'রোহিঙ্গা প্রশ্নে সুচিকে সমর্থন আর একাত্তরে ইয়াহিয়াকে সমর্থন একই কথা'

  • একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ছবি: বার্তা২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ছবি: বার্তা২৪

রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে দি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ এবং পরে কানাডার কার্লেটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে রয়েছে তার অনেক প্রবন্ধ ও গবেষণা।
বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এরশাদুল আলম প্রিন্স।
====

বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এটি সামগ্রিকভাবে আমাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ড. আহমেদ: ক্রমেই রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য প্রকট আকার ধারণ করছে। মিয়ানমার থেকে প্রায় তিন মাসেই বাংলাদেশে যে সংখ্যক রোহিঙ্গা এসেছে তা একটি বিরল ঘটনা। এটি একটি মানবিক সংকট। মিয়ানমার একটি ধারণা বিশ্বকে দিতে চায় যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকেই এসেছে, তারা বাংলাদেশেরই নাগরিক। একই কথা তারা সৌদি আরব, ভারত, চীন তথা অন্য রাষ্ট্রগুলোকেও বলছে। মিয়ানমার বাদে অন্য যে দেশগুলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে তাদের সাথে হয়তো মিয়ানমারের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বা স্বার্থ রয়েছে। তাদের কাছে রোহিঙ্গাদের রাখার চেয়ে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক রাখা বেশি লাভজনক। তবে আমাদের সরকার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে

বিজ্ঞাপন

বার্তা২৪.কম: সম্প্রতি আমরা দেখছি ভারত থেকেও রোহিঙ্গারা আসছে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
ড. আহমেদ: ভারতের সাথে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা জানি ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার যেখানে জেনোসাইড করেছে ভারতের সেখানে কোনো ভূমিকা না রাখাটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এতে হয়তো অনেকেই মনে করবে, একাত্তরে তারা যে ভালো কাজটা করেছিল সেটা আসলে নিজেদের স্বার্থেই ছিল, তাতে মানবিক কোনও বিষয় ছিল না। ভারতের এমন ভূমিকায় অনেকে মনে করছে, ভারত আসলে মিয়ানমারের সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। তাতে আপাতদৃষ্টিতে ভারতের জন্য ভালো মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ভালো ফল বয়ে আনবে না। কারণ ফিজিসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ভারতের নাগরিক আছে। কখনো যদি তারা তাদের ফিরিয়ে দেয় তখন আমরাও বলবো এটা তোমাদের দায়িত্ব।

বার্তা২৪.কম: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিতে আমরা কী করতে পারি?


ড. আহমেদ: যেহেতু বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিষয়টি সমাধানের যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে, সে হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে যে চাপটা আনা দরকার সেটা ততটা গতি পায়নি। তবে নির্বাচনী বছর থাকায় কিছুদিন বিষয়টি নিয়ে সেভাবে পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আশা করি নতুন সরকার আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার তার অবস্থান থেকে নড়বে না।

৭০ এবং ৯০ এর দশকে আমাদের দেশে রোহিঙ্গা পাঠানোর সঙ্গে এবারের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এবারের বিষয়টিকে স্বাধীন কমিশন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক আরও কিছু সংস্থা গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে দেখছে। বিষয়টি কিন্তু শুধু বাংলাদেশ-মিয়ানমারের নয়, এটি আন্তর্জাতিক বিষয়। কারণ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই রোহিঙ্গারা আছে। সেক্ষেত্রে এসব দেশেরও মাথা ব্যথা রয়েছে। মিয়ানমার যেহেতু রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না, তাহলে তাদের আসলে কী হবে? আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য এ বিষয়টি সামনে এনে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্স করা দরকার।

যেহেতু বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) পর্যন্ত গড়িয়েছে সেক্ষেত্রে এটি মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করি। এভাবে চারদিক থেকে যখন চাপ আসবে তখন মিয়ানমার হয়তো তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবে।


বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এটি রোধের উপায় কী?
ড. আহমেদ: সরকার যদিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে, কিন্তু পাসপোর্ট সেক্টর দুর্নীতিমুক্ত করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। হয়তো তথ্য প্রযুক্তিই পারে দ্রুত এ বিষয়ে সমাধান দিতে।

এখন পাসপোর্ট সেক্টর ডিজিটাল হয়েছে। এর মাধ্যমে জাল পাসপোর্ট শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এর সঙ্গে যে চক্র জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনলে এমন অপরাধ অনেকটা কমে যাবে।

বার্তা২৪.কম: মুসলিম দেশগুলোর আরও জোরালো ভূমিকা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?
ড. আহমেদ: মুসলিম দেশগুলো যে একেবারে এগিয়ে আসেনি সে কথা বলা যাবে না। শরণার্থীদের ব্যাপারে বিশেষ করে তুরস্ক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আবার একইভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিভিন্ন সভায় তারা বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। তবে যতটুকু আশা করে গিয়েছিল ততটুকু ভূমিকা মুসলিম দেশগুলো থেকে পাইনি। হয়তো যেহেতু বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে, তাই তারা ততটা এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এখন যেহেতু প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে তাই সময় হয়েছে বাংলাদেশের একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া। মুসলিম দেশগুলোকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে কুতুপালংই বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। অনেক সময় কথা বলে সব বোঝানো যায় না। সেক্ষেত্রে এখানকার ছবি তুলে বিশ্ব দরবারে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একাত্তরে ভারত যেভাবে সেদেশে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও সেভাবে তুলে ধরতে হবে। একাত্তরে দি বিটলস, রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের অবদান এক্ষেত্রে অনুসরণীয়।

বার্তা২৪.কম: দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আমরা কী করতে পারি?
ড. আহমেদ: আমার মনে হয়, রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করে কর্মদক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ হলে তখন মিয়ানমারই হয়তো তাদের নিতে চাইবে। কারণ, শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ জনসম্পদ কেউ ফিরিয়ে দিতে চায় না।

বার্তা২৪.কম: সরকার তথা দেশীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কী ভূমিকা আশা করতে পারি?
ড. আহমেদ: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অং সান সুচির ওপর আস্থা রেখেছিল। চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করেছে। যখন জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনও আলোচনা হয়েছে তখন চীন তাতে ভেটো দিয়েছে। চীনের দেখাদেখি রাশিয়াও ভেটো দেয়। এভাবে তারা পুরো জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে। এভাবে পশ্চিমা দেশ, ভারত ও চীনের কূটনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ভিকটিম হয়েছে রোহিঙ্গারা আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এ বিষয়টি ভারত-চীনসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে উপলব্ধি করতে হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে একাত্তরের মতোই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। ভারতের জনগণও তাদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও মানবিক বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক মহল বিষয়টিকে আরও সিরিয়াসলি দেখবে, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আরো গুরুত্ব দিয়ে ভাববে। অং সান সুচির ওপর বিশ্বাস না করে বিশ্ব সম্প্রদায় সেখানে যে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হয়েছে সে বিষয়টিকে যেনো সামনে নিয়ে আসেন। অং সান সুচিকে সাপোর্ট করা আর একাত্তরে ইয়াহিয়া খানকে সাপোর্ট করা একই কথা।

বার্তা২৪.কম: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ড. আহমেদ: বার্তা২৪-কেও অনেক ধন্যবাদ।