ডাকসু নির্বাচন এবং নতুন করে দায়মুক্তির দায়

  • ফরিদুল আলম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফরিদুল আলম/ ছবি: বার্তা২৪.কম

ফরিদুল আলম/ ছবি: বার্তা২৪.কম

ভোট শেষ হবার আগেই জাসদ ছাত্রলীগ বাদে প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। নতুন করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন, হলের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনে ভোটের ব্যবস্থা করা, লোহার বাক্সের বদলে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সরবরাহসহ নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে এই বর্জন এবংআন্দোলন কর্মসূচি।

দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও একে ঘিরে যতটুকু উৎসবের আমেজ থাকবে বলে মনে করা হচ্ছিল, সেসবের অনুপস্থিতিতে আগে থেকেই মনে হচ্ছিল যে এই নির্বাচন সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। নির্বাচন বর্জনের সাথে সাথে বর্জনকারী দলগুলো আগামীকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট শুরুর আগেই বাক্সভর্তি ব্যালট পেপার উদ্ধার ও কর্তৃপক্ষের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করার মধ্য দিয়ে এটি আর কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বেগম রোকেয়া হলেও খালি ব্যালট বাক্স সিলগালা নিয়ে ও কয়েকটি বাক্সে সিলবিহীন ব্যালট ভর্তি করে অন্যরুমে রেখে দেওয়া নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের বদানুবাদে নির্বাচন বিলম্বিত হয়। এটাও এক কথায় দুঃখজনক বিষয়।

এর বাইরে বেগম রোকেয়া হলে সাধারণ ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে একজন ভিপি প্রার্থীসহ কয়েকজন নেতা হামলার শিকার হয়েছেন। এছাড়াও আক্রমণের শিকার হয়েছেন প্রগতিশীল ছাত্রঐক্যের পক্ষ্য থেকে মনোনীত ভিপি প্রার্থী। এগুলোকে কোনো বিবেচনাতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ব্যক্ত করার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি না। কারণ এটি দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন, যেখান থেকে দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা দেশ সেবার শপথ নিয়ে বের হন।

আমার মনে আছে এরশাদের পতনের পর বিএনপি যখন ক্ষমতাসীন হয়, ১৯৯৪ সালে একবার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচনের দিনক্ষণ ও সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসল, অনিবার্য কারণে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণার। এরপর কেটে গেছে আর ২৫ বছর। তাই কিছুটা শঙ্কায় ছিলাম শেষতক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না এ নিয়ে।

এদিকে নির্বাচনের প্রচার নিয়ে বিদ্যমান ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে কয়েকবার যে, প্রতিপক্ষের প্রচারে তারা বাঁধা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্বাচন বানচাল হতে পারে এমন সব সম্ভাবনা দূর করে দিয়েছে। শংকা কাটল নির্বাচনের দিন এল।

বিভিন্নহলের ভোটাররা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য যখন উৎসবমুখর, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের তীব্রভাবে আঘাত করেছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা, যাকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ ছাত্ররাজনীতির পীঠস্থান– সেখানে ঘটতে পারে এটা মেনে নেওয়া যায় না।

কেন জানি মনে এক ধরণের শংকা ছিল ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী ছাত্রসংগঠনের কিছু অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের কারণে এই নির্বাচনটি বিতর্কিত হতে পারে। হলোও তাই। নির্বাচনের আগে থেকেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগ কর্তৃক হল দখল, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জোর পূর্বক নিজেদের কর্মসূচিতে সামিল করাসহ কিছু অভিযোগ জানিয়ে আসলেও অন্ততঃ জাতীয় নির্বাচনের বাইরে একটি প্রাতিষ্ঠানিকবলয়ের ভেতর নির্বাচনটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নীতি নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে কলঙ্কমুক্ত হবে- এমন প্রত্যাশা থাকলেও দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আমাদের জাতীয় রাজনীতির নোংরামী বেশ শক্তভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালগুলোতেও, অন্ততঃ ডাকসু নির্বাচন থেকে এটা স্পষ্ট।

ডাকসু নির্বাচন নিছক দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচন নয়, কিংবা দীর্ঘ সময় পর এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নয়, আমাদের সকলের প্রত্যাশা ছিল এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জট খুলবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের এবং সেই সাথে কলেজগুলোতেও এবার ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের সর্বত্র ছাত্ররাজনীতির সত্যিকারের প্রাণ ফিরে আসবে, ছাত্রছাত্রীরা সত্যিকারের রাজনীতি সচেতন হবে এবং সর্বোপরি রাজনীতি হয়ে উঠবে শিক্ষাভিত্তিক। ছোট করে কেবল বলতে হচ্ছে, হতাশ হলাম।

বাংলাদেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আমাদের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রামের সূতিকাগার। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়নি, পাকিস্তানের অন্তর্গত, তখন এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ভাষা আন্দোলনের সূচনার মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম আমাদের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ দেখিয়েছিল। পরবর্তীতে আরও কত আন্দোলন সংগ্রাম।

আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পেশকৃত ৬ দফার স্বপক্ষে আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে নিয়ে আসা, পরবর্তিতে ৭০ এর নির্বাচনের দাবি পূরণ– এসবই সম্ভব হয়েছিল কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তিতে ভরা আর জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্ভাসিত ছাত্রছাত্রীদের কারণে। বাংলাদেশের সকল গণতন্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব।

আমার কাছে মাঝে মাঝে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা গণতন্ত্রের স্লোগানে মুখরিত, তাদের ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়। ছাত্রদের দিয়ে আন্দোলন করিয়ে দাবি আদায় করে নিয়ে, গুটিকয় মাস্তান বাহিনীকে হাত করে পুরো ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করার দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? একদিকে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য ছাত্রদের ব্যবহার, অন্যদিকে পোশাকি গণতন্ত্রের অবয়বে ছাত্ররাজনীতিকে বনসাই বানিয়ে রাখা দেশের গণতন্ত্রকে এক দীর্ঘমেয়াদী সংকটে রাখার সামিল। আমরা যে আজ সত্যি সংকটে রয়েছি, ডাকসু নির্বাচন কিন্তু সেই কথাই বলছে।

দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পথ অতিক্রম করে আজ অনুষ্ঠিত হল ঢাকা ডাকসু নির্বাচন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘বেটার লেট দ্যান নেভার।‘ কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের বিলম্ব নিয়ে কোনো যুক্তিই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।  গত শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ নব্বয়ের গোড়াতে শেষ নির্বাচনটি যখন অনুষ্ঠিত হয় তখন দেশে এরশাদের স্বৈরশাসন বিরাজমান ছিল। সেসময় ডাকসুসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীলছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বিত আন্দোলন এরশাদের পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্তও দেশের বিভিন্ন কলেজগুলোতে ছাত্রদের ভোটে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসলেও পরবর্তী সময়ে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে এসব নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

ধীরে ধীরে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্যের ক্ষেত্রে পরিণত হতেথাকে। ফলতঃ ক্ষমতাসীন দলগুলো সাধারণ ছাত্রদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার বিষয়ে প্রচ্ছন্নভাবে ভূমিকা পালন করে। আর একারণেই বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নয়, সকল প্রতিষ্ঠানেই একাধারে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয়ে যায় ছাত্ররাজনীতির নতুন সংস্কৃতি। এভাবেই ক্যাম্পাস, হল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বত্রই দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের অপ্রতিরোধ্য দাপট।

আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচনটি কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। নির্বাচন যদি কলঙ্কজনক হয়তবে এই কলঙ্কের কালি এর সাবেক ও বর্তমান সকল শিক্ষার্থীর গায়েই লাগে। আমাদের গৌরবের জায়গায় এমন বিতর্কের কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না।

তবে এক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে আমাদের ক্ষমতাসীন বর্তমান দলসহ সকল দলের মধ্যে এই মর্মে সদা শংকা কাজ করে যে যেকোনভাবেই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দাপট কমতে দেয়া যাবে না।এতদিন ধরে এই ডাকসু নির্বাচন না হওয়া এবং অবশেষে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা থেকে এটাই অনুমেয় যে সর্বদা ক্ষমতাসীনদের ভূত আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

সবশেষে, আর একটি শংকার কথা ব্যক্ত না করে পারছি না। যে নির্বাচনটি ব্যাপক আশাবাদের একটি নির্বাচন হতে পারত, তা না হয়ে সকলের হতাশাকেই অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই হতাশার সাথে কাজ করবে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক পাল্টাপাল্টি অবস্থান, যা সময়ের সাথে আর সহিংস হয়ে উঠতে পারে। ছাত্র রাজনীতির এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগারে যে কলঙ্ককিত অধ্যায়ের সূচনা হল, এর থেকে দায়মুক্তির দায়ও কিন্তু ছাত্রদের, কিন্তু কবে ঘটবে সেই দায়মুক্তি?

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।