ইফতারের জৌলুস ও পার্থিব আলোচনা সভা

  • প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

রমজানে সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করে একজন রোজাদার তার দেহ-মনের পবিত্রতা ও প্রফুল্লতা লাভ করে থাকেন। শুধু খাদ্যসামগ্রী দিয়ে রোজা ভঙ্গ করাই নয়, ইফতারির সময় দোয়া কবুলেরও সময়। এসময় খাঁটি রোজাদাররা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করে পানাহ চেয়ে থাকেন। এতে রোজারদের দেহ-মনে স্বর্গীয় প্রশান্তি আসে।

আমদের দেশে পবিত্র রমজানের রোজাকে সামনে রেখে আলোচনা সভা ও ইফতার একসংগে করার হিড়িক পড়ে যায়। এরকম কোনো কোনো আয়োজনে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নানা ধরনের পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, এমনকি গালাগালি, বিষোদগার, ঝগড়াঝাটি শেষে ইফতার করা হয়। অনেক সময় হাস্যকর বিষয়েও ইফতারে হট্টগোল বাঁধতে দেখা যায়। এতে ইফতারের মতো একটি মহান ধর্মীয় বিষয়ের মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য ও স্বর্গীয় আমেজ-অনুভুতি নষ্ট হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

অনেকে আজকাল ইফতারকে নিছক পার্টির আবরণে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ইফতার তো কোনো বিয়ে-জন্মদিন বা রাজনৈতিক-ব্যবসাপাতির কোনো বিষয় নয়। রোজাদারগণ ভুলেই বসেন কোনটা ভালো কোনটা মন্দ অথবা কোনটা গিবত কোনটা রিয়া আর কোনটা শিরক্ কোনটা তাকওয়া ! তাই রিয়া, বেদআত, ও তাক্ওয়া বিষয়গুলো বোঝাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমার মনে হয়।

কারণ, রিয়া হলো অহেতুক লোক দেখানো বিষয়। ইসলাম অহেতুক জৌলুস করে লোক দেখানো বিষয় সমর্থন করে না। রোজা একটি সাধনার ব্যাপার ও সর্বোপরি এটা আত্মিক ইবাদত। এখানে লৌকিকতার কোনো স্থান নেই। রোজা আল্লাহর প্রদত্ত বিধান। মানুষের অধ্যাত্মিক শিক্ষা ও প্রগতির জন্য রোজা হচ্ছে একটি উপায়। রোজা মানুষকে অশালীন প্রবৃত্তিরোধ করে শৃংখলাবদ্ধ হতে সক্ষম করে। এটা ধনী-গরীব সব মানুষকে একই ক্ষুৎ-পিপাসার অভিজ্ঞতা প্রদান করে থাকে। তাই একজন খাঁটি মুসলমান শুধু মিডিয়ায় প্রচারের জন্য স্বার্থপরের মত ভোগবিলাসী বড়লোকী খানাপিনায় মত্ত হবার মতো ইফতার করতে পারেন না।

বেদআত হলো যেটা মূল বিষয় থেকে বিকৃত করে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। ধর্মকাজে নতুনত্ব সৃষ্টি করা বা পরিবর্তন করাকে বেদআত বলে (ওয়াজ ও খুতবা ১০৯, ২৬০)। শরীয়তের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি বা সংমিশ্রণ করে মনগড়া ও বিকৃত জিনিস হলো বেদআত। এর ফলে শয়তানের ধোঁকার মধ্যে পড়ে গুমরাহির পথ প্রশস্থ হয়।

তাক্ওয়া হলো- খোদাভীরু হওয়া, মুত্তাক্কী হওয়া। সবসময় আল্লাহর কথা স্মরণ করা ও তাঁর ভয়ে ভীত থাকা। আল্লাহতায়ালা সবসময় বিরাজমান, সঙ্গে আছেন, সব কাজ দেখছেন-মানুষের অন্তরে এমন বিশ্বাস হওয়াটাই তাক্ওয়া । রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে মুত্তাকীর ভাব চলে আসে। তাই সে খারাপ কাজ করতে চায় না।

বলা হয়ে থাকে আমরা বাংলাদেশীরা সংকর বাঙালি। এ জাতির ভাবনা চিন্তাও সংকর ও কিছুটা মিশ্র। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতার একটি মুলনীতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাই সব ধর্মের মানুষ এদেশে সমান ধর্মীয় সুবিধা ও অধিকারের সুযোগ পেয়ে থাকেন।


