সাধারণত কোনো মানুষের মাতৃভাষাকেই ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা ‘প্রথম বা প্রধান ভাষা’ বলা হয়। বিশেষত, যারা একাধিক ভাষা জানেন, তাদের সামনে ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামক একটি প্রসঙ্গ চলে আসে। উন্নত বিশ্বে, যেমন ইউরোপ ও আমেরিকায় একাধিক ভাষা জানার দরকার পড়ে। কারণ, সেসব সমাজ বহুভাষী। সেখানে বহু ভাষা চলে। মানুষকেও তাই নানা ভাষা জানতে হয় সমাজ-সংসারের নানা কাজ-কর্মের সুবিধার্থে। তথাপি একটি ভাষাকে তার ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা তার জন্মগত মাতৃভাষা।
‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। একজন ব্যক্তির প্রথম ভাষা বা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হবে কোনটি? যে দেশে জন্মেছে, সে দেশের ভাষা? নাকি মাতৃভাষা? প্রশ্নটি আরও স্পষ্ট করলে বলতে হয়, ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ কি মাতৃভাষা হবে? নাকি মাতৃভূমিতে যে ভাষা প্রচলিত রয়েছে, সেটি হবে? এমন বিতর্ক সচরাচর শোনা যায়।
সমস্যাটি আজকাল অনেক প্রবাসী বাংলাভাষী পরিবারকেই মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কারণ, তাদের সন্তান জন্মগতভাবে বাংলাভাষী। আবার যে দেশটিতে সে জন্ম নিচ্ছে, সে দেশে প্রচলিত ভাষাটিকেও সে শিশুকাল থেকেই চমৎকারভাবে শিখে ফেলে। অর্থাৎ মায়ের মুখের ভাষা এবং জন্মস্থানের ভাষা, উভয়ই সে অনর্গল বলতে পারে। উভয়ই তার কাছে সাবলীলতা পায়। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, তার ‘ফাস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ কোনটি?
লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব-পুরুষের ভাষা নয়, ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে প্রবাসের ভাষাকেই স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত করে নিচ্ছে মাইগ্রেটেড অভিবাসীদের উত্তর-পুরুষরা। প্রবাসী পরিবারের পরের জেনারেশনের একটা অংশ হয়তো তাদের পূর্ব পুরুষদের মাতৃভাষা পিতা-মাতার অসচেতনতার কারণে একেবারেই শিখছে না, নয়তো নিজ আগ্রহ ও গৃহের অনুকূল পরিবেশে আংশিকভাবে রপ্ত করতে চাইছে। এতেই তৈরি হচ্ছে সমস্যা। জন্মগত ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ হারিয়ে সে দেশের ভাষাটিকেই প্রথম বা প্রধান ভাষা রূপে গ্রহণ করছে। সে হয়ে যাচ্ছে ইংরেজি বা ফরাসি বা স্পেনিশ ভাষী একজন মানুষ। জাতিগত অর্থে সে যে একজন বাংলা ভাষী, সে তথ্যটিই হারিয়ে যাচ্ছে।
‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ বিবেচনার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ভাষা শুধু বলার বিষয়ই নয়, ভাষা এক ধরনের উত্তরাধিকারও বটে। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মতো জগতের প্রত্যেকটি ভাষারই নিজস্ব ভাণ্ডার আছে। আছে বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গির একটি অন্তর্নিহিত স্বকীয়তা। যার মাধ্যমে মানুষের আবেগ, অতীত, অনুভূতি ইত্যাদি পরম্পরাগত সূত্রে গ্রন্থিত থাকে। ভাষার ভিত্তিতেই ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজের মূল্যবোধ, অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস (জীবনদর্শন) আর ঐতিহ্যসূত্র বিকশিত হয়। সামাজিক মূল্যবোধগুলো সক্রিয়ভাবে চিন্তাধারায় কিংবা কথপোকথনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বাস্তবতা পায় ভাষার হাত ধরেই।
ফলে একজন বাংলা ভাষী যদি প্রজন্মান্তরে ইংরেজ ভাষী বা ফরাসি ভাষী হয়ে যায়, তাহলে তার জাতিগত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও মনোজগতের কাঠামোটিই ভেঙে যেতে পারে। তার চিন্তা ও চেতনায় হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তাটিও আর তখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন শেখা ভাষা জগতের একজন নবীন সদস্য হিসেবে সে হয়তো কথা-বার্তা বলতে পারবে, কিন্তু সে ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরম্পরার সঙ্গে মোটেও একাত্ম হতে পারবে না। কারণ, নতুন ভাষাটি অনাদীকাল ধরে তার নয়। ভাষাটির ঐতিহ্য ও অতীতে তার পূর্ব-পুরুষের কোনো অবদান নেই। নিজেকে সে গভীরতম অর্থে সে ভাষার অংশ করতে পারবে না।
