি দিদিকে কিছুই বলেন না, কিন্তু সবকিছুর জন্য আমাকে চিৎকার-চেঁচামেঁচি করতে হয়,’ সে বিড়বিড় করে বলত এবং একসময় শান্ত হয়ে যেত।
তবে সেদিন তার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যেদিন তার জন্য দিদি একটা নতুন জামা সেলাই করেছে।
‘আমি জামা পড়ব না। তোমার জন্য কেমন করে তুমি এত সুন্দর শাড়ি কিনেছো এবং আমার জন্য এই বাজে জামা বানিয়েছো?’
‘তুই যখন বড় হবি, গুড্ডু ...’
‘আমাকে গুড্ডু বলবে না। ওটা আমার নাম নয়।’
‘ঠিক আছে কুসুমজি। তুমি যখন বড় হবে, তখন তোমার জন্য শাড়ি কিনে আনব।’
‘আমি কি এখন বাচ্চা মেয়ে? আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি।’
দিদি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং গুড্ডু ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সে ভেবে পায় না, কিসের জন্য দিদি নিজেকে বড় মনে করে। দিদির চেয়ে সে ভালো দিনপঞ্জি লিখতে পারে। সে মিষ্টি করে কথাও বলতে পারে। এছাড়া দেবরাজের চেহারা এমন কোনো আহামরি নয়। তার নাক বেঢপ আকৃতির এবং ছ্যাবলার মতো দু’হাত দিয়ে সে ভুরুর ঘাম মোছে। দিদি যাকে নিজের জন্য পছন্দ করে, তার অবস্থা কী? কয়েক লক্ষ ভক্ত তাঁকে পছন্দ করে। বাস্তবে তিনি একজন বিখ্যাত সিনেমার নায়ক। দেবরাজ শুধু তার হৃদয় হরণকারীকে অনুকরণ করে, এমনকি তাঁর চুলের স্টাইলও নকল করে। এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবে তার সামনে দিদি কিছু না। দিদি এবং দেবরাজের জুটি তার এবং দিলীপ কুমারের জুটির কাছে নিতান্তই নস্যি। এই ভাবনাটা তার মনে প্রশান্তি বয়ে আনে। অলীক সুখকল্পনার রাজ্যে সে দিলীপ কুমারের বাহুর মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে বরফের মতো গলতে থাকে। সেই সময় সে আকাশের ইতস্তত ভাসমান খণ্ড খণ্ড মেঘ একত্র করে মেঘের কাঁথা সেলাই করা শুরু করে।

প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য সে অসংখ্যবার স্কুল থেকে পালিয়েছিল। সে যখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল, তখন সে ‘মধুমতি’ সিনেমা দেখেছিল।

‘হায়, সেই সিনেমায় পুরো হাতার স্যুয়েটারে তাকে কতই না সুদর্শন দেখাচ্ছিল,’ সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। যদি তার পক্ষে সম্ভব হতো, তাহলে সে পর্দার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরত। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দিলীপ কুমারের জন্য পুরো হাতার একটা স্যুয়েটার বুনবে এবং যখন দেখা হবে, তখন তাঁকে উপহার দিবে। ‘নয়া দাউর’ সিনেমায় তাকে ধূতি-কুর্তা পোশাকে দেখে সে নিজের বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল। সেদিন সে পুরোপুরি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। ঘোড়ার গাড়ির ওপর বসে দিলীপের খোলা হাওয়ায় ছড়ি ঘোড়ানোর দৃশ্য তার হাঁটু অবশ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার মনে হয়েছিল সে যে কোনো সময় মূর্ছা যাবে। কখনো সেই চলন্ত ঘোড়ার গাড়ির দুলুনির সঙ্গে সে নিজেকে দুলতে দেখেছে। শুধু তাই নয়। দিলীপ যখন ভাঙা পুলের ওপর দিয়ে টাঙ্গা চালিয়ে বজ্রগতিতে যাচ্ছিল, তখন সে পুলের নিচ থেকে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে পুল ধরে রেখেছিল। তখন তার হুঁশ ফিরে আসে, যখন পাশে বসা বান্ধবী ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল, ‘উফ্’ এবং তৎক্ষণাৎ হাত বের করে আনে। কিন্তু কেন সেই স্থূলাকার বৈজয়ন্তীমালা তাঁর পেছনে লেগে থাকবে? অকস্মাৎ সে বৈজয়ন্তীমালার ওপর ঘৃণা এবং রাগ করে সেই উদ্ভট পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করে।

‘ধান্য বটে!’ নিঃশব্দে সে ব্যঙ্গ করে। যাহোক, গঙ্গা-যমুনা চলচ্চিত্রের শেষে বৈজয়ন্তীমালার মৃত্যু তাকে সান্ত্বনা এনে দিয়েছে।

একসময় মোহাবেশ কেটে গেলে সে বিছানা থেকে ওঠে এবং টেবিলের দেরাজ থেকে ডায়েরি বের করে দিনপঞ্জি লেখা শুরু করে। ডায়েরির পৃষ্ঠার ফাঁকে ‘গঙ্গা-যমুনা’-র ছোট্ট একটা পুস্তিকা। সেই পুস্তিকার প্রচ্ছদে দিলীপ কুমার এবং বৈজয়ন্তীমালার যুগল ছবি। দিদির আলমারির ভেতর থেকে এক জোড়া কাঁচি বের করে এবং বৈজয়ন্তীমালার ছবি কেটে টুকরো টুকরো করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর সে দিলীপ কুমারের ছবিতে চুমু খায় এবং আলতো হাতে তার চুলে স্পর্শ করে। ডায়েরির পৃষ্ঠার ফাঁকে দিলীপ কুমারের ছবি রেখে ডায়েরি বন্ধ করে এবং বিছানার ওপর রাখে। তারপর ডায়েরির ওপর মাথা রেখে সে পুনরায় স্বপ্নপুরীতে চলে যায়। সেখানে শুধু সে এবং দিলীপ কুমার। আকাশের ভাসমান খণ্ড খণ্ড মেঘ জড়ো করে সে মেঘের কাঁথা বুনতে শুরু করে।

মেঘের খণ্ড জমিয়ে সে বড় করে বানাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ছেঁড়া মেঘ অনবরত আসতেই থাকে। ওগুলো বৃষ্টিও নিয়ে আসে না, কিংবা বিশাল আকৃতির মেঘ হয়েও আসে না। আর কত সময় ধরে সে মেঘ নিয়ে বুনন কাজ চালিয়ে যাবে? সে আশা করে শুধু একবার তুমুল বৃষ্টি এসে তার আবেগকে শান্ত করে দিক।
‘কেমন করে আমি আশা করি যে, দিলীপ কুমার আমাকে চিঠি লিখবে,’ সে ভাবে, ‘যেমন দেবরাজ দিদিকে চিঠি লিখে।’
‘কিন্তু দেবরাজ কী? সে কিছু না। দিলীপ কী লিখবে, সেটা কেউ কখনো লেখার চেষ্টা করতে পারবে না।’ সিনেমায় তিনি যেসব চিঠি লিখেছেন, সে সম্পর্কে কী সে কিছুই শোনেনি?

সে ডায়েরি খোলে এবং দিলীপের উদ্দেশ্যে আরেকটা চিঠি লেখা শুরু করে। বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে, যে দিনের জন্য সে উত্তাল স্বপ্নের মধ্যে কল্পনা করেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে জানতে পারে, দেখা করার জন্য মামা এসেছেন এবং দিলীপ কুমারের সিনেমার শুটিং দেখার জন্য তিনি সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন ছিল স্কুল ছুটির সময়। তাই কোনো বাঁধাও ছিল না। সে মামাজিকে বলেছে, সে-ও তাঁর সঙ্গে যাবে।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে,’ তার মামাজি বলেছেন, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।’
‘কিন্ত শুটিংয়ে গিয়ে কী করবে?’ দিদি জিজ্ঞাসা করে।
‘গুড্ডু? সে অটোগ্রাফ নিবে,’ উত্তরে মামাজি বললেন।  
‘ওকে গুড্ডু ডাকবেন না, মামাজি। ও রাগ করবে। আপনি কী জানেন না, ও এখন বড় হয়ে গেছে?’ দিদি হাসতে থাকে। গুড্ডুর ভীষণ রাগ হয়। আপনমনে সে ভাবে, ‘আমি কত বড় হয়েছি, ওরা নিজেদের চোখেই দেখবে যখন ভালোবাসার মোহন দৃষ্টি নিয়ে দিলীপ কুমার আমার দিকে তাকাবে!’ সে চলে যায় এবং সাজ-সজ্জার টেবিলের সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

তারা যখন শুটিংয়ের জায়গায় এসে পৌঁছে, তখন দিলীপ এবং বৈয়জন্তী একটা দৃশ্যের অনুশীলন করছিলেন। গুড্ডু একপাশে ভীরু পায়ে দাঁড়িয়েছিল। বৈয়জন্তীর একটা হাত ধরে দিলীপ বলেছিল, ‘লতা, পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যা আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। তুমি শুধু আমার, চিরদিনের জন্য শুধুই আমার। বলো, তুমি কি আমার সঙ্গে আসবে, লতা?’ উত্তরে লতা গভীর ভালোবাসায় দিলীপের বুকের মধ্যে মাথা রেখেছিল।
‘বেহায়া মহিলা!’ বিড়বিড় করে কুসুম বলল।
শট নেয়ার পর মামাজি বললেন, ‘গুড্ডু, আসো। এসে অটোগ্রাফ নিয়ে যাও।’
‘না, আমি অটোগ্রাফ চাই না,’ অশ্রু ভেজা চোখে সে বলল।
‘এ্যাই, বিষয় কী? কী হলো?’
‘কিছু না,’ জবাব সে বলল এবং বলেই সে হাঁটতে শুরু করে।
বাড়িতে ফিরে সে সোজা নিজের ঘরে ঢোকে। তারপর দেরাজ থেকে ডায়েরি বের করে দিলীপ কুমারের ছবিগুলো জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেয়।
‘যাও, তুমি ধান্যর কাছে যাও। এখান থেকে যাও, তুমিও।’
বলেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

/uploads/files/kukqOG39v6XPE60zGB42wD4zXQ8gjcAkoXnbs5Tf.jpeg
গুলজার ।।
ভারতের প্রথিতযশা গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, কবি, ছোটগল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক গুলজার। তাঁর আসল নাম সাম্পুরাণ সিং কারলা। তৎকালীন অখণ্ড ভারতের পাঞ্জাব (বর্তমানে পাকিস্তানে) প্রদেশের ঝিলাম জেলার দিনা শহরে ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। মূলত হিন্দি, উর্দু এবং পাঞ্জাবি ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখি করেন। ‘টু’ তাঁর একমাত্র উপন্যাস, যা ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরে শরণার্থীদের করুণ কাহিনী নিয়ে রচিত। তিনি তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি ছোটগল্প সংকলন রচনা করেন।

গুলজারের কর্মজীবন শুরু হয়েছে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে। পরবর্তীতে তিনি গীতিকার, চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে সুপরিচিতি লাভ করেন। গীতিকার হিসাবে তিনি ২০০৪ সালে ‘পদ্ম ভূষণ’ এবং ২০০২ সালে ‘সাহিত্য একাডেমি’ পুরস্কার অর্জণ করেন। এছাড়া তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারসহ একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। ‘স্লামডগ মিলিনিয়র’ চলচ্চিত্রের গান ‘জয় হো’ সঙ্গীত রচনার জন্য তিনি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেছেন।

‘গুড্ডু’ গল্পটি গুলজারের ইংরেজিতে অনূদিত একই শিরোনামের গল্পের অনুবাদ । হিন্দি থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মাসুমা আলি। গল্পটি লেখকের ‘রাভি পার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলনে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে নেওয়া।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