এরশাদের জাপা কি বিলীনের পথে!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

রংপুরেই কি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে? খোদ রংপুর অঞ্চলে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবিতে এমন প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে।

জাপার দুর্গখ্যাত বৃহত্তর রংপুরের ২২টি আসনের মধ্যে ৭টি আসনে জয় পেয়েছে জাতীয় পার্টি। তাও আবার সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের উপর ভর করে। অর্থাৎ মহাজোটের শরীক হয়ে। যেখানেই উন্মুক্তভাবে নির্বাচন করেছে জাতীয় পার্টি, সেখানেই ভরাডুবি হয়েছে দলটির প্রার্থীদের।

বিজ্ঞাপন

বৃহত্তর রংপুরের ২২ আসনের মধ্যে ১১টি আসনে মহাজোট গঠিত হয়। আর ১১টি আসন থাকে উন্মুক্ত। এসব আসনে আওয়ামী লীগ ও জাপার প্রার্থীরা স্ব স্ব দলের প্রতীক নৌকা ও লাঙল ‍নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন।

অন্যদিকে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় সাতটি, আওয়ামী লীগ নেয় চারটি আসন। শুধুমাত্র মহাজোট থেকে পাওয়া সাতটি আসনে বিজয়ী হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। জাপার দুর্গ দাবি করা হলেও উন্মুক্ত কোনো আসনে জাপা বিজয়ী হতে না পারায় প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় পার্টি তথা এরশাদের জনপ্রিয়তা নিয়ে।

অন্যদিকে বৃহত্তর রংপুরের পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর দিনাজপুরে ৩ জেলাতেও জাপার জনপ্রিয়তায় ধ্বস দেখা গেছে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরের ১১টি আসনেও জাপার প্রার্থীরা শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হয়েছে। এই তিন জেলার তিনটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে। আর আট আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাপা।

কিন্তু মহাজোটের সমর্থন না পাওয়ায় দিনাজপুর-৬ আসনে মনোনয়ন পেলেও ভরাডুবির শঙ্কায় মনোনয়ন দাখিল থেকে বিরত থাকেন জেলা জাপার সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করেন জাপার ৭ জন প্রার্থী।

কেন্দ্রের কোনো সহায়তা না পেয়ে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে এসে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান আরও দুই জন, দিনাজপুর-২ আসনের প্রার্থী জুলফিকার হোসেন ও দিনাজপুর-৪ আসনের প্রার্থী মোনাজাত চৌধুরী। আর যারা মাঠে ছিলেন কেউই জামানত ফেরত পাননি।

যদিও পরাজিত প্রার্থীরা অনেকে নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন। দিনাজপুর-৫ আসনের প্রার্থী সোলায়মান সানি বার্তা২৪কে বলেন, ‘আমার এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিলো না। আমার দলের কিছু লোক নৌকার পক্ষে কাজ করেছে। আর ভোট কারচুপি দেখে দুপুরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াই। যে কারণে আমি ১২ হাজারের মতো ভোট পেয়েছি। না হলে ৫০ হাজারের মতো ভোট পেতাম।

সমীকরণ বলছে যেখানেই আওয়ামী লীগ তাদের পাশে ছিলো সেখানে লাঙল জিততে পেরেছে, আর যেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয়নি। সেখানে ভূপাতিত হয়েছে এরশাদের উড়ন্ত লাঙল। অবশ্য এই ধারা ২০০৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছে।

২০০৮ সালে প্রথম মহাজোট গঠিত হয়। ওই নির্বাচনে যেখানেই উন্মুক্ত ছিলো সেখানেই এরশাদের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হন। এরশাদের ঘরের সঙ্গে আসন রংপুর-৪ (পীরগাছা, কাউনিয়া) ও রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে জাপার দুই শিল্পপতী নৌকার কাছে ধরা খেয়ে যান।

গাইবান্ধা-৫ ও ময়মনসিংহ-৪ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী রওশন এরশাদ পরাজয় বরণ করেন আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর কাছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জাপার প্রার্থীদের জেতার রেকর্ড তাতেও হতাশায় ঠাসা। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের চেয়েও তাদের ভরাডুবি বেশি হয়। মাত্র ১ জন ‍উপজেলা চেয়ারম্যান বিজয়ী হন। পৌরসভাতেও হা হুতাশ।

