রাজনীতি: তুর্কিতৃষ্ণা ও পাপের ফল

  • শুভ কিবরিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শুভ কিবরিয়া, ছবি: বার্তা২৪

শুভ কিবরিয়া, ছবি: বার্তা২৪

এক. 

ঢাকা শহরের যানজটের ওপর এখন আর গোস্বা করা মানায় না। বরং নিয়তির মতো মেনে নেওয়াই লাভজনক। তাতে মনের দুঃখ কমবে। শরীরের ওপরও চাপ বাড়বে না। এছাড়া উন্নয়নের একটা বাড়তি চাপও আছে যানজটের ওপর। উন্নয়ন এখন অনেক কিছু খেয়েও ফেলে। আমরা যেহেতু উন্নয়ন চাই, যে কোনো মূল্যেই চাই, যে কোনো কিছুর বিনিময়েই চাই কিংবা সেই চাওয়াটাই জীবনের জন্য নিরাপদ, তাই ঢাকা শহরের সর্বত্র যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছোঁয়া আছে তাতে যানজট আরও অসহনীয় হয়ে উঠলেও তার সাথে মানিয়ে নেয়াটা জরুরি। কেননা নাগরিক হিসাবে আমাদের কাজ হচ্ছে অসহ্য সব কিছুকে সহ্যসীমায় নিয়ে নেবার অভ্যেস করা । সেটা স্বাস্থ্যপ্রদ এমনকি নিরাপদ-নিরুদ্বেগ জীবনের জন্যও উপাদেয়।

বিজ্ঞাপন

তাই নাগরিক হিসেবে, এই শহরের বাসিন্দা হিসেবে আমি কিছু নিত্যনতুন অভ্যেস রপ্ত করেছি। ঢাকার গণপরিবহনে উঠে, যত অনিময়ই দেখি না কেন, যতই অনাচার চোখের সামনে ঘটুক না কেন, মনকে অন্য দিকে সরিয়ে দিতে ঋষির মত নীরব ও ধ্যানমগ্ন থাকি। অভিজ্ঞতায় বুঝেছি সেটাই লাভজনক।

আর একটা অভ্যেস খুব কাজে লাগে সেটা হচ্ছে পছন্দসই কিছু পড়া। গণপরিবহন এখন যতটা চলে তার চাইতে অনেক বেশি থেমে থাকে নানা অজুহাতে। সেখানে কপালগুণে পেছনের দিকে একটা সিট পেয়ে বসে পড়তে পারলে পড়াশোনা চালিয়ে নেয়াটা খুব কঠিন কিছু নয়। আজ এমনিভাবেই পড়ছিলাম বিখ্যাত ও আলোড়িত কবি নাজিম হিকমতের চতুর্থ স্ত্রী ও জীবনের শেষ প্রেমিকার লেখা একটা বইয়ের কথা। এই লেখাটার মধ্যেই অদ্ভুত একটা শব্দ পেলাম। শব্দটি হচ্ছে, তুর্কিতৃষ্ণা। কথাটা খুব ভাল লাগল। এই তৃষ্ণায় পড়লে মানুষ বেপোরোয়া হয়। তুরস্ক দেশের কিছুটা গোয়াড় গোবিন্দ ধরণের জেদকেই তুর্কিতৃষ্ণা বলেছেন লেখক। এই ধরণের তৃষ্ণাময় প্রেমের সাথে মানিয়ে চলা সহজ কাজ নয়।

কবি নাজিম হিকমত শেষ জীবনে রাশিয়ার মেয়ে ভেরা তুলিয়াকোভা নামের এক নারীর প্রেমে পড়ে তাকেই বিয়ে করেছিলেন। সেই প্রেমও ছিল অন্ধ আবেগের জোয়ার টানা প্রেম। বয়সে ৩০ বছরের বেশি ব্যবধান থাকা সত্বেও কবির প্রেমিকার পক্ষে নাজিম হিকমতকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কবিকে বিয়ে করতে বাধ্য হন ভেরা।

