অদৃশ্য লেজের অলৌকিক ক্ষমতা!

  • চিররঞ্জন সরকার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

শিল্পী-সাহিত্যক-কবি-অভিনয়জীবী যাদের আমরা জ্ঞানী-গুণী-নক্ষত্র ভাবতাম এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্দনা করতেন, দিন দিন তারা প্রমাণ দিচ্ছেন যে তারাও মাটির মানুষ। লোভী মানুষ। চাটুকার মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা তাদের মঞ্চে তুলে গাইতে বলেন। নাচতে বলেন। স্লোগান দিতে বলেন। টকশোতে গলা ফাটাতে বলেন। তারা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে টিভি ক্যামেরার একই ফ্রেমে থাকার জন্য গোপনে একে অন্যকে কনুই দিয়ে গুঁতোও দিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই কাজটি করেন। ক্ষমতাসীনদের জয়গান করেন-একটু পদ-পদবির জন্য, একটু ক্ষমতা, বাড়তি একটু সুবিধার জন্য। ডাক্তার-কবি-সাহিত্যিক অধ্যাপক বলে কোনও পৃথক জনগোষ্ঠী আর অবশিষ্ট নেই বাঙালির মধ্যে। এদেশে এখন এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, প্রায় সকলকেই কেনা যায়। রাজনৈতিক বিশ্বাস আর আদর্শ বলে কিছু নাই।


নতুন যুগের ধ্রুবপদ হল ব্যক্তিগত পাওয়া। যে-কোনও মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তি সামাজিক আলোচনায় কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে যেইমাত্র তাকে বলা হয় তার নিজের প্রমোশন, কোনো একটি বিশেষ পদ বা সুবিধা কিংবা ছেলেমেয়ের চাকরির ব্যাপারে কোনও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছে দরবার করতে হবে অথবা একটু তোষামোদ করে সেই ব্যক্তিকে খুশি করলেই কার্যসিদ্ধি হবে, তাহলে সেই ব্যক্তি মেরুদণ্ড বন্ধক রাখতে পিছু হটবেন না। কারণ, তখন সামনে চলে আসবে ব্যক্তিগত স্বার্থ।


আমি যার আন্ডারে পিএইচডি করি সেই প্রফেসর যদি সংখ্যালঘু হন, তাহলে আমি তাকে সারাক্ষণ তুষ্ট করে চলব। অথচ বন্ধুমহলে হয়তো আমি সংখ্যালঘু-বিদ্বেষী। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক তাই। তারাও সম্প্রদায়গত বিভেদ কিংবা উগ্র মনোভাবকে বাড়িতে রেখে আসবেন যখন ব্যক্তিগত কোনও কাজ চরিতার্থ করতে হবে। তখন দেখা যাবে তিনিও সেই অপ্রিয় ব্যক্তির দ্বারস্থ হয়ে মনভজানো সব কথা বলছেন! এটাই নিয়ম।

বিজ্ঞাপন

বিখ্যাত পত্রিকায় অন্যের গল্প কবিতা ছাপা হলে আমরা সেই পত্রিকার গালমন্দ করি। সেই পরিচিত লেখক কীভাবে তোষামোদের মাধ্যমে এসব নিম্নশ্রেণির লেখা ছাপিয়ে নিচ্ছেন সেই সমালোচনা করি। কিন্তু, যেই সেই পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ পেল তখনই সেটি উন্নত মানের পত্রিকা হয়ে গেল আমার কাছে। আমার মনের মতো কথা শুক্রবার কোনও পত্রিকায় ছাপা হলে সেটি ভালো পত্রিকা। আমার বিরুদ্ধমতের কথা শনিবার সেই পত্রিকায় ছাপা হলে সেটি খারাপ পত্রিকা।

ক্ষমতার রাজনীতি প্রমাণ করে দিয়েছে, বাঙালির আর কোনও নেতৃত্বপ্রদানের ক্ষমতা নেই। রাজনৈতিক মেধা নেই। সরকার একের পর এক ইস্যু বিরোধীদের হাতে তুলে দিলেও একটিও দল নেই যারা ক্ষমতাসীনদের সামান্যতম বিপাকে ফেলতে পারছে।