অবশ্য সারা দেশেই উন্মুক্ত আসনে জাপার প্রার্থীদের ধপাস পতন হয়েছে। ১৪৬ উন্মুক্ত আসনে প্রার্থী দেয় জাপা। তারমধ্যে শুধু বরিশাল-৩ আসন থেকে গোলাম কিবরিয়া টিপু বিজয়ী হতে পেরেছেন। অন্যদের ফলাফল ভয়ঙ্কর খারাপ হয়েছে। এ কারণে প্রশ্ন উঠছে জাপা কি বিলীনের পথে!

জাপার এই ধারাবাহিক অবনতির পেছনে অন্যতম কারণে মনে করা হয় এরশাদের সকাল বিকেল কথা বদলানকে। আবার দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি না সরকার না বিরোধীদল, আবার সংগঠন ‍দুর্বল হয়ে যাওয়াকে দুষছেন তৃণমূলের নেতারা।

আর সংগঠন দুর্বল হয়ে যাওয়ার পেছনে যখন তখন কমিটি পরিবর্তন, আচমকা প্রমোশন, বহিস্কার ও বিগত নির্বাচনে ডুয়েল রোলকে দায়ী করছেন অনেকে। ওই নির্বাচনে এরশাদের নির্দেশে অনেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও খোদ এরশাদ নির্বাচনে থেকে যান।

যারা নির্বাচন করবেন তারা বেঈমান চিহ্নিত হবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন এরশাদ। কিন্তু নির্বাচনের পর তার ভাষ্যের বেঈমানরাই জাপার চালিকাশক্তি ছিলেন। আর যারা তার কথায় বর্জন করেছিলেন তারা পুরো পাঁচ বছর ছিলেন সবকিছু থেকে দূরে।

এবারের নির্বাচনের ভরাডুবির আরেকটি কারণ মনে করা হয়, সেটি হচ্ছে জাপার নির্বাচনের সমন্বয়হীনতা। প্রার্থী করে শুধু চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের জন্য কোনো পরামর্শ কিংবা কেন্দ্রের সহযোগিতা ছিলো না। পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ ছিলেন দেশের বাইরে, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান, মহাসচিব কারোর কোনো পরামর্শ পায়নি প্রার্থীরা। অভিযোগ রয়েছে ফোন দিলেও তারা কোনো সাড়া দেননি।

কিন্তু আওয়ামী লীগের এমন ঈর্ষান্বিত বিজয়ের পেছনে কারণ কী জানতে চাইলে রংপুর জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছরে রংপুরের যে উন্নয়ণ করেছে এই অঞ্চলের মানুষের কল্পনার মধ্যে ছিলো না। আঞ্চলিক মহাসড়ক এখন সর্বত্র বিরাজ করছে।

সৈয়দপুর এয়ারপোর্টকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে রূপন্তরের উদ্যোগ, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চালু,  সোনাহাট ও বুড়িমারী স্থল বন্দরের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন। উত্তরা ইপিজেড চালু করে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ছিটমহল বিনিময়, কুড়িগ্রাম ও রংপুরে ঘরে ঘরে চাকরি প্রদান এবং মঙ্গাকে নির্বাসন দেওয়ায় আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মানুষের ভাবনা পরিবর্তন হয়েছে।

অন্যদিকে রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে বেশিরভাগে আওয়ামী লীগ জাপার ভোট প্রায় সমান সমান। কিছু ভোটার ঝুকে গেলেই সেদিকের পাল্লা ভারি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তেমনটি হয়েছে বলে মনে করেন জাপার নেতারা।

কথা বলার জন্য অনেক বার ফোন দিলেও জাপার শীর্ষ নেতাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। ভোটের তিন দিন আগে কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বার্তা২৪কে বলেছিলেন, লাঙলের জোয়ার কমছে এমন কথার ভিত্তি নেই। বরং লাঙল জোয়ার আরও বেড়েছে উত্তরবঙ্গে।