সম্ভবত এ কারণেই ইহুদিরা কখনোই নিজের ভাষা ভুলে যায়নি। ইহুদিরা শত শত বছর বিশ্বের নানা দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে চড়ে বেড়িয়েছে। এক দেশ থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আরেক দেশে। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি হওয়ার আগে শত শত বছর ইহুদিরা এমনিভাবে নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বহিরাগত হয়ে জীবন-ধারণ করেছে। প্রয়োজনে সে সব দেশের ভাষা শিখেছে, সংস্কৃতিকে বুঝেছে, সাহিত্যচর্চা ও কাজকর্ম করেছে। কিন্তু নিজেদের আদি ভাষা হিব্রুকে বিস্মৃত হতে দেয়নি। ঘরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিব্রু চর্চা করেছে। প্রাচীন হিব্রু সাহিত্যের ইতিহাসকে নিজেদের চর্চায় সংরক্ষণ করেছে।
ইহুদিদের ভাষাপ্রেম ও ভাষা-সংরক্ষণের কারণে দেখা গেল, যেদিন ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক সেদিন থেকেই সেখানকার রাষ্ট্রভাষা হিব্রু। আরব, ইউরোপ, রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানি ইত্যাদি যে দেশ থেকেই ইহুদিরা এসে ইসরায়েলে বসতি স্থাপন করুক না কেন, হিব্রু বলতে তাদের মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। বরং হিব্রু ভাষা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদেরকে নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েলে নৈকট্য লাভ করতে ও একাত্ম হতে সাহায্য করেছে।
হিব্রু ছাড়াও আরেকটি ভাষাকে তারা রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট হয়েছে। যদিও ভাষাটি হিব্রুর মতো প্রাণ পায়নি। ভাষাটি হলো ইডিড, যা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে বসবাসকারী ইহুদিরে ভাষা। বহু বিখ্যাত লেখক ছিলেন ইহুদি এবং ইডিড ভাষী।
অতএব, নতুন দেশে গেলেই এবং জন্ম থেকে সেদেশের ভাষাটি সম্পূর্ণভাবে রপ্ত করলেও জাতিগত-সংস্কৃতিগত-ঐতিহ্যগত পরম্পরায় প্রাপ্ত ভাষাটিই মানুষের ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ হওয়ার দাবি রাখে না। জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রাপ্ত ভাষাটিই ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ হওয়ার দাবিদার। নাগরিকত্ব বদলের মতো যারা ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ বদলের চেষ্টা করেছেন বা করছেন, তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছেন। নিজের অস্তিত্ব ও জাতিগত পরিচিতিকে নস্যাৎ করছেন। জীবনের জন্য সকল ভাষাই শেখা যাবে এবং শেখা উচিতও। কিন্তু সেটা নিজের জন্মগত ভাষাকে জলাঞ্জলী দিয়ে নয়।
বিপ্লবের ছায়াসঙ্গী হচ্ছে প্রতিবিপ্লব। যেখানেই বিপ্লব সেখানেই প্রতিবিপ্লবের আলামত। কোথাও সফল হয়। কোথাও ব্যর্থ। বাংলাদেশের বিপ্লব নিয়েও দেশে-বিদেশে আলোচনা এখন তুঙ্গে। নানামুখী প্রচারণা। নানা ছক তো আছেই। সরকারের ভেতরেও একটি মহল প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে। যদিও এর আগে অনেকগুলো পরিকল্পনা বা ছক ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পরাজিতরা বসে নেই। তারা বিজয়ের হাসি হাসতে চায়। তাই বলছে, ক’দিন যায় দেখুন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন টানটান উত্তেজনা। বলা হচ্ছে, প্রতিবিপ্লব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অবাধ স্বাধীনতার যুগে এমনটাই স্বাভাবিক। ফিলিপাইনেও বিপ্লবের পর এমনটা ঘটেছিল। সরকারি মহল কি তাহলে চিন্তিত? প্রশ্ন রেখেছিলাম সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। বললেন, এটা নতুন কোনো খবর নয়। আমরা সবাই জানি এবং দেখছি। নানাভাবে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। আপনি কি তাহলে চিন্তিত? জবাব দিলেন সোজাসাপটা। বললেন, চোখ-কান খোলা রেখেছি। যা ব্যবস্থা নেয়ার নিচ্ছি। বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব কি তাহলে অবশ্যম্ভাবী! ইতিহাস তো তাই বলে। আমরা আমাদের কাজ করছি। কিছু ভুল-ত্রুটি তো আছেই। এটা দূর করে আমরা গন্তব্যে যেতে চাই। সে গন্তব্য কোথায়? এই প্রশ্ন কেন? আমরা তো বলেছি সংস্কার এবং নির্বাচন, আমরা দুটোই চাই। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে আমরা থাকতে চাই না। আমার তো সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি তো জানো আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখাই। এখন তো আমি আর কোনো স্বপ্নও দেখতে পারি না। যেখানে ছিলাম আমি একজন মুক্ত মানুষ।
এখানে কি আপনি মুক্ত নন? মুক্ত কিনা জানি না, তবে ফাইলে বন্দি। এন্তার ফাইল আমাকে সই করতে হয় প্রতিদিন। অন্যকাজে সময় দিতে পারছি কম- এটা সত্য। বাস্তব সত্য।
সব ফাইল কি পড়তে হয়? সব ফাইল পড়তে হয় না। কিন্তু সই করতে হয়। দুনিয়ায় ফাইল উঠে যাচ্ছে, সবই ডিজিটাল। আমরা এখনো ‘লাল ফিতায় বন্দি’। এই অবস্থার অবসান কবে হবে।
স্যার, সুযোগ যখন পেলাম তখন জানতে ইচ্ছা করে আপনার উপদেষ্টামণ্ডলী কেমন করছেন? পাল্টা প্রশ্ন- তোমার কী ধারণা? আমার ধারণা এখানে মুখ্য নয়, মানুষ কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ভালো-মন্দ সবই আছে। কেউ দুর্বল, কেউ সবল। আমি তাদের কাজ দেখছি, মানুষও দেখছে। একটা জায়গায় পৌঁছে তো আমাকে নম্বর দিতে হবে। সেটার কাজ এখন চলছে। মানুষ চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা কী পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলাম এটা তো অজানা নয়। চারদিকে তো অস্থিরতা। মানুষ তো স্বস্তি চায়। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে- তা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। মানুষ পরিবর্তন দেখতে চায়। আর এখানেই শেষ হয়ে গেল ষাট মিনিটের আলোচনা।
লেখক: মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন
সৌজন্য: মানবজমিন
বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয়, যেখানে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা এবং অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করার গুরুত্বকে সামনে আনা হয়। ২০২৪ সালের বিশ্ব খাদ্য দিবসের থিম বা প্রতিপাদ্য হল "Right to Food for a Better Life and a Better Future," (উন্নত জীবন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার)। খাদ্য শুধু একটি মৌলিক প্রয়োজন নয়, বরং এটি মানুষের মৌলিক অধিকার, যা মানুষকে টিকে থাকতে এবং উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন।
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪-এর এই থিম জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) ২-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার মূল লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে "শূন্য ক্ষুধা" নিশ্চিত করা। SDG ২-এর উদ্দেশ্য হলো নিশ্চিত করা যে, পৃথিবীর সব মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।
তবে এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় অগ্রগতি উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর, এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার প্রকোপ আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। "শূন্য ক্ষুধা" অর্জনের জন্য দরিদ্রতা, বৈষম্য এবং সম্পদের অভাবের মতো ক্ষুধার মূল কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণও অপরিহার্য।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা এখনো একটি গুরুতর সমস্যা, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। যদিও আগের কয়েক দশকে ক্ষুধা হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সমস্যার মারাত্মক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা পূর্বের অগ্রগতি অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করেছে। কোভিড-১৯ মহামারি, ক্রমবর্ধমান সংঘাত, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং জলবায়ু সংকটের প্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশ এবং সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই সমস্যার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত, যেখানে ক্ষুধা এবং অপুষ্টির পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমালিয়া, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদানের মতো দেশগুলোতে এই অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যেখানে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ক্ষুধার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অঞ্চলে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য খাদ্য প্রাপ্তি অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং তারা মারাত্মক অপুষ্টির শিকার।
আফ্রিকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, যেখানে মহাদেশটির মোট জনসংখ্যার ২১% বা ২৮২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। সাব-সাহারান আফ্রিকা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং অনিয়মিত আবহাওয়ার প্রভাবে খাদ্য সংকটের মাত্রা বেড়েছে, যা সেখানে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা আফ্রিকায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। ফিলিস্তিনের গাজায় ও ইয়েমেনে চলমান সংঘাতের কারণে দেশটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটগুলোর একটির মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ দেশটির কৃষি অবকাঠামোকে ধ্বংস করেছে, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এবং বেশিরভাগ মানুষ খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