শেরপুরের শ্রীবরদীতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে অভিযানের জের ধরে পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে মারধর করা হয়েছে। ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা এই মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে আহত হয়েছেন শ্রীবরদী থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল হান্নান ও রফিকুল ইসলাম। এই ঔদ্ধত্যের উৎস কি? ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা কোত্থেকে পায় এই দুঃসাহস? এর জন্য দায়ী আমাদের জাতীয় রাজনীতির প্রধান পাত্রপাত্রীরা। ওইভাবে আগ্রাসী মনোভাব দেখানোর, অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে প্রতিপক্ষকে দেখে নেওয়ার হুমকি আমরা দেখে এসেছি জাতীয় রাজনীতির লবকুশদের মধ্যেই। ওসব নতুন কিছু নয়।


ক্ষমতাই রাজনীতির আদর্শ। ক্ষমতা যার তার কোনো সমালোচনা নেই, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই। প্রতিরোধ কে করবে? প্রতিরোধের শক্তি তো আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিই ক্ষমতাসীনদের এই কৌশল শিখিয়েছে। বিরোধীরা তাদের রাজনৈতিক মেধা, নেতৃত্বগুণ, উদ্ভাবনী শক্তি এবং মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা, শক্তি, সাহস, মনোবল সব কিছু হারিয়ে ষড়যন্ত্রের কানাগলির অন্বেষণ ও দৈব-দুর্বিপাকের আশায় দিন কাটাচ্ছেন।


আমাদের নেতানেত্রীদের দেখে ওই হতাশাই প্রকট হচ্ছে যে তারা নতুন কোনও রাজনৈতিক লাইনের ফরমুলা আবিস্কারই করতে পারছেন না। তাই ক্ষমতাসীনরা বড়সড় কোনও বিপদে পড়ছেন না। জিতে যাচ্ছেন। কারণ, রাজনৈতিক খেলায় ক্ষমতাসীনরা বারংবার মেরুদণ্ডহীন বাক্যনির্ভর বিরোধীদের হারিয়ে দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীনদের প্রতি সাধারণের অনাস্থা ও ক্ষোভ প্রতিফলনের কোনও সুযোগও মিলছে না। ভোট যন্ত্রে এর প্রতিফলন ঘটতে পারত। কিন্তু সেই ‘ভোট-প্রক্রিয়া’ও বিরোধীদের নাগালের বাইরে।

একথা ঠিক যে চেনা ছকের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সরানো যাবে না। সরকারের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু বিরোধীদের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। বিরোধীদের কোনও আচরণ, কোনও অবস্থান, কোনও সিদ্ধান্তেই আম জনতা চমকিত হন না। ছকের বাইরে না-গেলে চোখে পড়া যায় না। তার জন্য দরকার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক রিডিং এবং মানুষের পালস বোঝার ক্ষমতা। লাগে সাহস, জ্বলে উঠবার ক্ষমতা। সেরকম কোনও লক্ষণ বিরোধীদের রাজনীতিতে টের পাওয়া যায় না।

এদিকে ‘প্রতিবাদী মধ্যবিত্তরা’ও আপাতত শীতঘুমে অচেতন। আর বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ‘পাইয়ে দেওয়া’র এক লাগসই নীতি গ্রহণ করেছেন। সুবিধাবাদীদেরকে পকেটে রাখার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। কিছু গরিব-দুঃখী আছেন, যারা সেফটি-নেটের আওতায় সরকারি অনুদান পেয়ে সন্তুষ্ট। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা-পরিবারের সদস্যরা সরকারি ভাতা পেয়ে সন্তুষ্ট। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের যে গ্রুপ একটু উচ্চকিত গলায় কথা বলতে পারেন, তারাও বশে। আসলে আমরা অল্পতেই খুশি। ভূষিতেই খুশি। খুদ-কুড়ো-কলাটা-মুলাটা হলে তো বর্তেই যাই!


দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় আমরা অনেক কিছুই হারিয়েছি। কিন্তু অর্জন করেছি আশ্চর্য অলৌকিক অদৃশ্য একটা লেজ। এই লেজ দেখা যায় না। এর দ্বারা মশা-মাছি তাড়ানো যায় না। কিন্তু কাউকে সন্তুষ্ট করতে নাড়ানো যায়!

আমরা কী পারি? হ্যাঁ, লেজ নাড়াতে পারি! আমরা আপাতত এই লেজটা নেড়েই যাচ্ছি, নেড়েই যাচ্ছি!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট