প্রসঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তন: মরুকরণ ও বাংলাদেশ

  • আলম শাইন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের ফলে সবুজ সুশোভিত ষড়ঋতুর দেশ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেমন অস্বাভাবিকভাবে  বেড়ে গেছে তেমনি ঠাণ্ডাও অনভূত হচ্ছে বেশি। বেড়ে গেছে নানা রোগের সংক্রমণও। ঋতুচক্রে দেখা দিয়েছে বিশাল হেরফের। আগের মতো এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম  মেনে যথাসময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না। ঋতুর সংখ্যাও  হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ছাড়া অন্যসব ঋতুর আমেজ আজ আর উপভোগ করা যায় না। এছাড়াও বিলম্বিত হচ্ছে শীত, বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারি বর্ষণ কিংবা ঠাণ্ডা। যেকোনো এলাকা মরুকরণের প্রাথমিক আলামতই হচ্ছে এসব। আর এ আলামতটি পরিলক্ষিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশেই।

দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ অন্যসব এলাকার তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ একটা সময়ে এ অঞ্চলের  আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। সেই সুষম আবহাওয়া এখন আর বিরাজ করছে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বছর দশেক ধরে গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা অনভূত হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। গত শীত মৌসুমে তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে গিয়েছে, আর গত গ্রীষ্মে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করেছে।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, কোনো এলাকা মরুকরণের জন্য বৈরি আবহাওয়ার সঙ্গে ৩৮-৪০ ডিগ্রি  সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট। উদহারণস্বরূপ বলা যায়, উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত ‘সোনোরান’ মরুভূমির কথা। এটি উত্তর আমেরিকার শুষ্ক ও উষ্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। গ্রীষ্মকালে সেখানকার তাপমাত্রা ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। শীতকালে গড় তাপমাত্রা থাকে ১০ থেকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতও তেমন সন্তোষজনক নয়। সোনোরান মরুভূমির তাপমাত্রার পরিসংখ্যান মোতাবেক বলা যায় আমাদের দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের তাপমাত্রা তারচেয়েও ভয়ানক। রক্ষা পেয়েছে শুধুমাত্র বৃষ্টিপাত এবং যৎসামান্য বনজ সম্পদের কারণে।

এখানে  সোনোরান মরুভূমির তুলনায় বৃষ্টিপাত একটু বেশি বিধায় মরুকরণ প্রক্রিয়া খানিকটা বিলম্বিত হচ্ছে। জলবায়ুর সামগ্রিক পরিসংখ্যানে দৃষ্টি দিলে নি:সন্দেহে বলা যায় এটি আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্যে মহাবিপদ সংকেত।

বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ নিয়ে বিশ্বের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে। তারা সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছেন আমাদের। মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানী ড.নারম্যান ম্যাকলিয়ও যিনি সাহারা মরুভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন, তিনি   জানিয়েছেন,‘সাহারা মরুভূমি শুরু থেকে যেভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়েছে, ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ পক্রিয়া শুরু হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাতাসেও সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে।

মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানীর দেয়া এ তথ্যের প্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, মরুকরণ প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিক ভাবে ঘটে না, খুব ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়। মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসই আঁচড় কাটে বেশি। কারণ একবার মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও দেখা যায় এটি পরিপূর্ণতা পেতে অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। ফলে মানুষের মাঝে বিতর্ক লেগেই থাকে। অর্থাৎ মরুকরণের পরিপূর্ণতা দেখে যেতে হলে একটা মানুষের জীবদ্দশায় তা সম্ভব হতে না-ও পারে। আবার হতেও পারে। সেটি নির্ভর করবে পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিমাণের ওপর।

মাস ছয়েক আগে দেশের একটি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম নজর কাড়ে আমাদের। শিরোনামটি ছিল, ‘২০৫০ সালের মধ্যে বাসভূমি হারাবে বাংলাদেশের ২ কোটি মানুষ। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই দেশের ৪ হাজার ৮০০ বর্গমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। আর দুই মিটার বাড়লে তলিয়ে যাবে ১২ হাজার ১৫০ বর্গমিটার। প্রতিবেদনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সূত্র মতে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৪৪ হেক্টর আবাদী ভূমি এবং ২০ হেক্টর বনভূমি মরুকরণ হচ্ছে। সে হিসেব মোতাবেক দেখা যায় বছরে ৭০ লাখ হেক্টর জমি মরুকরণ হচ্ছে। মরুকরণের প্রভাবে পড়ে উত্তর আমেরিকার ৪০ শতাংশ আবাদি ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে সাহারার দক্ষিণ অংশে গত ৫০ বছরে ছয় লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি গ্রাস করে নিয়েছে মরুভূমি। জাতিসংঘের তথ্য মোতাবেক জানা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতি বছর বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকা মরুকরণ হচ্ছে। এটি সমগ্র বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি বিস্ময়কর সংবাদ। এ জন্য দায়ীও মানবকুল।

পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদী শাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের চাঁই গলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মরুকরণ হচ্ছে পর্যাপ্ত জলের অভাবে আরেক এলাকা। যার প্রধান শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দুই মেরুর বরফ গলার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও মালদ্বীপ, মুম্বাই, ইন্দোনেশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড, মিশরের ব-দ্বীপ অঞ্চল, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ভিয়েতনামের উপকূলীয় শহর সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে  বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

দু’ভাবেই আক্রান্ত হচ্ছে এ দেশ। প্রথমত, দেশের দক্ষিণাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে। দ্বিতীয়ত, দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে জল সংকটের কারণে।  অর্থাৎ জল বৃদ্ধি এবং জল হ্রাস দু’টি সমস্যাই এ দেশের জন্য প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ফারাক্কা বাঁধের ফলে পর্যাপ্ত জল বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে হয়ে পড়ছে এবং তারই প্রভাবে মরুকরণ তরান্বিত হচ্ছে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে যদি প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। জানা যায়, এ বাঁধের দৈর্ঘ্য ১৫০০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০০ ফুট। বিশাল এ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের সিলেটসহ এক তৃতীয়াংশ এলাকা এবং ভারতের মিজোরামপুর, মনিপুর, অসামের নৌপরিবহন, কৃষি, মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। শুধু সিলেট ও  মৌলিভীবাজারের ৩৫ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমি বিরান হয়ে যাবে। এ বাঁধের ফলে মরুকরণের পাশাপাশি সমুদ্রের লোনাজল ওপরের দিকে উঠে আসবে। এতে সুপেয় জল সংকট দেখা দেবে। যেমন দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার ফলে।

চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে তখন মহাদুর্যোগ। জীববৈচিত্র পড়বে অস্তিত্ব সংকটে। বনভূমি বিরান হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে আরো দ্রুত। ইচ্ছে করলেও মরুকরণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না কারো পক্ষে।

আমরা যদি এ মুহূর্তে সতর্ক হতে পারি তাহলে হয়তো বিপর্যয় কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে বেশ কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। নদ-নদী দখল কিংবা জলাশয় ভরাটের ব্যপারে সতর্ক হতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ করে বৃক্ষ নিধনসহ বন্যপ্রাণী নিধন বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতির সৃষ্টি প্রতিটি সন্তানই কোনো না কোনো ভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মশা থেকে শুরু করে হাতি পর্যন্ত সবাইকে আমাদের প্রয়োজন পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার্থে। এ সত্য তথ্যটি মানুষকে জানাতে হবে, বুঝাতে হবে।

মরুকরণরোধে পাখ-পাখালির ভূমিকা যে অপরিসীম তা-ও জানান দিতে হবে মানুষকে। বিশেষকরে পরিযায়ী পাখিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও রয়েছে দেশের মানুষের। প্রধান অভিযোগটি হচ্ছে ওরা নাকি আমাদের ফল-ফলাদি কিংবা শস্য-বীজ খেয়ে ফেলে। অভিযোগটি একবারেই মিথ্যেও নয়, ওরা মানুষের ফসলাদি নষ্ট করছে ঠিকই কিন্তু সেই ক্ষতিটি আমাদের জন্যে ‘শাপে বর’হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন পাখি আমাদের ফল খেয়ে ফেলেছে সত্যি, কিন্তু ফলের বিচিগুলো মলত্যাগের মাধ্যমে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। এতে করে দুর্গম এলাকায়, নবদ্বীপসমূহে ও রুক্ষভূমিতে বনায়ন সৃষ্টিতে সহায়ক হচ্ছে। আর বনায়ন সৃষ্টির মানেই হচ্ছে মরুকরণের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া।

তাই আমাদের উচিত হবে যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণীর প্রতি সদয় হওয়া। তাতে করে আমাদের লাভ বৈ লোকসান হবে না। পাখ-পাখালির কল্যাণে শুধু মরুকরণরোধই নয়, আমরা পাচ্ছি নির্ভেজাল অক্সিজেন ফ্যাক্টরিও। কাজেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে। তাহলে হয়তো এ যাত্রায় আমরা কিছুটা হলেও নিস্তার পাব।

আলম শাইন:  কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।