সিরিয়ার পরিস্থিতি একই রকম, যেখানে দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যা খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারী লোকজন, যেমন লেবানন এবং জর্ডানের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারীরা, মারাত্মক খাদ্য সংকটের সম্মুখীন, যেখানে অপুষ্টি এবং দুর্বল স্বাস্থ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকটও ক্ষুধার সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, ১০৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ যুদ্ধ, নির্যাতন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই শরণার্থী শিবিরগুলোর বেশিরভাগে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের অভাব রয়েছে, যা শরণার্থীদের বিশেষ করে নারীদের এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হারকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এখানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে, এবং খাদ্য নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে, তবে শরণার্থীরা এখনও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ভুগছে।
ক্ষুধা মোকাবিলায় লিঙ্গ বৈষম্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে নারীরা খাবার নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়, কারণ তারা প্রায়ই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বেশিরভাগ পরিবারে নারীই প্রধানত খাদ্য সরবরাহকারী হলেও, তাদের ভূমি বা সম্পদে প্রবেশাধিকার কম থাকে।
যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন নারীরা নিজেদের চেয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যা তাদের অপুষ্টির ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, সংঘাত-সংকুল অঞ্চল এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে নারীরা যৌন হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের ক্ষুধা এবং অপুষ্টির সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে।
জলবায়ু পরিবর্তনও ক্ষুধার সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পৃথিবীর অনেক অংশে কৃষি প্রধান আয়ের উৎস হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায়শই দেখা যায়, ক্ষুদ্র কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতএব, বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ এর ব্যর্থতা ক্ষুধার সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।
বাংলাদেশ, যদিও সাম্প্রতিক কয়েক দশকে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, তবে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এখনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং কৃষি জমির অভাব বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই সাফল্যকে বিপন্ন করছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে খাদ্য কেবল পুষ্টিই নয়, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার। এমন এক বিশ্বে যেখানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ সকলের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট, কারো ক্ষুধার্ত থাকা অগ্রহণযোগ্য। যদিও ক্ষুধা দূরীকরণের পথে বাধা অসংখ্য, আমাদের কাছে সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষুধার মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজে বের করার এবং আরও স্থিতিস্থাপক ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জ্ঞান ও প্রযুক্তি রয়েছে। প্রত্যেকের নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাবারের অ্যাক্সেস নিশ্চিত করে আমরা কেবল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনমান উন্নত করতে পারব না, বরং একটি আরও ন্যায়সঙ্গত, টেকসই এবং সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
শিক্ষার মানে ক্রমাবনতি নিয়ে বিতর্কের মাঝেই মঙ্গলবার দেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ ও মাদরাসা এবং কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের ফল প্রকাশিত হল। গতানুগতিক ধারায় এবারও প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে কিছু মূল্যায়ন উঠে এসেছে। বার্তা২৪.কম-এর প্রতিবেদন বলছে, এবার উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতকার্য হয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন। গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরমধ্যে ছাত্রীদের পাসের হার ৭৯ দমশিক ৯৫ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাশের হারে ছেলেদের চেয়ে ৪.৩৪ শতাংশ এগিয়ে মেয়েরা।
অন্যান্য বছরের মতোই উদ্বেগের খবর হচ্ছে-দেশের ৬৫টি কলেজের কেউই পাস করেনি এবার। গত বছর শূন্যপাস করা কলেজের সংখ্যা ছিল ৪২টি। সেই হিসাবে এবার শূন্য পাস কলেজের সংখ্যা বেড়েছে ২৩টি। কেবলমাত্র রাজশাহী বিভাগেরই ১২ কলেজের অংশ নেওয়া সবাই অকৃতকার্য হয়েছে।
শিক্ষকদের অপেশাদারিত্ব, বিশেষ করে শ্রেণি কক্ষে পাঠদানে অনীহা, কোচিংয়ের নামে শিক্ষাকে বাণিজ্যকীকরণের প্রবণতা প্রভৃতির সাম্প্রতিক দশকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ঐতিহ্যিক পরম্পরায় ধ্বস নামিয়েছে। অভিবাবকদের দায়িত্বশীলতার অভাব, সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষকদের শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে অন্যদিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়াকে এই অধঃপতনের জন্য দায়ী করছেন অনেকে।
গেল বছরের চেয়ে শূন্য পাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ২৩টি। শিক্ষার মানোন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা অব্যাহত থাকলে পরের বছর এই সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য, ঘন ঘন শিক্ষাক্রম বদলানোর নেতিবাচক প্রভাবকেও এই ক্রমাবনতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের দাবি, এই ঘন ঘন শিক্ষাক্রম বদলে ফেলার কারণে শিক্ষার্থীদের খাপ খাওয়াতে বেগ পেতে হচ্ছে।
তবে কারণ যাই হোক, উচ্চ মাধ্যমিকে গেল বছরের ধারাবাহিকতায় ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউই কৃতকার্য হতে না পারার দায় সেইসব কলেজের শিক্ষক, পরিচালনা পর্ষদ কিংবা অভিবাবক কেউ এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে প্রত্যক্ষভাবে পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের মনস্ক করে তোলার দায়িত্ব বর্তায় যে শিক্ষকদের উপরে। তারা যে বিগত দিনগুলিতে যথেষ্ট উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত না গড়তে পারলে শিক্ষার এই ক্রমাবনতি ঠেকানো কঠিন হবে।
১.
সরকার পরিবর্তনের পর সংস্কারের ঢেউ চলছে। কয়েকটি কমিশনও গঠিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের পুরনো প্রেতাত্মাদের তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র। এতো কিছুর পরেও বলা হচ্ছে, 'যারা এখন দেশ পরিচালনা করছেন তাদের কারোরই দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তারা সবাই এনজিও পরিচালনা করেছেন।' এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। আরও এক ধাপ এগিয়ে 'ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শুধু সরকার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছুই বদলায়নি' বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
রাজনীতিবিদদের 'কিছুই বদলায়নি' ধরনের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি সংস্কারের আওতায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হওয়ার নাগরিক সমাজও সরব। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো স্পর্শকাতর ইস্যুসমূহ।
২.
ছাত্র-জনতার এবারের অভ্যুত্থানে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়। গণ–অভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, তা নিয়ে যৌথ কলাম লিখেছেন ফারহানা হাফিজ, শাম্মিন সুলতানা, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও সাবিনা পারভীন। তাঁরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তা হলো ‘সংস্কার’। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় খুব আলোচনা হচ্ছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা। কিন্তু ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে আমরা দেখছি, বেশির ভাগ উদ্যোগ ও আলোচনা থেকে নারী এবং আন্দোলনের নারী সমন্বয়কেরা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ পারবে কি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারীর হিস্যা ও অংশীদারত্বের বিষয়টি সমস্বরে উচ্চারণ করতে? পারবে কি নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সংস্কারের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে?
এই মর্মে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে যে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন করে তাঁর সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা কি পূর্ণভাবে প্রস্তুত? আমরা আশাবাদী হতে চাই আর তাই আমরা মনে করি, সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এবং কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করতে চলমান সংস্কারব্যবস্থায় শিগগিরই একটি ‘নারী অধিকার কমিশন’ গঠন করা উচিত। এর মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের নারীদের কাছ থেকে দেশ গঠনে তাঁদের মতামত নেবে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে।
৩.
সংস্কারব্যবস্থায় দ্রুতই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিশন' গঠনের কথাও নানা ফোরামে উত্থাপন করেছেন সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং জাতিগত সংঘাত ও শান্তি নিয়ে সক্রিয় বিশেষজ্ঞগণ। যে কমিশনের মূল কাজ হবে: ক) ২৭ বছরে শান্তিচুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন নিরীক্ষণ করা, খ) শান্তিচুক্তির ধারাগুলোকে পরিমার্জনাট মাধ্যমে সময়োপযোগী করা, গ) পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মৈত্রী ও সম্প্রীতির রূপরেখা প্রণয়ন করা, এবং ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও জাতীয় নিরাপত্তার যোগসূত্রের ভিত্তিতে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা।
মনে করা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের গুরুত্বের তালিকায় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টাকে নিয়েও রয়েছে এন্তার সমালোচনা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্তর থেকে পতিত সরকারের শেকড় উৎপাটনের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায় নি। যে কারণে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম উতপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে ঘটনার পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা খোদ সরকারের পক্ষেই বলা হয়।
তথ্য বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ৬১ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণ করা হলেও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যরা এখনো বহাল রয়েছেন। তবে তারা দপ্তরে অনুপস্থিত। যেমন, গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিনটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গা ঢাকা দেন। আবার স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে অব্যহতির ঘোষণা দিয়েছেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইুপ্রু চৌধুরী। স্বাভাবিক কারণেই চেয়ারম্যান-সদস্যদের অনুপস্থিতিতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের দাপ্তরিক, প্রশাসনিক, সেবা-পরিষেবাসহ পরিষদীয় সব কার্যক্রমে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
জানা যায়, সবশেষ ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে অংসুইপ্রু চৌধুরী, খাগড়াছড়িতে মংসুইপ্রু চৌধুরী ও বান্দরবানে ক্যশৈহ্লা মারমাকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। তিনটি পরিষদে মনোনীত এসব চেয়ারম্যান-সদস্য সবাই আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষনেতা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির বিশেষ শর্তে প্রবর্তিত এ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পাঁচ বছর অন্তর তিন জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করার বাধ্যবাদকতা থাকলেও পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী কোনো সরকারই নির্বাচনের পদক্ষেপ নেয়নি।
চেয়ারম্যান-সদস্য পদে নিজস্ব লোকজনদের নিয়োগ দিয়ে পরিষদ তিনটি পরিচালনা করে আসছিল বিগত সরকারগুলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার মনোনীত চেয়ারম্যান-সদস্যদের অপসারণ করে পরিষদ তিনটি পুনর্গঠনের কথা শোনা গেলেও এ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। তবে ইতোমধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অংসুইপ্রু চৌধুরী স্বেচ্ছায় অব্যাহতির ঘোষণা দিলেও অন্যরা এখনো বহাল আছেন, যদিও তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।
৪.
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কমপক্ষে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটিও মনোযোগের দাবি রাখে। অতীতের সরকার রোহিঙ্গা বিষয়ক কোনও নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায় বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। মিয়ানমারে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায়-প্রতিদিনই নির্যাতিত রোহিঙ্গা পরিবার এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সীমান্তের অপর দিক থেকে গোলাবারুদ এসেও পড়ছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের দূরত্ব ও উত্তেজনা বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে মানব, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও রয়েছে ঘোরতর অনিশ্চয়তায়। ফলে পুরো বিষয়গুলোকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ও প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য একটি কমিশনের অপরিহার্যতা তাই অনস্বীকার্য।
অতএব, সংস্কারে উপেক্ষিত নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।