কবি নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠি আমাদের জীবনে এক আবেগময় সময়কে যথেষ্ট রস্বাস্বাদিত করেছিল। রাজনীতি, প্রেম, তারুণ্যের মগ্নতা, দীর্ঘদিন জেল খাটার অভিজ্ঞাতসম্পন্ন নাজিম হিকমত তাই ছিলেন আমাদের যৌবনের এক আইকন। তাঁর জীবনব্যাপী তুর্কিতৃষ্ণা আমাদের সময়ের বহু তরুণ-তরুণীর ছিল আরাধ্য।

দুই.
এই লেখাতেই কবির জীবনের একটা গল্প পড়লাম। কবি নাজিম হিকমত তখন প্রেমিকা ভেরাকে বিয়ের জন্য উম্মত্ত। প্রেয়সীকে নিজের করে পাবার জন্য কবির তুর্কিতৃষ্ণায় কবি তখন পাগলপারা। বিয়ে রেজিষ্ট্রি করতে কবি চলেছেন ট্যাক্সিতে। রেজিষ্ট্রি অফিসে ট্যাক্সি থামলে ট্যাক্সিচালক ভাড়া নেবার সময় কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি নাজিম হিকমত? কবি জানালেন, হ্যাঁ, আমিই নাজিম হিকমত। ট্যাক্সিচালকের কৌতুহল তখন আরও বাড়ল। জানতে চাইলেন কবির কাছে, ক্ষমা করবেন, আপনি কি বিয়ে করতে এসেছেন? কবি বললেন, হ্যাঁ ভাই। আমিই বিয়ে করতে এসেছি। এবার মুখ কালো করে ট্যাক্সিচালক বললেন, কমরেড হিকমত, আপনি এতগুলো বছর জেলখানায় ছিলেন, তারপরও বন্দিজীবনের প্রতি আগ্রহ আপনার। কবি হাসতে হাসতে বললেন, বন্দিজীবনটাই আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, ভাই। কিছুই করার নেই।

তিন.
বিয়েজীবনেও প্রেমের অমৃত স্বাদ পেয়েছিলেন কবি। কবির শেষ স্ত্রী ও প্রেমিকা ভেরা তুলিয়াকোভা কবির মৃত্যুর একটা অসাধারণ বয়ানও লিখে রেখেছেন। আজ সেসব পড়তে বসে মনটা কিছুটা বিষণ্ন হয়ে উঠলো।

কবির স্ত্রী লিখছেন, সেদিন সকালে অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পর্দাহীন জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে সরাসরি আমার চোখে পড়ছিল বলে। ঘর ছিল নিস্তব্ধ। সকাল ৭টা ২০ বেজে গেছে। মিনিট পাঁচেক পর তুমি (কবি নাজিম হিকমত) হঠাৎ সটান উঠে পড়লে এবং দ্রুত দৌড়ে গেলে দরজার দিকে। আমি তোমাকে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু ভাবলাম, আরেকটু ঘুমিয়ে নিই। তুমি আর ফিরে এলে না।

এক মিনিট পার হলো, দুই মিনিট পার হলো, কিন্তু দরজায় তোমাকে দেখা গেল না। আরও খানিকক্ষণ আমি শুয়ে থাকলাম। কিন্তু কী যেন কী হয়ে গেল আমার, এরপর আমি উঠে তোমাকে খুঁজতে লাগলাম। কোথায় লুকালে তুমি? ভাবলাম, হয়তো পানির তেষ্টা পেয়েছে, কিংবা সিগারেট খাচ্ছ। আমি খুব তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসে তোমাকে খুঁজলাম। না, সেখানে তুমি নেই। আমি স্নানের ঘরে খুঁজলাম, টয়লেটে খুঁজলাম। হঠাৎ আমার ভয় করতে লাগল, এমন ভয় করতে লাগল, মনে হতে থাকল, পেছন থেকে গরম বাতাস এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আমি দৌড়ে গেলাম হলঘরে, সেখানে দেখলাম তোমাকে। তুমি বসে ছিলে, দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে, হাত দুটো ঠেকে ছিল মেঝেয়, এক পা তুর্কি কায়দায় ভাঁজ করা, অন্য পা প্রসারিত সামনের দিকে। তোমার স্বভাবের সঙ্গে বেমানান শান্ত চেহারাটা দেখেই আমার মনে হলো, তুমি মরে গেছ। মুহূর্তের মধ্যে আমাকে ছেড়ে দিল পৃথিবী। পৃথিবী বোবা-কালা হয়ে গেল। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম, তুমি উত্তর দিলে না। আমি বুঝলাম, সব শেষ।

ভেরা তুলিয়াকোভার লেখা রুশ ভাষায় নাজিমের সঙ্গে শেষ কথোপকথন নামের বইটির কিছু অংশ বাংলা অনুবাদ করে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় এ নিয়ে লিখেছেন জাহিদ রেজা নূর। লেখাটি পড়ে তাঁর ওপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো। যদিও একরাশ বিষণ্নতা তখনও আমার সঙ্গী।

চার.
এই বিষণ্ণতা খুব দীর্ঘস্থায়ী হলো না বাংলাদেশের হালের রাজনীতি নিয়ে ১৪ দলের সমন্বয়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের একটা উক্তি চোখে পড়ার পর। ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হত্যা মামলার রায়ের বিষয়ে কথা বলতে যেয়েই উক্তিটি করেছেন মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বিএনপির নেতাদের প্রতি ইংগিত করে বলেছেন, ২১ আগষ্ট হামলার পর আপনারা (বিএনপি) তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন, কেন বিচার করেন নাই? তদন্ত করেন নাই কেন? কেন বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন? কেন জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিলেন? এর জবাব কে দেবে? এই কারণে আপনাদের পাপের ফল ভোগ করতে হচ্ছে।

আপাতত বিএনপির দুর্দশার একটা কারণ পাওয়া গেল স্বাস্থ্য মন্ত্রীর বরাতে। বোঝা গেল ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাসীনদের জন্য অনেক পাপ করার সুযোগ আসে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার জোরে সেই পাপ করার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। কেননা তখন মনে হয় তাদের থামানোর কোথাও কেউ নেই। তাদের জবাবদিহি নেবার কেউ নেই। মনে হয় কোনোদিন তাদের অপকর্ম বিচারের আওতায় আসার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীনরা যেহেতু চেক এন্ড ব্যালেন্সের আওতায় থাকেন না, ফলে যা ইচ্ছা তাই করেন। বিএনপিও ঠিক তাই করেছিল।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়েও আদালতের বিচারক সেরকমই ইংগিত দিয়েছেন। এই মামলার রায়ে আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিরোধীদলকে নিঃশেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আর্জেস গ্রেনেডের মতো যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে ২১ আগষ্টের মতো নৃশংস ঘটনা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিরোধিদলীয় নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। সাধারণ জনগণ এই রাজনীতি চায় না।

পাঁচ.
লেখাটা কবি নাজিম হিকমতের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বিশেষ করে তার অন্ধআবেগের শক্তিজোড় তুর্কিতৃষ্ণার কথা উল্লেখ করতেই তার প্রেম ও মৃত্যুর কথা পেড়েছিলাম। আমাদের রাজনীতিবিদরাও ক্ষমতার প্রেমে এরকম তুর্কিতৃষ্ণায় মত্ত থাকেন। ফলে তাদের ক্ষমতাকালীন পাপকেও পূণ্য বলে মনে হয়। শুধু তাই নয় ক্ষমতাকালীন সময়ে মনে হয় তারা যে পাপ করছেন সেটাও জনগণের জন্য পূণ্যেই বয়ে আনবে।

এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কথা অনুসারে বিএনপির বর্তমান দুর্দশার কারণ যদি হয়ে থাকে ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের পাপের ফল, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে এখনকার ক্ষমতাসীনরা কি সেই প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকবেন? কিংবা অতীতে যখন তারা দুর্দশায় পড়েছিলেন সেটাও কি ছিল তাদের কর্মফল?

আমাদের বিবদমান, প্রতিহিংসাপ্রবণ রাজনীতি কি এই পাপ আর পাপের ফল থেকে কখনো মুক্ত থেকেছে? যদি আমরা আমাদের এই রাজনীতি না বদলাই তবে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের রাজনীতি কি এই হিংসার পাপ থেকে আর পাপের ফলভোগ থেকে মুক্ত থাকবে?

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।