প্রায় পঁচাশি ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের এদেশে রোজা ও ইফতার পালন একটি অন্যতম বৃহৎ ও মহৎ ধর্মীয় অনুষঙ্গ। এদেশের মানুষ আশাবাদী, কর্মঠ ও ভাগ্যে চরম বিশ্বাসী। বার আওলিয়ার এ পূণ্যভূমিতে ধর্মপরায়ণ মানুষের সংখ্যা অবাক করার মত। আমাদের অনেক ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ভালো কিছু করলে বহি:র্বিশ্বের মাঠে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পবিত্র ক্কাবার দিকে সিজদা দিতে দেরি করেন না। ঢাকা মসজিদের শহর হিসেবে খ্যতি পেয়েছে বহু পূর্বেই। একবার এক বিদেশী অতিথিকে হোটেলে ঘুমিয়ে দিয়ে আমি বাসায় এসে ঘুমিয়েছিলাম। পরদিন সকালে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘ঘুম কেমন হয়েছে?’ সে বলল- ‘ভোর বেলা কে যেন লাউড স্পীকারে সুর করে কিছুক্ষণ কিছু বলল। আমি সে সুরেলা আওয়াজে বিমোহিত। চল তার সাথে দেখা করব।’ আমি বললাম, সেটা কোনো মেলোডি নয় ‘আজান- আই মিন মর্নিং প্রেয়ার কল।’ সে বলেছিল, আমরা রোজ সকালবেলা প্রার্থনা করি না, অথচ তোমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি দৈনিক পাঁচবার নত হও, তোমরা কতো কৃতজ্ঞ। তাই তো তোমরা বিশ্বের সবচে’ সুখী মানুষের কাতারে নাম লিখিয়েছ!


হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশের মুসলমান তথা সবাই খুব সুখী জীবনযাপন করি। যদিও আমরা জাতি হিসেবে এখনও কোনো কোনো দেশের মানুষের চোখে দরিদ্র, হাতপাতা ও মিসকিন মানুষ বলে পরিচিত। সেসব দেশের মানুষও একসময় অভাবী ছিল, খেতে পেতো না। তারা এখন অনেকে সমুদ্রে শততলা বাড়ি বানিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে। শ্রমজীবি বিদেশিদের তারা বেশি খাঁটিয়ে নিয়ে কম মজুরী দেয়, নির্যাতন করে, ঘৃণা করে। নিজেদের বিলাস-ব্যসনের পাশাপাশি তাদের অনেকের মনে দারিদ্র্য ও হতাশা জন্ম নিয়েছে।

মনে দারিদ্র্য ও হতাশা থাকলে সুখী হওয়া যায় না। আজকাল আমাদের দেশেও অনেকে নব্য ধনবান হয়েছেন, তাদের অনেকের মনে অসুখ ধরেছে। কেউ কেউ দু’চার বছরে এত বেশি ধনবান ও ক্ষমতাশালী বনে গেছেন যে- সবসময় ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলাফেরা করে থাকেন। এরা রাস্তায় রং সাইডে চলেন। কেউ তাদের অন্যায় কাজে বাঁধা দিলে বা প্রতিবাদ করলে তাদেরও টুঁটি চেপে ধরতে উদ্যত হন।

ক’দিন আগে একজন পাতি নেতা রং সাইডে গাড়ি চালিয়ে উল্টো ট্রাফিক পুলিশকে চাকরি খেয়ে নেয়ার ভয় দেখিয়ে গালাগালি করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। এর কোনো বিহিত হতে দেখিনি। এ ধরনের অনেক পাতি নেতা বড় বড় ইফতার ‘পার্টি’ দেন। অনেক পাতি নেতার চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটিতে চালচুলো ছিল না। এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।

এছাড়া আজকাল অনেক বড় বড় কর্তারাও ইফতার ‘পার্টি’ দেন। সেসব ‘পার্টি’ তাঁদের নিজেদের বেতন বা বাবার টাকায় নয়। তাঁরা আদেশ দেন বড় বড় ঠিকাদার, অবৈধ চোরাচালানী, মাদক ব্যবসায়ীকে এ সব ‘পাটির্র’ খরচ দিতে। এতে উঠতি পাতি নেতা ও অবৈধ মালদারগণ লক্ষ টাকা চাঁদা দিয়ে এসকল ‘পাটির্র’ আয়োজন করে দিয়ে নিজেরা আরো কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ পান। এরা-ওরা মাসতুতো ভাই। ইফতার বা অন্য যে অবয়বেই হোক না কেন- এই অনৈতিক ‘পার্টি-কালচার’ অচিরেই বন্ধ করতে হবে।

আজকাল এসব ইফতার ‘পার্টিতে’ রঙ-রেজিনী দিয়ে সুদৃশ্য গেট সাজানো হয়, রঙীন আলো দিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। দেশের হোমড়া-চোমড়া মানুষরাই এখানে দাওয়াত পেয়ে থাকেন। জৌলুসে ভরা, লোক দেখানো এসকল ইফতার পার্টিতে আদৌ কোনো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য থাকে না। পাক-নাপাক, পর্দা-বেপর্দার সমন্বয়ে আজকাল ব্যবসা অথবা রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ইফতারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজ অমুকের সম্মানে ইফতার-তা হবে কেন? এসব ইফতার ‘পার্টিতে’ দামী রেস্টুরেন্ট বা পাঁচতারা হোটেলের বহু পদের বাহারী খাবার আনানো হয়। ইফতার ‘পার্টি’-র সুস্বাদু বহুপদের স্বাদ নিতে গিয়ে মাগরিবের নামাজের কথা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। অনেকে অশালীনভাবে সেজেগুজে ইফতার করতে বসেন। প্রতিদিন টিভিতে এসব দেখানোও হয়ে থাকে। এগুলো রোজার সংযম, আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা নয়। বরং এগুলো দ্বারা রমজান মাস, রোজা ও ইফতারের মর্যাদাকে প্রহসনে রুপান্তরিত করা হয় মাত্র। লৌকিক, ভোগবাদী এসকল ইফতার ‘পাটির্র’ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বর্তমানে আমরা আসল ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি।

কেউ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে উচ্চস্বরে মাইক বজিয়ে শতপদের ইফতারীর পসরা নিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে উল্লাস করে ইফতার করবেন-আর প্যান্ডেলের পাশের অভাবী মানুষের খোঁজ নেবেন না অথবা কেউ একটু ছোলা-মুড়ি পাবার আশায় থালা হাত বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে- এটা রোজার শিক্ষা নয়। পাশাপাশি আলোচনা সভার নামে ইফতার করতে এসে ‘পার্টিতে’ বসে রোজার আহকাম-আরকান ভুলে গিয়ে আমরা কোনটা গিবত, কোনটা রিয়া আর কোনটা বেদআত গুলিয়ে ফেলছি।

এসকল ইফতার ‘পাটির্র’ আয়োজন ধর্মীয় কাজের মোড়কে আমাদের ধর্মে নব্য অপচয় সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আজকাল মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই বোন নিয়ে পরিবারের সংগে বসার ফুরসৎ হয় না। সবাই একত্রে ইফতার করার সময় যেন একবারেই উধাও হয়ে গেছে। এতে চিরায়ত পারবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। মা-বাবারা তাদের উঠতি বয়সের সন্তানদের সাথে ভালো করে কথা বলার সময় পান না। একটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে থাকলে নৈতিকতা শাণিত হয়। সাথে বাবা মায়ের স্বেহের বচন, উপদেশ পরামর্শ ইত্যাদি থেকে সুসন্তান তৈরি হয়। এভাবে একটি ইতিবাচক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়ে থাকে। নব্য ইফতার পার্টি সংস্কৃতির আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক নেতাদের একে অপরের মুখের বিষোদ্গার শুনে নবীনরা নেতিবাচক মানসিকতা অর্জন করছে।

ইসলামে মানুষ মানুষে ভেদাভেদের কোন স্থান নেই। সকল মানুষের সম-সুযোগের ভিত্তিতে সামাজিক সহ-অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারলে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হবে। সামাজিক বৈষম্য প্রকট হলে সামাজিক বঞ্চনা থেকে নানামুখি সংকট তৈরি হতে থাকবে। সামাজিক এসব সংকট আজকাল অপরাধ বৃদ্ধি করে চলেছে। বর্তমানে সুবিধাভোগী রং সাইডে চলা পাতি নেতারা এবং তাদেরকে অবৈধ মদদদাতা একশ্রেণির নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকর্তা ও সংগঠকরা চরম অনৈতিক কাজে ভীষণভাবে সক্রিয়। এসব লুটেরা এখন দেশের নিম্ন ও মধ্যমশ্রেণির কর্মজীবি, সৎ, ধর্মভীরু মানুষের ঝুলি ও হাঁড়ির ওপর নজর দিয়েছে।


রমজান মাসে আলোচনা সভা ও ইফতার ‘পার্টির’ নামে এখন বিকৃত ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের সুমহান ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বিতর্কিত করে চলেছে। কারণ, লৌকিকতা, জৌলুসে ভরা বে-হিসেবী তথা অবৈধ উৎসের অর্থে কেনা বা সংগৃহীত খাবার মু’মিনদের ইফতারের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। তাই এখনই সতর্ক হয়ে সেসকল পথ পরিহার করা আমাদের আশু করণীয়।


আসুন আমরা সবাই পবিত্র রমজানের সুযোগকে কাজ লাগিয়ে সংযমী হই, কল্যাণ, ক্ষমা, মুক্তি তথা মাগফেরাত ও নাজাতের এই ভরা মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক ইফতার সংস্কৃতি পরিহার করে খাঁটি রোজাদার ও পূণ্যবান হয়ে উভয় জগতের সাফল্য খোঁজার চেষ্টা করি।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান